![বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী](uploads/2024/04/04/1712169155.buet.jpg)
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে সমর্থন দিয়েছেন ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চালানো এক জরিপে উঠে এসেছে এ তথ্য। রাজনীতিমুক্ত বুয়েটসহ পাঁচ দফা দাবিতে ষষ্ঠ দিন পেরিয়েছে আন্দোলন। দাবি আদায়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে অনড় অবস্থানে রয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই ৪ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বুয়েটে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে একই সঙ্গে এই আন্দোলনে ছাত্রদলের সংহতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল বুধবার রাতে বুয়েটের ড. এম এ রশীদ প্রশাসনিক ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে চলমান ছাত্ররাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলনের বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণের যে ঘোষণা দিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, ‘বুয়েট শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে চলমান আন্দোলনের এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে ছাত্রদলের এমন বক্তব্যকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করি এবং তাদের এই রাজনৈতিকভাবে মদদপুষ্ট সংহতিকে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করছি।’
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, “২০২০-এর জুলাই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা লঙ্ঘন করে ছাত্রদল যখন বুয়েটে তাদের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে, সেই সময়ের অগ্রজ ব্যাচ ‘পৌনঃপুনিক ১৫’ তাদের এই কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) স্যার বরাবর ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদন করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তখনো এর প্রতিবাদ জানাই এবং সামনেও আমরা ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা অব্যাহত রাখব।”
তারা আরও বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো সংগঠনও যদি এমন বক্তব্য দিয়ে আমাদের আন্দোলনের দাবি এবং অবস্থানকে ঘোলাটে করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়, তবে আমরা তাদেরও প্রত্যাখ্যান করব।’
ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে নয়, এমন প্রসঙ্গ টেনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই, আমাদের অবস্থান কোনো একক ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে নয়। আমরা ছাত্ররাজনীতি-ই ক্যাম্পাসে প্রবেশের বিরুদ্ধে, অতএব এটি করতে চায়, এমন যেকোনো সংগঠনের বিরুদ্ধেই আমাদের অবস্থান সমান এবং অনড়।’
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘হিজবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধ মৌলবাদী সংগঠনের অস্তিত্বকেই আমরা সমর্থন করি না। সেখানে এরূপ নিষিদ্ধ সংগঠনের সমর্থন বা সহানুভূতি গ্রহণ করার প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্যাম্পাসে সব দলের ও মতের লেজুড়বৃত্তিক সাংগঠনিক রাজনীতি এবং মৌলবাদী দলসমূহের বিপক্ষে আছি এবং থাকব। আমাদের এই অবস্থান সব দল ও মতের ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।’
আবরারের মতো মর্মান্তিক পরিণতি নেমে আসতে পারে: ছাত্রদল
গতকাল ডিআরইউ সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব লিখিত বক্তব্য বলেন, ‘বুয়েটে ছাত্রলীগের কার্যক্রম চালু করার পদক্ষেপ বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা এখন শঙ্কিত, কারণ ছাত্রলীগের কার্যক্রম পুনরায় চালু হলে তাদের পড়াশোনা এবং ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিং, গেস্টরুমে হাজিরা দিতে হবে। তাদের কর্মসূচিতে অংশ না নিলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হবে। ছাত্রলীগের ক্যাডারদের বিরাগভাজন হলে বিতাড়িত করা হতে পারে হল থেকে। বুয়েটের প্রত্যেক শিক্ষার্থী আতঙ্কিত। যেকোনো মুহূর্তে তাদের যে কারও জীবনে ছাত্রলীগের নির্যাতনে শহিদ আবরারের মতো মর্মান্তিক পরিণতি নেমে আসতে পারে।’
বুধবারের বর্জন ছিল ক্লাস বর্জন
