![স্বাস্থ্য বাজেট : খরচে ব্যর্থতা বাড়ছে](uploads/2024/05/16/Budget-1715876103.jpg)
নতুন অর্থবছর সামনে রেখে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বাজেট নিয়ে আবারও আলোচনা জোরালো হয়ে উঠেছে। বাজেট কমবে কী বাড়বে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই খাতে, যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তা খরচ করতে না পারার বিষয়টি। স্বাস্থ্য অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা প্রতিবছরই অব্যয়িত অর্থ ফেরত দেওয়াকে এই খাতের বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, একদিকে যখন স্বাস্থ্য খাতের সংকটের কথা বলা হয়, তখনই অজুহাত আসে পর্যাপ্ত বাজেট না পাওয়ার। অন্যদিকে যে পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়, সেটাও যদি খরচ করতে না পারে দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে তখন সেটা সহজে মানা যায় না।
সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট স্বাস্থ্য খাতের অর্থ বরাদ্দ ও খরচ নিয়ে যৌথভাবে এক গবেষণা পরিচালনা করে। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে পর্যন্ত অর্থ বরাদ্দ ও খরচের খাতওয়ারি চিত্র তুলে ধরা হয়। যেখানে দেখা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বরাদ্দ করা অর্থ খরচ করতে পারেনি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, যা মোট জাতীয় বাজেটের ৫ শতাংশ। যদিও সংশোধিত বাজেটে কিছুটা কমে যায়। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কাজ করা অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য বাজেট নিয়ে কেবল বরাদ্দ আর খরচের টানাপোড়েনে থাকলেই হবে না। এর ঊর্ধ্বে উঠে আরও বড় আঙ্গিকে কাজ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ক্ষেত্রবিশেষে সংস্কার দরকার। তবে এটা ঠিক যে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট কম। এটা অবশ্যই বাড়ানো দরকার। আর যেটা বরাদ্দ হয়, সেটাও খরচ করতে না পারা ব্যর্থতার শামিল।
ড. হোসেন জিল্লুর বলেন, খরচ করতে না পারার পেছনে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো হচ্ছে কারিগরি সক্ষমতার অভাব, পদ্ধতিগত সক্ষমতার অভাব ও লক্ষ্য নির্ধারণে নীতিগত সক্ষমতার অভাব। বিশেষ করে পদ্ধতির জায়গায় বলব, স্বাস্থ্য খাতে এখনো বিকেন্দ্রীকরণ হয় না। মাঠ পর্যায়ে স্থাপনা থাকলেও স্থানীয় ব্যবস্থাপকদের অনেক কিছুর জন্যই চেয়ে থাকতে হয় কেন্দ্রের দিকে। জরুরি অনেক কাজ স্থানীয় ব্যবস্থাপকরা করতে পারেন না, তাদের সেই স্বাধীনতা নেই। ফলে অনেক সেবা বন্ধ থাকে।
অন্যদিকে মন্ত্রণালয় থেকে অনেক পর্যায়েই সমন্বয়হীনতা রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে অনেক কাজ ঠিকমতো হয় না। এর প্রভাব অবশ্যই বাজেটের ওপর পড়ে, খরচের ওপর পড়ে। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা খুব বড় একটা সমস্যা তৈরি করে স্বাস্থ্য খাতের জন্য।
গবেষণার ফলাফলের রেখাচিত্রে ২০১০-২০১১ অর্থবছর থেকে গত অর্থবছর পর্যন্ত তুলনামূলক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। যেখানে মোট স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দের তুলনায় খরচের হার, উন্নয়ন খাতের খরচের হার ও সেবা খাতের খরচের হার দেখা হয়েছে। এতে কখনোই খরচের রেখা শতভাগ ছুঁতে পারেনি। বরং ২০১২ থেকে খরচ নেমে যায় আরও নিচে। ২০১৯-২০২০ থেকে ৮০-৯০ শতাংশে ওঠানামা করছে খরচের রেখা। আরেক চিত্রে দেখানো হয়েছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ২০১৭-১৮ বছরে খরচ হয় বরাদ্দের ৮৬.৯০ শতাংশ, ২০১৮-১৯ বছরে খরচ হয় একটু বেড়ে ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ, ২০১৯-২০ বছরে খরচ কমে নেমে যায় ৭৪ দশমিক ১৫ শতাংশে । ২০২০-২১ বছর ওঠে ৭৭ দশমিক ৪৫ শতাংশে। পরে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ বছরেও খরচ বরাদ্দের তুলনায় ৮০ শতাংশের নিচে ছিল।
