প্রকৃতি যেন আমাদের হৃদয় জানে, বোঝে আমাদের ক্লান্তি, অনুভব করে আবেগ। তাই তো কখনো এক টুকরো আকাশ, কখনো এক চিলতে বাতাস, কিংবা নিঃশব্দে ঢেউ তোলা জলরাশি হয়ে সে হাজির হয় সান্ত্বনার পরশ নিয়ে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের কাছে এমন এক আশ্রয়ের নাম নীলদিঘি, যেখানে তৈরি হয় হাজারও স্মৃতি।
নীলদিঘি শুধু একটি দিঘি নয়, এটি যেন ক্যাম্পাসের তরুণ-তরুণীদের প্রাণের আবেগময় এক ক্যানভাস। ক্লাসের ফাঁকে কিংবা পরীক্ষার অবসরে, একাকিত্বের মাঝে কিংবা প্রিয়জনের হাত ধরে- সব মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আছে এই দিঘির নীল জলরাশি। চারপাশের গাছপালা, বেঞ্চ, সিঁড়ি, আর সৃজন ঘাট—সব মিলিয়ে এক অভিজাত নীরবতায় ভরপুর এই প্রাঙ্গণ।
সারা দিনের ক্লান্তি আর যান্ত্রিক জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে এখানে ছুটে আসে শিক্ষার্থীরা। পড়ন্ত বিকেলে জমানো আড্ডা, গিটারের সুরে ভেসে বেড়ানো গান, প্রেমিক-প্রেমিকার না বলা কথার ভেলায় সাজানো গল্প—সবকিছুই যেন এখানে এসে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কেউ আসে নতুন গল্প বুনতে, কেউ আসে পুরোনো গল্পের ইতি টানতে। আবার কেউ শুধু কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যেতে বা আত্মার প্রশান্তির খোঁজে।
নোবিপ্রবির প্রত্যেক ব্যাচ, প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জীবনের কোনো না কোনো অধ্যায়ে জায়গা করে নিয়েছে নীলদিঘি। বারবিকিউ পার্টি থেকে শুরু করে জন্মদিন উদযাপন, সাহিত্যিক আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— সবকিছুরই জন্য প্রিয় এবং আদর্শ স্থান এটি।
শরতের রোদ-বৃষ্টির খেলায়, কিংবা শীতের কুয়াশামাখা ভোরে, বসন্তের রঙিন বিকেলে কিংবা বর্ষার স্নিগ্ধ সন্ধ্যায়—প্রতিটি ঋতুতে নীলদিঘির রূপ আলাদা। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে যখন দিঘির জলে প্রতিফলিত হয় ক্যাম্পাসের আলো, তখন তা হয়ে ওঠে রূপকথার কোনো গল্প।
নীলদিঘির প্রেমে পড়েছিলেন শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থী আসমা আক্তার মিতু। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘১০১ একর ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্র এই নীলদিঘি। বর্ষা, গ্রীষ্ম, শীত বা বসন্ত- সব ঋতুতে তার রূপ একেক রকম, কিন্তু প্রতিবারই মন ছুঁয়ে যায়। ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট আর ক্লাস টেস্টে জর্জরিত দিনশেষে যখন নীলদিঘির ঘাটে বসি, দিঘির শান্ত বাতাসে যেন সমস্ত ক্লান্তি মিলিয়ে যায় নিঃশব্দে।
আবার বৃষ্টির দিনে নীলদিঘির সৌন্দর্য যেন নতুন করে জেগে ওঠে। রূপ বেড়ে যায় শতগুণে। এমনই এক বর্ষার দিনে হলের ৮-১০ জন মিলে ঘাটে বসে যখন বৃষ্টিতে ভিজি, মুহূর্তটা হয়ে ওঠে আজীবনের প্রিয় স্মৃতি। সখীদের হাসি, গল্প আর বৃষ্টির ছোঁয়ায় নীলদিঘি সে স্মৃতিকে করে তোলে আরও অনন্য। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে ঘাটে ভেসে আসে গানের গুঞ্জন, আর সেই সুর মিশে যায় দিঘির হাওয়ায়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আল জোবায়ের জিসান বলেন, ‘একজন নোবিপ্রবি শিক্ষার্থী তার একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করে ফেরার পর ক্যাম্পাসের যে জায়গাগুলো নিয়ে স্মৃতিচারণ করে তার মধ্যে নীলদিঘি অন্যতম। সকালের স্নিগ্ধ সূর্যোদয়, অলস দুপুরের নিস্তব্ধতা কিংবা বিকেলে পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে এই জায়গাটি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গান, শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন বোনার সাক্ষী হয়ে থাকে নীলদিঘি। বিকেলে খেলাধুলা শেষে দলবেঁধে পুকুরের পানিতে গোসল করতে নামার আনন্দ অতুলনীয়। তবে ২০১৮-১৯ সালের দিকে এর চারপাশে যেমন পরিবেশ ছিল এখন তা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে, জৌলুস হারিয়েছে নীলদিঘি। সে সময় দিঘির চারপাশে ছিল হরেক রঙের আলোকসজ্জা, ছিল পরিপাটি আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখন অযত্ন-অবহেলায আর দূষণে যেন রূপ হারাতে বসেছে এই দিঘি। রাতে আলোকস্বল্পতায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় এর আশপাশ। বাড়ে বহিরাগতদের আনাগোনাও। নীলদিঘি আবার ফিরে পাক তার পুরোনো সৌন্দর্য। প্রশাসন নীলদিঘির সৌন্দর্য ফেরাতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই প্রত্যাশা থাকবে।’
দিন যায়, ব্যাচ বদলায়, গল্পগুলো হয়তো নতুন হয়ে ওঠে কিন্তু নীলদিঘির বুকে আঁকা স্মৃতিগুলো অম্লান হয়ে থাকে। এই দিঘি যেন এক নীরব গল্পকার, যে কথা বলে না, শুধু শোনে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ভালোবাসার আড়ালে থেকে যায় তার গভীর ছায়া।
/রিয়াজ