![অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: স্বস্তি সঙ্গে আছে শঙ্কাও](uploads/2024/04/02/1712042176.Economic-report.jpg)
অর্থনৈতিক সংকট আপাতত কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। অনেক সূচকই আরও দুর্বল হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎসংকট বেড়েছে। গ্যাসের অভাবে শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। সরকারি আয়ের অন্যতম বড় উৎস রাজস্ব আহরণে বিশাল ঘাটতি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক উদ্যোগ নেওয়ার পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি মূল্যস্ফীতি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও স্বস্তি মিলছে না। কমেনি ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ।
দেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আশার বাণী শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। গত রবিবার ঢাকায় অর্থনীতি বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের সঙ্গে সচিবালয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনায় তিনি বলেছেন, অর্থনীতিতে কোনো সংকট নেই। পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেটে গেছে। এর পেছনে দুটি স্বস্তির কথা শুনিয়েছেন তিনি। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্সের শক্তিশালী অবস্থান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে স্বস্তি এবং শঙ্কা দুটোই রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে সংকট এখনো কাটেনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কমেনি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। নতুন বিনিয়োগ নেই। কমে গেছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ।
এই কঠিন সময়ে স্বস্তির জায়গাটা হচ্ছে, মন্দার কবলে পড়েনি অর্থনীতি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়নি। তবে সুখবর হচ্ছে, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স আয় খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি। যার ফলে রিজার্ভ কিছুটা সহজলভ্য হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাড়াতে ডলারের প্রাপ্যতা কিছুটা সহজ হয়েছে। এর ফলে লেনদেনের ভারসাম্যে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন,‘আমি তো অস্বস্তির জায়গাটাই বেশি দেখছি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন। বিনিময় হারে অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি,ব্যাংক খাতে অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণ, এ গুলো গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ অর্থনীতির সামনে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে না এলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে না। সেটা না হলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হবে না।’
স্বস্তির জায়গা কোথায়- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বস্তি এইটুকু যে, অর্থনীতি মন্দার কবলে পড়েনি। প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়নি। তবে আমাদের যে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি, সেটা এবার হবে না।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অবশ্য, সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় সাড়ে ৬ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবার বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হবে না।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে বলেন, অর্থবছর শেষে যদি তাই হয়, তাহলে সেটি হবে সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে কম অর্জন।
সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের কোনো বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি মনে করি বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত রপ্তানি আয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে। শুধু পোশাক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে আরও জোর দিতে হবে। রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) বাড়াতে নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন হবে, যদি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা না বাড়ানো হয়।’
অর্থবছর যখন শুরু হয়, তখন রপ্তানি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল সরকার। মূলত চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়ায়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মার্চের তথ্য প্রকাশিত হয়নি এখনো। তবে রপ্তানিকারকরা বলেছেন, মার্চ মাসেও ইতিবাচক ধারায় থাকবে প্রবৃদ্ধি। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আট মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ৭০৮ কোটি ডলার।
সবচেয়ে ভালো প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্সপ্রবাহে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে এসেছে প্রায় ২১৭ কোটি ডলার। তবে মার্চে কিছু কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় যে বাড়ছে, এটা আমাদের জন্য সুখবর। এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে যে চাপ রয়েছে, তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে। ড. আজিজুল ইসলাম বলেন, যে ভাবেই হোক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
রিজার্ভসংকট মোকাবিলায় আমদানি কঠোর করেছে সরকার। ফলে গত অর্থবছর অক্টোবরে আমদানি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। এর পর থেকে চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) নভেম্বর পর্যন্ত টানা ১৪ মাস ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি চলছে আমদানিতে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে আমদানি কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী জুলাই-জানুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ।
অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। নীতি-সুদ হার বাড়িয়েও এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা কমেছে। মার্চের রিপোর্টে তেমন সুখবর আসবে না বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাই বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ এটি। কারণ, প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার দীর্ঘসময় ধরে চলে আসছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এটাকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। টাকার বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু রিজার্ভসংকট পুরোপুরি কাটেনি বলে জানান তিনি।
তার মতে, আরেকটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, কম রাজস্ব আহরণ। রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। কারণ ঘাটতি বেড়ে গেছে। এনবিআরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা।
ড. জায়েদ বখত আরও বলেন, আমরা এখনো স্বস্তির জায়গায় যেতে পারিনি। কারণ, রেমিট্যান্স এক মাস বাড়লে পরের মাসে কমে যায়। আর রপ্তানি আয়ে মোটামুটি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি আছে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স যাতে আরও বেশি আসে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ২৭ মার্চ পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে যা ছিল ৪০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশে রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ। এর আগের বছর ছিল ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, অর্থনীতিতে এখনো বড় রকমের শঙ্কা এবং স্বস্তি দুটোই আছে। তবে তুলনামূলক বড় চ্যালেঞ্জ বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের জায়গায়। সেই লেনদেনের ভারসাম্যের বড় সূচক হলো ডলারের প্রাপ্যতা এবং টাকার বিনিময় হার। সম্প্রতি ডলারের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। ফলে লেনদেনের ভারসাম্যে ইঙ্গিতপূর্ণ ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তবে এটি দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হবে কি না, সেটা নির্ভর করবে আগামী দিনের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর। এর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য কমবে কি না, ডলারের চাহিদা সীমিত রাখা যাবে কি না, এবং সামগ্রিকভাবে সরকারি ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণ আগামীতে কঠোরভাবে বজায় রাখা সম্ভব হবে কি না। এসবের ওপর নির্ভর করবে অর্থনীতির অবস্থা।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, স্বস্তির জায়গাটা হচ্ছে: বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। আগে এলসি খোলার ক্ষেত্রে যেভাবে ডলারের জন্য হাহাকার ছিল, এখন সেটি কমেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা বজায় থাকায় ডলার কিছুটা সহজলভ্য হয়েছে। তিনি মনে করেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সীমিত রেখে, সরকারি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে পারলে সামষ্টিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।