অন্যদিকে শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ শাখায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দের মধ্যে খরচ হয় ৮২ দশমিক ৩০ শতাংশ, ২০১৯-২০ বছরে ৮০ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ২০২০-২১ বছরে ৭৪ দশমিক ৭১ শতাংশ খরচ হয়েছে। পরের দুই বছরও ৮০ শতাংশের মধ্যেই ছিল খরচ, যা সেবা খাতের চেয়েও কম।
বিশেষজ্ঞরা জানান, চলতি অর্থবছরে আগের তুলনায় খরচ কিছুটা বেশি করা হয়েছে। কারণ এ বছর স্বাস্থ্য খাতের পঞ্চবার্ষিকীর শেষ বছর। ফলে গত পাঁচ বছরে যে কাজগুলো আটকে ছিল, তা এই মেয়াদের মধ্যে শেষ করা না গেলে নতুন পঞ্চবার্ষিকের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ খবরের কাগজকে বলেন, জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ এখনো কম। এটা বাড়ানো জরুরি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের ব্যবস্থাপকরা খরচ করতে পারেন না। এটা বড়ই দুঃখজনক। এটা যেমন সক্ষমতার অভাব তেমনি ব্যর্থতাও। এখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে স্বাস্থ্য খাতের কার্যকর কোনো উন্নতি ঘটবে না।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘খরচ করতে না পারার কারণগুলোর মধ্যে আমরা দেখেছি পদ্ধতিগত অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে প্রয়োজনমতো টাকা ছাড় করতে দেরি হয় নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। কেনাকাটাতেও সমস্যা রয়েছে। অর্থবছরের এমন সময় অর্থ ছাড় দেওয়া হয় যখন ওই টাকা সব বিধিবিধান মেনে খরচ করার সময় থাকে না। ফলে যেমন কাজ আটকে যায় আর টাকা ফেরত যায়। এ ছাড়া দরপত্রের জটিলতা রয়েছে। পাশাপাশি অনেক কর্মকর্তা নানা ধরনের অনিয়মের আশঙ্কায় থাকেন। তারা ভয়ে তড়িঘড়ি করে কোনো কেনাকাটায় যেতে চান না। বরং টাকা ফেরত দেওয়াই শ্রেয় মনে করেন।
অধ্যাপক হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতের অডিট প্রক্রিয়া একটা বড় সমস্যা। অন্য খাতের অডিট আর স্বাস্থ্য খাতের অডিট এক রকম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যারা অডিট করেন, তারা সবকিছু একভাবে দেখেন। মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় জরুরি অনেক কেনাকাটার দরকার হতে পারে। সেটা আমলে নিতে চান না। এ জন্য স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদা অডিট ব্যবস্থা রাখা দরকার। অডিটের ভয়ে অনেক কর্মকর্তা খরচ করতে চান না। আবার দুর্নীতির ভয়ও আছে। অন্যদিকে এটাও ঠিক যে, কম খরচের মধ্যেও একশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতি-অনিয়মের সুযোগ নেন।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সাবেক চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, যাদের কারণে বরাদ্দের অর্থ খরচ করা হয় না চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে শুরু নিচের দিকে ব্যবস্থাপকদের দায়ী করলেই হবে না। পরিকল্পনায় যারা থাকেন, যারা সমন্বয় ও তদারকির জায়গায় থাকেন তাদেরও গাফিলতি আছে। অনেক ধরনের ব্যর্থতার দায়েই বরাদ্দকৃত টাকার ২০-২৫ শতাংশ টাকা অব্যয়িত থাকে, যা ফেরত দিতে বাধ্য হন দায়িত্বশীলরা। এ ছাড়া সময়মতো অর্থ ছাড় না হওয়া, দক্ষতায় ও সমন্বয়ের ঘাটতিও থাকে।