চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে নান্দনিক, ছায়াঘেরা ও ব্রিটিশ আমলে নির্মিত টাইগারপাস থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত সড়কটির নাম ইউসুফ চৌধুরী সড়ক। পাহাড়ের বুক চিরে চলে যাওয়া সড়কটি নামের চেয়ে গাছের জন্য বেশি পরিচিত। এর প্রশস্ত ওপরের লেন থেকে নিচের লেন বেশ নিচুতে বলে এটিকে দ্বিতল সড়কও বলে থাকেন কেউ কেউ।
টাইগারপাসের মুখ থেকে কদমতলী মোড় পর্যন্ত সড়কটির বিভাজক ও দুই ধারে আছে সারি সারি কয়েক শ বড় গাছ। এসব গাছের বয়স শতবছরের ওপর। আছে হাজারও পাখ-পাখালির বাসা। তা ছাড়া সড়কের এক পাশে উঁচু ঘন পাহাড়। সব মিলিয়ে বলা চলে শহরের আইকনিক সড়ক এটি। অথচ এ সড়কটিরই শতবর্ষী গাছগুলো কেটে র্যাম্প স্থাপন করতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ইতোমধ্যে ৪৬টি গাছের গায়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্রস চিহ্ন।
এদিকে এ ঘটনাকে সিডিএর কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ বলে অ্যাখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু করেছেন পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকরা। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।
জানা যায়, চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলেও শেষ হয়নি বিভিন্ন স্থানে র্যাম্প নির্মাণের কাজ। এরই মধ্যে একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে নকশা। এবার টাইগারপাস সড়কে র্যাম্প নির্মাণ করতে চায় সিডিএ। এ জন্য ৪৬ গাছ ও পাহাড়ের ঢালু অংশ কাটতে চায় সংস্থাটি। এতে গাছ ও পাহড়ের মারাত্মক ক্ষতি হবে। একই সঙ্গে শহরে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়েরও আশঙ্কা রয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের বন্দর এলাকার সঙ্গে রেলওয়ের সিআরবি ও পলোগ্রাউন্ড মাঠের সংযোগ স্থাপনে পাহাড়ের ঢালে টাইগারপাস সড়ক নির্মাণ করা হয়। এ সড়কের বিভাজক হিসেবে রাখা হয়েছে পাহাড়ের ঢাল। সড়ক বিভাজকের দুই পাশে রিটার্নিং ওয়াল ছাড়াও লাগানো হয়েছে কয়েক শ ছোট-বড় গাছ। এসব গাছের বেশির ভাগই বড় বড় ঢালপালা, কাণ্ড ছড়িয়ে সড়ককে করে তুলেছে নান্দনিক। বেশ কিছু গাছের বয়স ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। গাছে গাছে নানা রকম পাখির বাসা চোখে পড়ে।
সিডিএ সূত্রে জানা যায়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র্যাম্প নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সিডিএ। এ জন্য রেলওয়ের কাছ থেকে পূর্ব অনুমতি নেওয়া হয়নি। তবে র্যাম্প নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ ও সয়েল টেস্ট করা হয়েছে। এখন ৪৬টি গাছ কাটতে রেলওয়ের কাছে অনুমতি চাওয়া হচ্ছে। প্রায় এক মাস আগে বন বিভাগের কাছে গাছ কাটার অনুমতি চেয়েছে সিডিএ। টাইগারপাস থেকে একটি র্যাম্প সড়কটিতে তৈরি করলে নিউ মার্কেটের সঙ্গে শেখ মুজিব রোডের সংযোগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপককে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে আগ্রাবাদ ও টাইগারপাস এলাকায় দুটি র্যাম্প নির্মাণে ৩৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ ভূমি ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয়। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা থেকে বিমানবন্দরমুখী আপওয়ার্ড র্যাম্প নির্মাণে ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও রেলওয়ের পলোগ্রাউন্ড বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় সড়ক থেকে দেওয়ানহাটমুখী আপওয়ার্ড র্যাম্প নির্মাণে ১৪ শতাংশ ভূমি ব্যবহারের কথা বলা হয়।
