![ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসছে বিএনপি!](uploads/2024/04/19/1713508942.BNP_India.jpg)
দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও ভারতবিরোধী অবস্থান বিএনপি দলগতভাবে আর জোরালো করবে না। বরং বৃহৎ প্রতিবেশী এই দেশটি সম্পর্কে বিএনপি আপাতত নীরব থাকার কৌশল নিয়েছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ভারতবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সায় মেলেনি। এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও কোনো নির্দেশনা নেই। সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতা ‘ভারত ইস্যু’তে তার সঙ্গে কথা বলেছেন; বুঝিয়েছেন, এমন খবর পাওয়া গেছে। এরপর গত দুই সপ্তায় ভারতের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতাদের কথাবার্তা থেমে গেছে।
তবে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন, সেটি দলের নেতা-কর্মীদের মনোভাব ও শীর্ষ নেতৃত্বের ইঙ্গিতেই হয়েছে বলে বিএনপির অধিকাংশ সিনিয়র নেতা বিশ্বাস করেন। তাদের মতে, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও এর সমর্থক দলগুলোর ভেতরে-বাইরে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে; যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রিজভীর ভূমিকায়। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যেও এর কিছুটা প্রকাশ দেখা গেছে। নির্বাচনের পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানী ঢাকায় এক কর্মসূচিতে বিএনপি নেতা ড. আবদুল মঈন খান বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ কেন বাড়ছে, তা খুঁজে দেখার জন্য ভারতের নীতিনির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানান। প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আজকে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রকে এমন একটা পারস্পরিক অবিশ্বাসের দোলাচলে কেন এই সরকার নিয়ে যাচ্ছে?’
গত ২০ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলমান ভারতের পণ্য বর্জনের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানান এবং ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ দেখান। ওই দিন নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে নিজের গায়ের কাশ্মীরি শাল ছুড়ে ফেলে দিলে নেতা-কর্মীরা তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এর পর থেকেই বিএনপির ভারতবিরোধী অবস্থানের বিষয়টি আলোচনায় আসে। বিএনপির পাশাপাশি সমমনা দলগুলোর নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেও ভারত-বিরোধিতার বিষয়টি উঠে আসে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, এমনকি ভারতের কোনো কোনো থিংক ট্যাংক সদস্যও এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
এমন পরিস্থিতিতে গত ২৫ মার্চ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচিত হয়। তবে ওই বৈঠকে ভারত প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরবর্তী বৈঠকে ওই ইস্যুতে আলোচনার কথা থাকলেও এ প্রসঙ্গে আর কোনো আলোচনা ওঠেনি। দলটির নীতিনির্ধারক একাধিক নেতা খবরের কাগজকে নিশ্চিত করেন, এসব ইস্যু আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বিষয় নয়। আবার ভবিষ্যতে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। পাশাপাশি রুহুল কবির রিজভীও এ বিষয়ে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। তবে রিজভী খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনের ওই সামাজিক আন্দোলন হয়তো চলবে। এ বিষয়ে বিএনপি হস্তক্ষেপ করবে না।
ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপি সরে এসেছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. আবদুল মঈন খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপি কখন ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল, সেটি আমার জানা নেই। হতে পারে অনেকেই এ রকম মনে করেন। তবে ভারত বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ বাংলাদেশের এই পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতেই বিএনপি কাজ করে থাকে। ভারতের কোনো ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের জনগণ যদি ভারতবিরোধী হয়ে যায়, সেটি বিএনপির বিষয় নয়। ভারতের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি বিশ্লেষণ করে হয়তো দেখতে হবে যে বন্ধুত্ব দুটি দেশের জনগণের মধ্যে কাম্য। দুটি সরকারের মধ্যে নয়।’
‘মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এভাবেও বলা যায় যে বাংলাদেশের জনগণের আপাতদৃষ্টির ভারতবিদ্বেষ আসলে এ দেশের মানুষের বর্তমান সরকারবিদ্বেষেরই বহিঃপ্রকাশ’ যোগ করেন ড. খান।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি জানানোর বিষয়ে রিজভী নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে এটি তার ব্যক্তিগত সমর্থন, দলের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়- শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত এই পররাষ্ট্রনীতিই বিএনপি মেনে চলে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) রুহুল কবির রিজভী খবরের কাগজকে আরও বলেন, ‘ভারতের পণ্য বর্জন বিষয়টি একটি সামাজিক আন্দোলন। আমার মনে হয়েছে, এই আন্দোলন তারা সঠিক কারণে করেছে। কারণ ভারত এ দেশের মানুষকে পছন্দ করে না। তারা একটি দলকে পছন্দ করে। এ জন্য তারা ভারতের পণ্য কিনবে না।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিএনপির অনেকেই এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। আমিও ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করেছি। এখানে দলের কোনো বিষয় নেই।’
