![সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ছে](uploads/2024/04/23/1713863893.social-seafty.jpg)
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে অন্যান্য খাতের ভাতাও। সামাজিক নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় দুটি কর্মসূচি হচ্ছে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা। অর্থ ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন (২০২৪-২৫) বাজেটে এই দুটি কর্মসূচির আওতা আরও বাড়ছে। কিন্তু ভাতার অঙ্ক অপরিবর্তিত থাকছে।
দেশে এখন ৫৮ লাখ ১ হাজার সুবিধাভোগী আছেন, যারা ৬০০ টাকা করে নগদ মাসিক বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। সূত্র জানায়, আগামী বাজেটে ‘বাড়তি’ দুই লাখকে এর আওতায় আনা হচ্ছে। ফলে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬০ লাখ ১ হাজার।
অন্যদিকে বর্তমানে বিধবা ভাতা পাচ্ছেন ২৫ লাখ ৭৫ হাজার জন। এর সঙ্গে আরও দুই লাখ নতুন করে যুক্ত হবেন। ফলে মোট বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার। অর্থাৎ আগামী বাজেটে বয়স্ক ও বিধবা ভাতার তালিকায় নতুন করে যোগ হচ্ছেন চার লাখ। মাসিক ভাতার অঙ্ক ৬০০ টাকা অপরিবর্তিত থাকছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, আগামী বাজেটে ব্যয় সংকোচন নীতি অনুসরণ করছে সরকার। সে জন্য নগদ ভাতা বাড়ানো হয়নি। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, বেশিসংখ্যক যোগ্য মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।
বর্তমানে ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়স্ক দুস্থ ভাতা পাচ্ছেন। পক্ষান্তরে নারীদের ক্ষেত্রে ৬২ বা তদূর্ধ্ব হলে ভাতা পান। এখন ২৬২ উপজেলায় বয়স্ক ও বিধবা ভাতা চালু রয়েছে। চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। আসন্ন বাজেটে বর্তমান ভাতার চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পর্যালোচনা করে দেখেছেন, সব উপজেলার ভাগাযোগ্য সবাইকে এসব কর্মসূচির আওতায় আনতে হলে আরও আট লাখকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সূত্র বলেছে, বাকিদের পর্যায়ক্রমে আওতায় নিয়ে আসা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রতিবন্ধীদের আরও সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ২০ লাখ প্রতিবন্ধী ৮৫০ টাকা করে নিয়মিত মাসিক ভাতা পান। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন ৩ লাখ ৩৪ হাজার। ফলে মোট ২৩ লাখের বেশি প্রতিবন্ধী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আসছেন। তবে ভাতা অপরিবর্তিত থাকছে।
‘দরিদ্র মা ও শিশুদের সহায়তা’ কর্মসূচির আওতা বাড়ছে। এ কর্মসূচির আওতায় এখন আছেন ১৩ লাখ জন। নতুন করে আরও যুক্ত হচ্ছেন ৬০ হাজার।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বর্তমানে আট ধরনের কর্মসূচি রয়েছে, যার মাধ্যমে নিয়মিত মাসিক নগদ ভাতা দেওয়া হয়। এ ছাড়া খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয় ১১টি কর্মসূচিতে। অন্যান্যের মধ্যে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তথা জেলে, বেদে, হিজড়া সম্প্রদায়, চা-শ্রমিকদেরও নগদ ভাতা দেওয়া হয়। এ ছাড়া দুস্থ নারীদের জন্য চালু আছে মাতৃত্বকালীন ভাতা।
মুক্তিযোদ্ধাদেরও মাসিক ভাতা দেয় সরকার। এ ছাড়া ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোক ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত গরিবদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। বর্তমানে ৩০ হাজার গরিব রোগী এককালীন ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা পান। আসন্ন বাজেটে সুবিধাভোগীর সংখ্যা আরও ২০ হাজার বাড়ানো হচ্ছে।
বয়স্ক, বিধবাসহ বর্তমানে সারা দেশে মোট ১ কোটি ৩৯ লাখের বেশি উপকারভোগী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় মাসিক ভাতা পাচ্ছেন। আসন্ন বাজেটে আরও আট লাখকে নতুন করে যুক্ত করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে বছরে ব্যয় হয় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে আট লাখ সরকারি চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা পান।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, মাসিক ভাতার বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা দিচ্ছে সরকার। বর্তমানে সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ-দুর্যোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ ৩০টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ১২৩টি কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন।
পেনশন সুবিধাকেও একধরনের সামাজিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এটি নিয়ে প্রশ্নও আছে। বর্তমানে আট লাখ সরকারি চাকরিজীবী পেনশন সুবিধা পান। আবার রেশনব্যবস্থা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, জেনারেল রিলিফ, শিক্ষাবৃত্তি, কম দামে গরিবকে চাল বিতরণ, ভিজিডি, ভিজিএফ ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে টার্গেট গ্রুপকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেটে মোট ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষায় মোট ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় তা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির আড়াই শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করে। তখন ভাতা ছিল ১০০ টাকা। পরে ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হয়।
সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, অসমতা ও দারিদ্র্য দূর করতে সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়াতেই হবে। এই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। এখনো জিডিপির ২ শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এটি অন্তত ৩-৪ শতাংশে উন্নীত করা উচিত।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচের দিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ার নিচের দিককার পাঁচটি দেশের একটি। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ভুটান ও লাওস। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম।
এশিয়ার ২৫টি দেশের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম নিয়ে ‘দ্য সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন্ডিকেটর ফর এশিয়া: অ্যাসেসিং প্রোগ্রেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে গত বছর এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশে নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি সুরক্ষা পান। আবার সামাজিক সুরক্ষার জন্য গরিব মানুষের পেছনে যতটা খরচ হয়, এর চার গুণ বেশি খরচ হয় ধনীদের পেছনে।
মুক্তিযোদ্ধা ও অশীতিপরদের ভাতা বাড়তে পারে
আগামী বাজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী ভাতা বাড়তে পারে। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবার মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। এটি বেড়ে ২৫ কিংবা ৩০ হাজার টাকা করা হতে পারে। বর্তমানে ২ লাখ মুত্তিযোদ্ধা মাসিক সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন। চলতি অর্থবছরে এর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাব কার্যকর করা হলে ‘বাড়তি’ বরাদ্দ দিতে হবে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, আওতা না বাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ২০ হাজার টাকা করা হয়। এর আগে ছিল ১২ হাজার টাকা। অশীতিপরদের ভাতা বাড়তে পারে। বর্তমানে তারা পান ৬০০ টাকা। এটি বেড়ে ৯০০ টাকা করা হতে পারে।