বেসরকারি সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়ন (ইকো) ২০২১ সালে সিআরবি এলাকার জীববৈচিত্র্য নিয়ে জরিপ করে। জরিপে ২২৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বড় বৃক্ষ ৮৮ প্রজাতির, গুল্ম ৪১ প্রজাতির, বীরুৎ ৭২ প্রজাতি ও লতাজাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে ২২ প্রজাতির। ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া গেছে ১৮৩ প্রজাতির। গবেষণাধীন ২০টি এলাকার মধ্যে এ এলাকায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ৯টি বিপন্ন প্রজাতি রেকর্ড করা হয়েছে। সিআরবি পাহাড়ে দ্বিতল এ সড়ক বিভাজকে শিরীষ, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, পেয়ারা, ইউক্যালিপটাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। পাহাড়ি এ সড়কের ওপরের অংশের ধস প্রতিরোধে এ গাছগুলো রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী খবরে কাগজকে বলেন, ‘আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিবেশের সংঘর্ষ একটি শ্রেণি সব সময় লাগিয়ে রেখেছে। সারা পৃথিবীতে পাহাড় ও গাছ অক্ষুণ্ন রেখে উন্নয়ন করে। কিন্তু বাংলাদেশে উন্নয়ন মানেই গাছ কাটো। টাইগারপাস সড়কে রেইন ট্রি, মেহগনি, শিরীষ, বাদামসহ বহু প্রজাতির গাছ আছে। একটি না দুটি ১৪২টি গাছ আছে বড় আকারের শুধু রেলওয়ে স্কুল পর্যন্ত। অথচ এই গাছগুলো কেটে নাকি উন্নয়নব করা হবে। এই উন্নয়ন কি আদৌ দরকার। তিনি আরও বলেন, ছয় কিলোমিটার একটি রাস্তা করতে গিয়ে তারা ১৮টি পাহাড় কেটেছে। সেই সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কি মূর্খ নাকি জংলি। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর কেউ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে নষ্ট করে উন্নয়ন করে না। এই চট্টগ্রাম শহর ত্রিমাত্রিক শহর। এখানে নদী আছে, সাগর আছে এবং পাহাড় আছে। ঐতিহ্য ও ইতিহাস আছে। গৌরব আছে। সেসব ধ্বংস করে দিয়ে এই উন্নয়ন আমরা চাই না। এটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এই অর্বাচীন, মূর্খদের যেকোনো মূল্যে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করতে হবে।’
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই গাছগুলো কাটা হবে বৃক্ষ হত্যার শামিল। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে এই কাজ করতে দেওয়া যাবে না। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আইনি দায়িত্ব হচ্ছে চট্টগ্রামের উন্নয়ন অর্থাৎ চট্টগ্রামের পরিবেশের উন্নয়ন। তারা যদি পরিবেশের উন্নয়নকে বাদ দিয়ে কেবল অবকাঠমো উন্নয়নকে তাদের আইনি দায়িত্ব মনে করে, তাহলে তারা ভুল ধারণার মধ্যে আছে। আমরা অবশ্যই বন বিভাগকে চিঠি দেব এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে জানাব যেন কোনোভাবেই এই গাছগুলো কাটা না হয়। সিডিএ এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে আমরা আইনগত পদক্ষেপ নেব।’
এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস খবরের কাগজকে বলেন, প্রকৃতি রক্ষা করেই র্যাম্প নির্মাণ করা হবে। এ জন্য আগামীকাল (আজ) ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাবে এক দল বিশেষজ্ঞ টিম। এ টিমের প্রতিবেদন মতে পরবর্তী কাজ করা হবে। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, শতবর্ষী কোনো গাছ কাটা হবে না। বড় গাছ অক্ষুণ্ন রেখেই র্যাম্প নির্মাণ করা হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান একই কথা খবরের কাগজকে বলেন, ‘র্যাম্প নির্মাণ করতে হলে তো অবশ্যই গাছ কাটতে হবে। গাছ না কেটে তো উপায় নেই। তবে আমরা শতবর্ষী কোনো গাছ কাটব না। ছোট ও মাঝারি ৪৬টি গাছ কাটা হবে। আমাদের যা যা করার আমরা করব। এখনো আমরা গাছ কাটা শুরু করিনি। তবে র্যাম্প করতে হলে গাছ কাটতে হবে।’