বর্তমান যুগে ‘বডি পজিটিভিটি’ বা ‘শরীর নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে যত আলোচনা, সমর্থন এবং সামাজিক আন্দোলন চলছে, তা দেখে অনেকেই ভাবেন, বিষয়টি হয়তো আধুনিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে বেরিয়ে আসবে ভিন্ন কথা।
১৯০৪ সালে আমেরিকায় গড়ে ওঠে এক ব্যতিক্রমী ক্লাব (‘Fat Men’s Club’)। সেই সময়েও কিছু সাহসী মানুষ নিজের গড়ন, শরীর ও উপস্থিতি নিয়ে গর্ব করতেন এবং তারা সমাজকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে মোটা হওয়া মানেই দোষের নয়, অপমান নয় বরং তা হতে পারে গর্ব ও সম্মানের বিষয়। শতাব্দী পুরোনো সেই ক্লাবের ইতিহাসে আজ জানব তাদের উদ্দেশ্য, শর্তাবলি এবং সমাজে রেখে যাওয়া বার্তা।
প্রথমেই জানা যাক ক্লাবের জন্মের প্রেক্ষাপট। ১৯০৪ সাল—বিশ্ব যখন দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শিল্পবিপ্লবের রেশ ছড়িয়ে গেছে আমেরিকার সমাজে। তা ছাড়া নগরায়ণ ও আধুনিকতার ছোঁয়া পড়ছে সর্বত্র। এই সময়েই গড়ে ওঠে একটি অভিনব ক্লাব, যার সদস্য হতে হলে প্রয়োজন ছিল একটি বিশেষ ‘যোগ্যতা’। আর সেটা হলো আপনার ওজন হতে হবে কমপক্ষে ২০০ পাউন্ড বা প্রায় ৯০ কেজি। ক্লাবটির সূচনা হয়েছিল আমেরিকার ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যে। পরে এর শাখা ছড়িয়ে পড়ে ম্যাসাচুসেটস, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি এবং অন্যান্য স্থানে। যদিও ক্লাবটির মূল কার্যক্রম চলেছিল অল্প কিছু বছর, তবে তার প্রভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যতিক্রমিতা আজও ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে এক বিশেষ স্থান। ‘Fat Men's Club’ ছিল ইতিহাসের এক বিরল উদাহরণ যেখানে শরীরকে ভালোবাসা, নিজেকে গ্রহণ করা এবং সামাজিক গড়ন ভেঙে নতুন বার্তা দেওয়ার এক সাহসী প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সমাজের চোখে মোটা হওয়া; যেটা ছিল ত্রুটি, সেই মোটা শরীরকেই তারা বানিয়েছিল গর্বের প্রতীক। যদিও ১৯২০ দশকের পরে এই ক্লাবগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন- স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রবণতা, মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘স্লিম বডি’র প্রমোট, এবং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সদস্যদের বার্ধক্যজনিত অক্ষমতা। মজার ব্যাপার এই বিশেষ ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্যও রয়েছিল বেশ কিছু শর্ত যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
-ওজন কমপক্ষে ২০০ পাউন্ড বা ৯০ কেজি হতে হবে।
-বছরে ১ ডলার (বর্তমানে প্রায় ৩৬ ডলার সমমূল্যের) সদস্য ফি দিতে হবে।
-প্রতিবার ক্লাবের বৈঠকে হাজিরা দেওয়া আবশ্যিক ছিল।
-সদস্যদের সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে একে অপরের সঙ্গে হাত মেলানো। তা ছাড়া হাসিমুখে কুশল বিনিময় করাও ছিল শর্তের মধ্যে।
.png)
এই ক্লাবের উদ্দেশ্য ও দর্শন: এই ক্লাবের মূল দর্শন ছিল একটাই ‘আমরা মোটা এবং আমরা এভাবেই ভালো আছি।’ তাদের মতে সমাজে যে সৌন্দর্যের ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল যেখানে পাতলা, সুঠাম দেহকেই ‘আকর্ষণীয়’ হিসেবে বিবেচিত করা হতো যা মূলত এক ধরনের শারীরিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। ক্লাবটির উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে এই বার্তা দিতে যে, মোটা হওয়া কোনো ব্যর্থতা নয়, শরীর যেমনই হোক, সমাজে সম্মান পাওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট মাপের দেহ দরকার নেই। যে যেমন সে সেভাবেই সুন্দর। এই বার্তা তখনকার দিনে খুবই সাহসিকতার ব্যাপার ছিল।
ক্লাবের অন্যান্য নিয়মিত কার্যক্রম: প্রতিবার ক্লাবের বৈঠকে একটি বিশাল ভোজের আয়োজন করা হতো। মোটা পুরুষদের জন্য উপযোগী খাবারের তালিকায় থাকত সুস্বাদু মাংস, চিজ, মিষ্টি ও নানা ধরনের পানীয়। ক্লাবের সদস্যরা একত্রিত হয়ে গল্প করতেন, হাসতেন, সমাজের নানা বিষয়ে মতবিনিময় করতেন একে অপরের সঙ্গে। এসব বৈঠক ছিল এক ধরনের উৎসব যেখানে শরীর নিয়ে হীনম্মন্যতা নয়, বরং গর্বের সঙ্গে তা উদযাপন করা হতো। ক্লাবের এই বৈঠকগুলো সেই সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রেও প্রচারিত হতো। ফলে সমাজের নানা স্তরের মানুষ বিষয়টি জানতে পারতেন। তাদের বক্তব্য ছিল খুবই স্পষ্ট- ‘আমরা এমনই এবং আমাদের এই রূপেই মানিয়ে নেওয়া হোক।’
তৎকালীন সমাজে সৌন্দর্যবোধ বেশ একমুখী ছিল। নারীদের ক্ষেত্রে ছিল চিকন শরীর, পুরুষদের ক্ষেত্রে সুগঠিত দেহ। এর ব্যতিক্রম হলে অন্যদের চোখে দৃষ্টিকটু ভাব দেখা যেত। এই ক্লাব সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল। তবে সব প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক ছিল ঠিক তা নয়। অনেকেই এটিকে খারাপভাবে দেখত। আবার কেউ কেউ এটিকে ‘অসুস্থ জীবনযাপনকে উৎসাহ’ হিসেবে দেখে সমালোচনা করত।
সবশেষে বলা যায় আজকের দিনে যখন ‘body shaming’ বিরোধী আন্দোলন চলছে, সে হিসেবে তখনকার এই ক্লাবকে এক ধরনের অগ্রপথিক বলাই যায়। তারা শত বছর আগেই দেখিয়েছিল আত্মবিশ্বাস এবং পারস্পরিক সমর্থন থাকলে শারীরিক গড়ন কোনো সীমাবদ্ধতা নয়। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেন, আত্মমর্যাদাবোধ গড়ে ওঠে নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকে। ‘Fat Men’s Club’ সেই ভালোবাসাকেই প্রতিষ্ঠা করেছিল বাস্তবে। এই ক্লাব শুধুই একটি সামাজিক সংগঠন ছিল না বরং একটি দৃষ্টিভঙ্গির বিপ্লব, এক আত্মমর্যাদার উত্থান এবং এক পরিবর্তনের বার্তা বয়ে এনেছিল।
তারেক