
বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে বাহারি নামের ভিড়ে মানবদেহ নামের ইঞ্জিনটার প্রকৃত পরিচয় ভুলে যায়। মানুষের ধর্ম ও স্থানভেদে নাম হয় ভিন্ন। নামের বৈচিত্র্য ও রহস্যও ভিন্ন। কিছু নাম শুনলে যেমন প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হয়, আবার কিছু নাম উচ্চারণ করতে মুখ ও দুপাটি দাঁতগুলোকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ে সবার একটাই পরিচয় হয় লাশ।
প্রকৃত অর্থে আমরা সবাই লাশ, কেউ জীবন্ত, কিছু প্রাণহীন। কিছুর অবস্থান কবরস্থানে কিংবা সৎকারে, আবার কিছু লাশ পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় জীবিতদের মুখোশ পরে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিবারের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করেছে। লাশটা নিতে কেউ আসেনি। জ্যান্তদের দুনিয়ায় লাশটার নাম ছিল ঈমান আলী। পেশায় সরকারি চাকরিজীবী। যখন হাঁটতেন তখন ফুটবলের মতো গোলাকার ভুঁড়িটা দেহের অগ্রভাগ শাসন করত। তিন সন্তান ও স্ত্রীর নামে ঢাকায় পাঁচতলা তিনটা বাড়ি বানিয়েছেন। নিজের জন্য হাইপ্রেশার, ডায়াবেটিস আর রক্তনালিতে পাঁচটি ব্লক ছাড়া কিছুই বানাতে পারেননি। চিকিৎসক অনেক খাবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। ঈমান আলী সচেতন মানুষ চিকিৎসকের নিষেধ করা কোনো খাবার স্পর্শও করেননি, কিন্তু ইমাম সাহেবের হাজারবার নিষেধ করার পরও ঘুষ খাওয়া ছাড়েননি।
আয়-ব্যয়ের হিসাব করলে ঈমান আলীর টাকা-পয়সার ওজন অনেক বেশি হবে কিন্তু ঈমান আলীর ঈমানের কোনো অস্তিত্বও পাওয়া যাবে না। জীবিত থাকতে যদি বুঝতে পারতেন, যে পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুর পরে কোনো কাজেই আসবে না, তাহলে হয়তো কখনোই অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়তেন না।
চিকিৎসকদের অনেক অনুরোধ ও চেষ্টার পর অবশেষে ঈমান আলীর স্ত্রী সেলিনা বেগম এলেন ঈমান আলীর লাশ নিতে। করোনা রোগে মৃত ব্যক্তিকে কোনো গাড়িও বহন করতে রাজি হলো না। অবশেষে মোটা টাকায় চুক্তি হলো একজন দালালের সঙ্গে, যিনি গাড়ির ব্যবস্থা করে বাড়িতে লাশ পৌঁছে দেবেন। লাশ নিয়ে এলাকায় প্রবেশ করার সময় ঘটল বিপত্তি।
করোনার আক্রান্ত লাশ নিয়ে এলাকায় ঢুকতে গেলে কিছু বিবেকহীন গ্রামের মাদবর নামের জ্যান্ত লাশ, প্রাণহীন ঈমান আলীর লাশটাকে নিয়ে এলাকায় ঢুকতে দিল না। কয়েক ঘণ্টা চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না। অথচ জীবিত থাকতে এলাকার মানুষের জন্য অনেক কিছুই করেছেন ঈমান আলী। কিন্তু দেহের শ্বাস বন্ধ হওয়ার পর তার এলাকার গোরস্থানে জায়গা হলো না। দালাল নামের অনুভূতিহীন, নিষ্ঠুর চুক্তি করা জ্যান্ত লাশটাও দয়া-মায়াহীন লোকের মতো রাস্তার পাশে ঈমান আলীর প্রাণহীন লাশটাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। রাত প্রায় ১১টার সময় রাস্তায় বসে থাকতে দেখে একজন ভ্যানচালক সেলিনাকে বললেন- আফা, আপনেরে আমি লাশ দাফনে সাহায্য করতে পারি, তয় আমারে বেশি টেয়া দেওন লাগব।
আমার স্বামী করোনায় মারা গেছে তুমি জানো? জিজ্ঞাসা করলেন সেলিনা বেগম। ভ্যানচালক বললেন- আফা লকডাউনে কোনো কাম-কাইজ নাই, ঘরের সবাইরে গ্রামে থুইয়্যা আইছি। পরিবারের সবাই ঠিকমতো খাওন পায় না, আমাগো কাছে আবার করোনা কী? আমি পোলাপাইনগো লাইগা কিছুই করতে পারতাছি না, আমিও তো একটা জ্যান্ত লাশ, আমার মধ্যে আর মৃত লাশের মধ্যে ফারাক কই? করোনায় আমারে খাইলেও পোলাপাইনগুলা যদি খাওন পায়, তাতেই আমি খুশি।
ভ্যানওয়ালা, লাশ ও সেলিনা বেগম রওনা হলেন আজিমপুর কবরস্থানের চিরস্থায়ী বাড়িতে। আজিমপুরের কিছু খাদেম আর ভ্যানওয়ালার সহায়তায় যাবতীয় কাজ শেষে শূন্য হাতে লাশটার চিরস্থায়ী ঠিকানা হলো সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে।
কী অদ্ভুত! জীবিত থাকতে পরিবার, সন্তান আর সমাজের জন্য আমরা কত কিছুই না করি। বাহারি নামে পরিচিত হই, নামের ঢঙে ভিজিটিং কার্ড সাজাই অথচ দেহঘড়ি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই নিষ্ঠুর আচরণ করা শুরু করে। দুনিয়াতে সামান্য পথ অতিক্রম করতে কতই না বাহন ব্যবহার করি, কিন্তু সামাহীন পথের যাত্রা শুরু হয় শূন্য হাতে নতুন পরিচয়ে লাশ হয়ে।
আবু সাঈদ দেওয়ান সৌরভ
মিরাপাড়া, রিকাবী বাজার
মুন্সীগঞ্জ
তারেক