![পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর](uploads/2024/02/25/1708828074.BDR-day.jpg)
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো দিন। এদিন গুলির মুহুর্মুহু শব্দ আর একের পর এক লাশ দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দেশের ইতিহাসের জঘন্যতম দিন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৫ বছর। এই দিনে পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
‘২০০৯ সালের এই দিনটিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল কিছু বিপথগামী সৈনিক। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর (তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর) সদর দপ্তরে তারা ধ্বংসলীলা চালায়। তাদের সেই উন্মত্ততার শিকার হয়ে প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা, নারী, শিশুসহ আরও ১৭ জন।’
ঘটনার দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিডিআর দরবার হলে বার্ষিক (দরবার) নির্ধারিত সভায় বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একদল বিদ্রোহী সৈনিক তাদের মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। মহাপরিচালকসহ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা ও তাদের পরিবারকে জিম্মি করে। পিলখানার চারটি মূল ফটকই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকে তারা। জন্ম নেয় ইতিহাসের এক বীভৎস অধ্যায়ের। টানা ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান ঘটলেও ততক্ষণে বিদ্রোহী সৈনিকরা কেড়ে নেয় ৫৭ জন দক্ষ সেনা কর্মকর্তার জীবন। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। ঘটনার পর পিলখানায় আবিষ্কৃত হয় গণকবর। যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।
নিহতদের তালিকায় ছিলেন বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল। সামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও বিডিআরের গুলিতে কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হন। সদর দপ্তরের ভেতর এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তবে বিদ্রোহীরা ভেতরে আটকে পড়া শিশু ও নারীদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়।
২৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তাৎক্ষণিক এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে বিডিআর সদস্যদের একাংশ আত্মসমর্পণ করে। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত বিডিআর ক্যাম্পে পুনরায় উত্তেজনার খবর পাওয়া যায়। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বিডিআরকে আবারও তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বিদ্রোহী বিডিআরের সব সদস্য তাদের অস্ত্র জমা দেন এবং পুলিশ বিডিআর সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
এ ঘটনায় হতবাক হয়ে যায় সারা দেশের মানুষ। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ জন বিডিআর সদস্য এবং আরও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক নবজ্যোতি খিসা। এ ছাড়া বিজিবির নিজস্ব আইনে ৫৭টি মামলার বিচার শেষে সারা দেশে ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।
২০১০ সালের ১২ জুলাই পিলখানা হত্যা মামলায় ৮২৪ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরে সম্পূরক চার্জশিটে আরও ২৬ জনকে আসামি করা হয়। পিলখানা হত্যা মামলার ২৩৩ কার্যদিবসে ৬৫৪ জন সাক্ষী আদালতে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার ৪ বছর ৮ মাস পর ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লালবাগে অবস্থিত আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে এ হত্যা মামলার রায় দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান। রায়ে ৮৫০ জন আসামির মধ্যে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৭১ জনকে খালাস দেওয়া হয়। ২ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২৬৬ জনকে।
২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখা হয়। আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। খালাস পান ১২ আসামি।
এ ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এখনো বিচারাধীন। মামলাটির আসামি রয়েছেন ৮৫০ জন। তার মধ্যে ২৪ জন এরই মধ্যে মারা গেছেন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন। এ ছাড়া বাহিনীর নিজস্ব আইনে ৫৭টি মামলায় প্রায় ছয় হাজার জনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।
পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করা হয় বিদ্রোহের আইন।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সরকারিভাবে এ দিনটিকে ‘পিলখানা হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এ দিবসটির স্মরণে এক দিনের বিশেষ কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহিদদের স্মরণে আজ রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) শাহাদতবার্ষিকী পালিত হবে।
বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহিদদের স্মরণে আয়োজন করা হবে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। বিজিবির সদর দপ্তর থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এদিন শহিদ ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরসহ সব রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় খতমে কোরআন, বিজিবির সব মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে শহিদদের রুহের মাগফিরাত কামনাসহ দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
আসামির সংখ্যার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় মামলা
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ১৫ বছরে এসে এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় থাকলেও বিস্ফোরক মামলাটি এখনো বিচারিক আদালতের গণ্ডি পার হয়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, আপিল বিভাগে বিচারক-সংকটের কারণে সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটির শুনানি শুরু করা যাচ্ছে না। পিলখানা ট্র্যাজেডির ভয়াবহ নৃশংসতার পর হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে আলাদা দুটি মামলার বিচার শুরু হয় একসঙ্গে। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট দুই জায়গাতেই হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে। এখন অপেক্ষা, আপিল বিভাগে চূড়ান্ত আইনি লড়াইয়ের। তবে ১৫ বছরেও নিম্ন আদালতে সুরাহা হয়নি বিস্ফোরক আইনে করা মামলাটি। তাই হত্যা ও বিদ্রোহ মামলায় খালাস মিললেও কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না দুই শতাধিক আসামি। এ মামলায় আপিল দ্রুত শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির কাছে আমাদের আকুল আবেদন, এ নিরীহ আসামিদের দিক বিবেচনা করে এবং উভয় দিক বিবেচনা করে এই মামলার শুনানি কার্যক্রম যদি দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, তাহলে আমার মনে হয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, আপিল বিভাগে বিচারক-সংকটের কারণে মামলা শুরু করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। তিনি জানান, ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহালের পাশাপাশি যাদের সাজা কমানো হয়েছে, সে বিষয়েও শক্ত অবস্থান নেবে রাষ্ট্রপক্ষ।
তিনি বলেছেন, ‘সরকারপক্ষ থেকে আমরা আশা করছি যে ট্রায়াল কোর্ট যাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন এবং যাদের হাইকোর্ট কনফার্ম করেছেন বা মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন সেটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও বহাল থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত বিচারক নেই। আশা করা যাচ্ছে বিচারক এলে আলাদা বেঞ্চ করতে হবে। কারণ এটির শুনানি একসঙ্গে শুনতেই পারবেন না। তা ছাড়া একটানা শুনেও যদি শুনানি করেন, তাহলে দুই মাস সময় লেগে যেতে পারে। তবে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিলেন দুপক্ষের আইনজীবী।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, উচ্চ আদালতে না হয় বিচারক-সংকট আছে; কিন্তু নিম্ন আদালতে তো বিচারক-সংকট নেই। কিন্তু নিম্ন আদালতের মামলা আজ ১৫ বছর ধরে ট্রায়াল চলছে। এ বিষয়ে তো রাষ্ট্রপক্ষের একটি ব্যাখ্যা থাকা উচিত।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এতজন আসামির উকিল কতজন? একজন আসামিকে যদি একশজন জেরা করে, তাহলে কত সময় লাগে? সময় তো আমাদের জন্য না, সময় লাগছে তাদের জন্যই।’