![‘এক নেতা এক পদ’ নীতি ৮ বছরেও কার্যকর হয়নি](uploads/2024/02/27/1709101297.bnp.jpg)
২০১৬ সালে সর্বশেষ কাউন্সিলে ‘এক নেতার এক পদ’ এই নীতি চালুর ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। দীর্ঘ আট বছর শেষ হতে চললেও সেই নীতি এখনো দলে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। আট বছরে আশানুরূপ কোনো পদক্ষেপেও যেতে পারেনি দলটি। এক বা একাধিক পদ আঁকড়ে ধরে রেখেছেন দুজন করে স্থায়ী কমিটি সদস্য ও ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়া চেয়ারপারসনের সাতজন উপদেষ্টা, তরুণ চার নেতাসহ প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা আছেন একাধিক পদে।
দলে তৃণমূল থেকে নেতা-কর্মীরা উঠে আসতে পারছেন না বলে অভিযোগ করে একাধিক নেতা বলেন, বিএনপিতে যার আছেন- তো সব আছে, আবার যার নেই- তার কিছুই নেই। এটা শুধু পদের বেলায় প্রযোজ্য। এক নেতা একাধিক পদ আঁকড়ে রাখায় নতুন নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। সর্বোচ্চ চার পদে ধরে রেখেছেন তরুণ চার নেতা। ফলে অনেকেই পদ না পেয়ে হতাশায় ভোগেন। তাদের দাবি, বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর ‘এক নেতার এক পদ’ এই নীতি চালু করার দাবি জোরালো হয়। কিন্তু প্রায় আট বছর শেষ হতে চললেও কার্যকর নীতি চালু করেনি হাইকমান্ড।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “এই নীতি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে চলমান রয়েছে। গঠনতন্ত্রে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি এখনো সংযুক্ত করা হয়নি। রাতারাতি তো সবকিছু করা যায় না। গত ৭-৮ বছরের পারিনি বলে আগামীতে পারব না, এটা ঠিক নয়। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই নীতি কার্যকর ও দলের ভেতরের চর্চা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে বিএনপির হাইকমান্ড।”
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া প্রথম এক নেতার এক পদ নীতি চালু করেছিলেন। সেই সময়ে সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব ও আমিসহ অনেকেই পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘এখনো দুই বা একাধিক পদে অনেকেই আছেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে দলের মধ্যে হতাশা বা আক্ষেপ নেই। পদ না ছাড়লে তো আর কাউকে জোর করতে পারি না।’
আরেক ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, “দলের প্রয়োজনে হয়তো কেউ কেউ একাধিক পদ ধরে রেখেছেন। তবে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতির প্র্যাকটিস চালু রয়েছে।”
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের পরই ২ এপ্রিল প্রথম মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘বিএনপি মহাসচিব’ পদ ধরে রেখে কৃষক দলের সভাপতি ও ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। ওই সময়ে বিএনপি মহাসচিবকে অনুসরণ করে আরও বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা পদ ছেড়ে দেন। সেই সময়ে ‘পছন্দমতো’ পদ রেখে বাকি পদ ছাড়তে একাধিক নেতাকে দলের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। অনেকেই চিঠির জবাব দিলেও পদ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। আবার সিনিয়র অনেক নেতা পদ ছেড়ে দেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উদ্যোগ থাকলেও অদৃশ্য কারণে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি এখনো পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। সম্প্রতি নতুন প্রজন্মের কয়েকজন নেতাও এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন।
২০২১ সালের ৩ আগস্ট ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্যসচিব পদ পেয়ে আমিনুল হক কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সম্পাদক পদ ছেড়ে দেন। তাকে অনুসরণ করে ঢাকা মহানগর যুবদলের পদ ছেড়ে দেন দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম মজনু। কিন্তু মহানগর কমিটিতে থাকা অন্যরা এখনো একাধিক পদ ধরে রেখেছেন।
বর্তমানে স্থায়ী কমিটির দুই নীতিনির্ধারক আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও বেগম সেলিমা রহমান দুটি পদে রয়েছেন। স্থায়ী কমিটির পাশাপাশি আমীর খসরু আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এবং সেলিমা রহমান দলের নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। দলের দুজন ভাইস চেয়াম্যান একাধিক পদ আঁকড়ে রয়েছেন। ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ভাইস চেয়ারম্যান এবং পেশাজীবী পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তবে পেশাজীবী পরিষদ বিএনপি বা এর অঙ্গসংগঠনভুক্ত কোনো দল নয়। এটি বিএনপি সমর্থক একটি সংগঠন। আরেক ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীও বিএনপি সমর্থিত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের উপদেষ্টা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সাতজন উপদেষ্টা জেলা বা মহানগরের পদে রয়েছেন। এরা হলেন আব্দুস সালাম ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক, আমানউল্লাহ আমান ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার ঢাকা মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, হাবিবুর রহমান হাবিব পাবনা জেলা বিএনপির সভাপতি, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি, আবুল খায়ের ভূঁইয়া লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এবং বিজন কান্তি সরকার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আব্দুস সালাম বলেন, ‘দলের প্রয়োজনে তিনি দুই পদে আছেন। তবে দল যদি মনে করে তাহলে পদ ছেড়ে দেবেন। তাই দল প্রয়োজনে যে সিদ্ধান্ত নেবে, তাকে স্বাগত জানাব।’
কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন নরসিংদী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও মিডিয়া সেলের সদস্যসচিব, কায়সার কামাল আইনবিষয়ক সম্পাদক এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব, শামা ওবায়েদ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য, আসাদুল হাবিব দুলু রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি, কামরুজ্জামান রতন বিএনপির সমাজকল্যাণ সম্পাদক ও মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব, ফরহাদ হোসেন আজাদ পল্লি উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক ও পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্যসচিব, মো. শরিফুল আলম ময়মনসিংহ বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি, ওয়ারেস আলী মামুন সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও জামালপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক, হাজি আমিন উর রশিদ ইয়াছিন বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সম্পাদক ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা সহআন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য, হাসান জাফির তুহিন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবার কৃষক দলের সভাপতি, ইশরাক হোসেন বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য, খন্দকার আবু আশফাক ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য।
এ ছাড়া বিএনপির তিন-চারটি পদে বহাল রয়েছেন অন্তত চারজন। তারা হলেন নিপুণ রায় চৌধুরী বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ছাড়াও একই সঙ্গে ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ থানা বিএনপির সভাপতি এবং দলের নারী ও শিশু অধিকার ফোরামের সদস্যসচিব। সাংবাদিক কাদের গনি চৌধুরী দলের সহ-তথ্য গবেষণাবিষয়ক সম্পাদকের পাশাপাশি সমর্থক পেশাজীবী পরিষদের সদস্যসচিব ও বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য। শাম্মী আক্তার বিএনপির সহ-স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদকের পাশাপাশি হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, মিডিয়া সেলের সদস্য এবং বিএনপি সমর্থিত জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের সদস্য। ব্যারিস্টার মীর হেলাল বিএনপির নির্বাহী কমিটি, মিডিয়া সেল এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য।
বিএনপির চার পদে থাকা নিপুণ রায় চৌধুরী বলেন, ‘আমি একা তো নই, আরও অনেক নেতাই একাধিক পদে আছেন। দলের প্রয়োজনে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের নীতিনির্ধারকরা যখনই বলবেন, তখনই পদ ছেড়ে দেব।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল মান্নান নবীনগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি, শাহ রিয়াজুল হান্নান গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও কাপাসিয়া উপজেলার সভাপতি, শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক নির্বাহী কমিটির সদস্য ও চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি, রাজিব আহসান বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক। এদের বাইরেও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের এক ব্যক্তির একাধিক পদ আঁকড়ে রাখার নজির রয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক খবরের কাগজকে বলেন, ‘এক নেতার এক পদ’ এই নীতি এখনো বহাল আছে। কেউ কেউ হয়তো এক বা দুই পদে থাকতে পারেন। এতে দলে কোনো কার্যক্রমে ব্যাঘাত হয়নি। এই নিয়ে দলের মধ্যে কোনো হতাশা নেই। তিনি আরও বলেন, ‘এখন সবার লক্ষ্য সরকার পতন। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও সাহসের সঙ্গে রাজপথে ছিলেন। একাধিক পদের বিষয়ে হাইকমান্ডের নজর আছে।’