![উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে অনিয়ম ও ন্যক্কারজনক ঘটনা](uploads/2023/12/02/1701504102.Untitled-1.jpg)
রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের বর্তমান কর্তৃপক্ষ একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতি ও ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে।
বিগত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, প্রতিষ্ঠানের তহবিল তছরুপ, বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য ব্যয়ের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায়, স্কুলে রাতের বেলায় ডিজে (ডিসকো জকি) পার্টির আয়োজন ও সর্বশেষ শিক্ষক কর্তৃক এক ষষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর মতো ঘটনায় অভিভাবক, শুভার্থীসহ সমাজের সচেতন মহল উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন।
অভিযোগ আছে, অধ্যক্ষ পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য নিয়োগ পাওয়া আ ন ম শামসুল আলম খান প্রভাব বিস্তার করে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছেন। তিনি স্কুল পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন ঠেকিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে স্বনামধন্য ওই প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়মের রাজত্ব গড়ে তুলেছেন। সমাজসেবী জোসেফাইন উইলস কর্তৃক ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ৬৭ বছরের পুরোনো এই ঐতিহ্যবাহী স্কুলের ভবিষ্যৎ ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
মাত্র তিন মাসের জন্য আ ন ম শামসুল আলম খানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে ২০১৯ সালে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর চার বছর চলে যাচ্ছে। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির (ম্যানেজিং কমিটি) নির্বাচন দেওয়া হয়নি। অধ্যক্ষ পদেও কাউকে পদায়ন করা হয়নি।
অভিযোগ আছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শামসুল আলম খান ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আফরোজা ইয়াসমিনকে কাজে লাগিয়ে উচ্চ আদালতে একটি অভিযোগ দিয়ে স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছেন। নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ইংরেজি মিডিয়ামের ওই আইনি পদক্ষেপের অজুহাত তুলে নাকচ করে দেন। উদ্দেশ্য হলো ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে তার নিজের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করা।
যোগাযোগ করা হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ ন ম শামসুল আলম খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচন হওয়া না হওয়ার বিষয়টি আদালতের ‘স্টে অর্ডার’ বা স্থগিতাদেশের কারণে থমকে আছে।’
ইতিপূর্বে ২০১৭ সালেও একই রকম একটি সংকট সৃষ্টি করে নির্বাচন ঠেকানো হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ভ্যাকেট করে নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত করা হয়। কিন্তু এবার নির্বাচনে আগ্রহ নেই অধ্যক্ষের।
এদিকে যাতায়াত, টিফিন ও বিশেষ ভাতার নামে স্কুলের তহবিল থেকে অন্যায়ভাবে অর্থ উত্তোলন করে নিচ্ছেন অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীরা। অধ্যক্ষের নেতৃত্বে ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রায় ১ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে অধ্যক্ষ আ ন ম শামসুল আলম খান বলেন, ‘কয়েকজন অভিভাবক আমার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আমি কোনো অনিয়ম করিনি।’
শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন নিয়ে অনিয়ম, বৈষম্য সৃষ্টি করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা-এর কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর ড. মো. হারুন-অর-রশিদ তদন্ত করে আটটি অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান বিধিসম্মত হয়নি। জনবল কাঠামোতে নেই এমন সব পদ সৃষ্টি করে দায়িত্ব বণ্টন করে মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা দিয়ে স্কুলের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ক্যানটিন ম্যানেজারকে শিক্ষক পদে, শিক্ষককে প্রভাষক পদে ও প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত (প্রমোশন) করা হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে কো-অর্ডিনেটর পদ সৃষ্টি করে অনেক শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল প্রভাবিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সংক্ষুব্ধ কয়েকজন অভিভাবক আদালতেরও সম্মুখীন হয়েছেন। সেটিও বিচারাধীন রয়েছে। ওই মামলায় অধ্যক্ষসহ অন্যরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেন।