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এমন আভাস দিয়েছিলেন যে বিএনপিতে ভারত-বিরোধিতা বাড়তে পারে। কারণ গত চারটি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশে ভারত ছিল বলে মনে করে বিএনপি। দলটি এ জন্য প্রতিটি নির্বাচনের আগেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়েছে। ২০১৮ সালের জুনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভারত সফর করেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে ওই সফর শেষে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকার দেন হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, ‘পেছনে ফিরে তাকানোর পরিবর্তে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। আশি ও নব্বইয়ের দশকের রাজনীতি এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’ তারেক রহমানের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির আরও বলেন, ‘তারেক রহমান চান আমরা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হই। এখন উভয় দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীই আমাদের প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়।’ দ্য হিন্দুর ওই সাক্ষাৎকারে বিএনপি সরকারের বিগত আমলগুলোতে ভারত ও বাংলাদেশের খারাপ সম্পর্কের নীতিকে ‘ভুল ও বোকামি’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন হুমায়ুন কবির।
ওই সফরের বাইরেও গত ১৫ বছরে নানাভাবে ভারতের মন গলানোর চেষ্টা করে বিএনপি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ জামায়াতে ইসলামী নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর বিএনপির নীরবতা, প্রায় এক যুগ ধরে জামায়াতের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক তৈরি, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ২০-দলীয় জোটের বাইরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন, হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি গাঁটছড়া না বাঁধা; এসবই ভারতকে খুশি করার জন্য করা হয়েছে বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে। ২০১৭ সালের ১০ মে বিএনপির ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’ রূপকল্পে অন্য কোনো রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি না করা এবং কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকারও করা হয়েছিল মূলত ভারতকে খুশি করার জন্য। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ধরা পড়া ১০ ট্রাক অস্ত্রই ভারতের সঙ্গে আজ পর্যন্ত বিএনপির শীতল সম্পর্কের মূল কারণ। সমালোচনা আছে, ধরা না পড়লে ওই অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে যেত, যা দেশটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করা হয়।
কংগ্রেস সরকারের আমলে সংঘটিত ওই ঘটনার পর বিএনপি মনে করেছে, দিল্লিতে ক্ষমতার বদল হলে বাংলাদেশ প্রশ্নেও ভারতের মনোভাবে পরিবর্তন আসবে। এ লক্ষ্যে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির পক্ষ থেকে ভারতের নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেক ধরনের রাজনৈতিক ‘বার্তা’ পাঠানো হয়। চেষ্টা করা হয় সম্পর্কোন্নয়নের। দিল্লির ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে দেশে-বিদেশে বেশ কিছু বৈঠকের খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু মোদি ক্ষমতায় আসার পর ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ (প্রতিবেশীরা সবার আগে) পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করে বুঝিয়ে দেন কংগ্রেস জমানার বাংলাদেশ নীতিতে তিনি কোনো পরিবর্তন তো আনবেনই না; বরং ঘরের পাশে এই বন্ধুদেশটি তার সরকারের কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও অতিদ্রুত তার একধরনের ‘পারসোনাল কেমিস্ট্রি’ বা ব্যক্তিগত রসায়ন তৈরি হয়। অনেকের মতে, মোদি-হাসিনার ওই কেমিস্ট্রি আজ পর্যন্ত বহাল আছে। ফলে বিএনপির বড় অংশই এখন মনে করা শুরু করেছেন যে, বিএনপিকে ভারত কখনোই আস্থায় নেবে না। সর্বশেষ নির্বাচনের পর বিএনপিতে এমন মনোভাবই জোরালো হয়েছে।
তবে সূত্রের দাবি, নির্বাচনের পর ওই ক্ষোভ থেকেই দলের কেউ কেউ রিজভীকে নির্দেশনা দিলেও এখন আস্তে আস্তে পাল্টা মত তৈরি হচ্ছে। রিজভীর ক্ষোভ প্রকাশের চার দিন পরই বিএনপির ইফতার পার্টিতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ঢাকাস্থ ভারতীয় কূটনীতিকরা অংশ নেন। অনেকেই বলছেন, বিএনপি যেহেতু ক্ষমতায় যাওয়ার পার্টি, সেহেতু ভারতের মতো বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক রাখাই ভালো। ভারতের পণ্য বর্জনের আন্দোলন আদৌ কোনো ফল বয়ে আনবে কি না, তা নিয়েও অনেকের সংশয় রয়েছে। কারণ বাংলাদেশে চীনের পর ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে, যা মোট আমদানির প্রায় ২০ শতাংশ। এর মধ্যে পেঁয়াজের মতো জরুরি অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরতা রয়েছে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের।
বিএনপির মধ্যে ভারতপন্থি বলে পরিচিত স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রতিবেশীকে তো বদল করা যাবে না। তা ছাড়া ভারত এখন সুপার পাওয়ার। যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত তাদের সমীহ করে চলে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির সঙ্গে বৈরিতা করে লাভ নেই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির আরেকজন সদস্য বলেন, বিএনপি ভারতের ভূমিকার সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কিছু অর্জন করা যাবে না। তার মতে, ভারত আজ বিএনপিকে সমর্থন করছে না। কিন্তু আগামীকাল যে করবে না, তার নিশ্চয়তা কী?