এদিকে গতকাল পূর্বঘোষিত পরীক্ষা থাকলেও তাতে অংশ নেননি শিক্ষার্থীরা। জানা যায়, এদিন ২০১৮ ব্যাচের একটি টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা ছিল, যেটি ঈদের আগেই শেষ পরীক্ষা। যদি ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস খোলা ও দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী খবরের কাগজকে বলেন, ‘চলমান আন্দোলনে কেউই ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। তা ছাড়া বৃহস্পতিবার বন্ধ, খুলবে ১৭ এপ্রিল। পরীক্ষার সময়সূচি অনুযায়ী সেই দিন একটি পরীক্ষা রয়েছে। এখন এটি নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না, শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেবে কি না। কারণ এটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত।’
টানা ১৩ দিনের ছুটিতে বুয়েট শিক্ষার্থীরা
রোজা, ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখের ছুটি মিলিয়ে টানা ১৩ দিনে ছুটিতে যাচ্ছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। ৪ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩ দিনের অবকাশ পাচ্ছেন তারা। যার ফলে ১৭ এপ্রিল একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হবে বুয়েটে। গত ৩০ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তিতে এই ছুটি ঘোষণা করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যদিও বুয়েটে দাপ্তরিক ছুটি থাকবে ৯-১৪ এপ্রিল।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী
বুয়েটে সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ ‘বুয়েটে আড়ি পেতে শোনা’; ওই গ্রুপটিতে বুয়েট ‘বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত নাকি অনুচিত?’ শীর্ষক এক জরিপে অংশ নেন ৪ হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষার্থী। গ্রুপটিতে সদস্যসংখ্যা সংখ্যা ২৪ হাজার ৫ জন। বলা হচ্ছে, অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর বুয়েট শিক্ষার্থীরা এই গ্রুপে সদস্য হতে পারে। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের ওই জরিপে দেখা গেছে, শতকরা শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি দেখতে চায়। বাকি ৯৯ দশমিক ৫৯ ভাগ ছাত্ররাজনীতি দেখতে চায় না।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাসে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি সান মার্কোসের সহকারী অধ্যাপক ও বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ড. মুহাম্মদ লুৎফর রহমান বুয়েটে আড়ি পেতে শোনা গ্রুপ ও ওই জরিপ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘এই গ্রুপে ভেরিফাই করে মেম্বার যোগ করা হয়। বর্তমানে এই গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ২৪ হাজার ৫ জন। আমার জানামতে, বাংলাদেশে এটি একমাত্র গ্রুপ, যেখানে সদস্যদের ভোটে ছয় মাসের জন্য অ্যাডমিন প্যানেল নির্বাচিত হয়।’
তিনি ওই স্ট্যাটাসে জরিপ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘এই পোস্ট লেখার আগ পর্যন্ত সর্বমোট ৪ হাজার ৭৯৬ জন ভোট দিয়েছেন এই পোলে। হ্যাঁ-তে ভোট পড়েছে ২০টি আর না-তে ভোট পড়েছে ৪ হাজার ৭৭৬টি। মানে বুয়েট কমিউনিটির শতকরা শূন্য দশমিক ৪১ ভাগ মানুষ বুয়েটে রাজনীতি দেখতে চান। বাকি ৯৯ দশমিক ৫৯ ভাগ মানুষ বুয়েটে রাজনীতি দেখতে চান না। জোর করে অনেক কিছুই করানো যায়। তাতে ভালোর চেয়ে খারাপই বেশি হয়।’
এদিকে এ প্রসঙ্গে গতকাল বুয়েটে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সমমনা ও বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে থাকা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাগর বিশ্বাস অভিযোগ করেন, এই জরিপের ফলাফল আলাদা হতো যদি নাম-পরিচয় প্রকাশ অপ্রকাশিত রাখা হতো। তিনি বলেন, ‘এখনো পুরো বিষয়টিই প্রকাশ হচ্ছে। কারণ সেখানে নাম প্রকাশ হচ্ছে, যদি নাম না প্রকাশে ভোট দেওয়ার আয়োজন করা হয়। এর ফলাফল ভিন্ন হতো। কারণ অনেক শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি চান। যারা রাজনীতির পক্ষে তারা যদি ভোট দেন, তারাও হুমকির সম্মুখীন হতে পারেন, সেই ভয়ে কিন্তু তারা ভোট দিচ্ছেন না।’
মেইল জরিপে ৯৭ শতাংশ রাজনীতির বিপক্ষে
গতকাল রাজনীতিমুক্ত বুয়েট দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বুয়েটের শতকরা ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থী বুয়েটে ক্যাম্পাস রাজনীতির বিপক্ষে। ওই শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘দুই দিনব্যাপী, জনমত নিরীক্ষণের জন্য, আমরা আমাদের নিজ নিজ ইনস্টিটিউশনাল মেইল ব্যবহার করে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে অনলাইনে ভোট গ্রহণ করি। যার ফলাফল হচ্ছে, সর্বমোট ছাত্রসংখ্যা ৫ হাজার ৮৩৪ জন। ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে স্বাক্ষর দিয়েছেন ৫ হাজার ৬৮৩ জন। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। সুতরাং আমাদের অবস্থানের যথার্থতা এখানে প্রমাণিত।’