ড. মো. হারুন-অর-রশিদ তার প্রতিবেদনে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি বিধি অনুসরণ করে অধ্যক্ষের শূন্যপদ পূরণ, অনিয়মতান্ত্রিক নিয়োগ ও দায়িত্ব প্রদান বন্ধকরণে বোর্ডের চেয়ারম্যানের পক্ষে বর্তমান অ্যাডহক কমিটির সভাপতিকে চিঠি দিয়েছেন। এ চিঠির নির্দেশ ও সুপারিশের প্রতিফলন গত কয়েক বছরে ঘটেনি।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বর্ধিত হারে বিদ্যুৎ বিল আদায় করা হলেও গরমের সময়ে শ্রেণিকক্ষে কোনো ফ্যান সরবরাহ করা হয় না। ওদিকে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের অফিস কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
কলেজ পরিদর্শক ড. হারুন-অর-রশিদের প্রতিবেদনে ‘অভিভাবকদের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছ’ বলেও উল্লেখ করা হয়। ইতোমধ্যে ড. হারুন অবসরে চলে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার খবরের কাগজকে বলেন, ‘ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে আমার জানা নেই। কারণ সে সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। স্কুলের বর্তমান অ্যাডহক কমিটিকে আমরা নির্বাচন করতে নির্দেশনা দিয়েছি।’
তারিকুল আযম খান
ক্যানটিন ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তারিকুল আযম খান। এরপর তাকে ‘কেয়ারটেকার’ হিসেবে পদোন্নতি দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও আরেক দফা পদোন্নতি দেওয়া হয়। স্কুলে ভর্তি বাণিজ্যসহ তার বিরুদ্ধে নানা অন্যায় অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।
১০ বছর আগে স্কুলটিতে ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তা’ পদটি বাতিল করা হলে ওই পদে নিয়োগ পাওয়া তারিকুল আযম খানকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া চলছিল। কিন্তু তৎকালীন স্কুল কর্তৃপক্ষ মানবিক দিক বিবেচনা করে নিয়মবহির্ভূতভাবে তাকে ‘সহকারী শিক্ষক’ হিসেবে আত্মীকরণ করে।
বর্তমানে তারিকুল আযম খান ‘কো-অর্ডিনেটর’ হিসেবে সৃজিত একটি ‘নিয়মবহির্ভূত’ পদেরও দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাকে এ বাড়তি দায়িত্বের জন্য বাড়তি অর্থ পরিশোধ করে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
তারিকুল আযম খানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর একটি হলো বিগত ব্যবস্থাপনা কমিটির সময়ে বর্তমান কেয়ারটেকার ফখরুদ্দিনের সঙ্গে মিলে স্কুলের বাথরুম মেরামত করার কাজ করেন। নিয়মবহির্ভূত এই কাজে স্কুলের ৫৮ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। অভিযোগ আছে, প্রকৃত ব্যয় অনেক কম ছিল।
অতি সম্প্রতি অধ্যক্ষ হজ পালন করতে সৌদি আরব গেলে ওই সময় রাতে স্কুলে ডিজে (ডিসকো জকি) পার্টির আয়োজন করে হৈ-হুল্লোড় ও অনৈতিক কাজ করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
এ ব্যাপারে স্কুলের অধ্যক্ষ খবরের কাগজকে বলেন, ছাত্রছাত্রীরা একটা পার্টি করেছিল। জাতিসংঘের একটা থিম নিয়ে আলোচনার অংশ হিসেবে তারা ওই পার্টির আয়োজন করে। ডিজে পার্টি হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে তারিকুল আযম খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আপনাদের কাছে যারা অভিযোগ দেয় এগুলোর সত্যতা নেই। আমি এসবের (পরীক্ষার) দায়িত্বে নেই। স্কুলে কোনো ডিজে পার্টি হয়নি।’
এদিকে সর্বশেষ ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রকে শিক্ষক কর্তৃক নির্মমভাবে পেটানোর ঘটনায় আবারও আলোচনায় আসে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল। ওই ছাত্রের মা শারমিন সুলতানা খবরের কাগজকে জানান, তার ছেলে বর্তমানে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি আছে। তার চিকিৎসা চলছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আনিছুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ নিয়ে স্কুলে গিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো অভিযোগ আমলে নেয় না।’
ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই স্কুল থেকে আমার বাচ্চাকে অনেক মানসিক চাপ দেওয়া হয় বলে তার মাকে জানায়। স্কুলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করে লাভ নেই। বরং উল্টো অভিভাবকদের হয়রানি করা হয়।’
প্রতিষ্ঠানটির স্কুল ও কলেজ শাখায় মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।