![বেপরোয়া পাচারকারীরা, মুক্তিপণ আদায়ে নির্মমতা](uploads/2024/04/01/1711955466.Manab-pachar.jpg)
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে মানবপাচার একটি পুরোনো ইস্যু হলেও সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়। ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়া, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে সেই ভিডিও ও ছবি পরিবারকে পাঠিয়ে বিপুল টাকা আদায় করছে মানব পাচার সিন্ডিকেট। কিন্তু বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব না হওয়ায় বেপরোয়া হয়ে পড়েছে পাচার চক্র।
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মানব পাচারের হালচাল নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের প্রতিবেদনেও মানব পাচার নির্মূল প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের অগ্রগতি নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বলছে, মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগান এবং ইরানিরা। বহু দিন ধরে এরা মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তুলেছে একটি চক্র। তারা শুরুতে কাউকে টাকা ছাড়াই, কাউকে ৪০-৫০ হাজার টাকা আবার কাউকে ২-৩ লাখ টাকার বিনিময়ে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। যারা কম টাকা দিতে চায় তাদের আকর্ষণীয় শর্ত দিয়ে বলা হয়, গন্তব্যে পৌঁছে বাকি ২-৩ লাখ টাকা কাজ করে পরিশোধ করতে হবে।
ব্র্যাকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই চক্রের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। লিবিয়া, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলের মধ্যে এবং শহর ও গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তাদের ভাড়া করা বাসা আছে, যেগুলো টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেতে আটক ব্যক্তির স্বজনদের দেশে দিতে হয় লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ। মুক্তিপণের টাকা না দিলে হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলা হবে বলে বার বার হুমকি দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. তানিয়া হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘মানুষও সচেতন না। কম টাকা দিয়ে বিদেশ যেতে পারবে এমন প্রলোভনে পড়ে তারা। তারপর অবধারিতভাবে ট্রাপে পড়ে।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মানুষই এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যান না। নির্দিষ্ট অঞ্চলের ১০-১২টি জেলার মানুষই ঘুরেফিরে এভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যান নিয়মিত। তারা ১৫-২০ লাখ টাকা দালালদের দিয়ে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় ওঠেন। আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর নাগরিকের পাশাপাশি বাংলাদেশিদেরও নৌকায় তুলছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিতে পারে।
জানতে চাইলে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাচারকারীদের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করা দরকার। এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিরও প্রশ্ন।’
মানব পাচার নির্মূলে অগ্রগতি নেই, বলছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মানব পাচারের হালচাল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। দ্য রিপোর্ট অব ট্রাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি) নামে পরিচিত ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের দেশগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। বাংলাদেশ আগের কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালেও ‘টায়ার-২’ শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। এর অর্থ হলো প্রচেষ্টা আছে কিন্তু ন্যূনতম মান অর্জন করেনি বাংলাদেশ।
মানব পাচার মোকাবিলা প্রচেষ্টায় ন্যূনতম মান অর্জনকারী দেশগুলোকে ‘টায়ার-১’ তালিকায় রাখা হয়। প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অগ্রগতি কম এবং পাচার বাড়ছে এমন দেশগুলোকে রাখা হয় ‘টায়ার-২’ নজরদারির তালিকায়। প্রচেষ্টা কম, অগ্রগতিও নেই এমন দেশগুলোকে রাখা হয় ‘টায়ার-৩’ তালিকায়।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৩ সালের ওই প্রতিবেদনে মানব পাচার মোকাবিলা ও ভুক্তভোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগকারী, শ্রম পরিদর্শক, অভিবাসন কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুপারিশ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “বাংলাদেশ মানব পাচার মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের টিআইপি প্রতিবেদনে টানা কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের ‘টায়ার-২’ মর্যাদা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অধীনে সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার কার্যকারিতার সাক্ষ্য দেয়।”
ছয় হাজার মামলা, এক শতাংশেরও কম মামলায় সাজা
মানব পাচার প্রতিরোধে সরকার ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন করে। এই আইনে ২০১২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬ হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দেখা গেছে, ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ পাচারের শিকার। এতে মোট আসামির সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার।
এসব মামলার প্রায় সব কটিই বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। সাজা হয়েছে এক শতাংশেরও কম মামলায়। তবে সেই সাজাও দৃষ্টান্তমূলক হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, বাংলাদেশের আদালত বেশির ভাগ পাচারকারীর কারাদণ্ডের পরিবর্তে জরিমানা করেন। এটি মানব পাচার প্রতিরোধকে দুর্বল করে এবং পাচারের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নিরাপত্তার উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
পাচারের শিকার হওয়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। নিয়মিতই বিমানবন্দর দিয়ে লিবিয়া থেকে নিঃস্ব বাংলাদেশিরা দেশে ফিরছেন। বিমানবন্দরে নামলে তাদের আইওএমের পক্ষ থেকে ছয় হাজার টাকা দেওয়া হয় হাতখরচের জন্য।
এ প্রসঙ্গে আইওএম বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ফাতিমা নুসরাত গাজ্জালী বলেন, ‘মানব পাচার মোকাবিলায় মানবাধিকার এবং সব মানুষের মৌলিক স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষার ভিত্তিতে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা দরকার। আমাদের প্রচার প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করতে হবে এবং প্রতিটি ভুক্তভোগীর জন্য আমাদের সাপোর্ট বাড়াতে হবে।’
> মানুষও সচেতন না
> সমুদ্রপথে মনোযোগ দেওয়া জরুরি
> কঠিন সাজা হওয়া উচিত