![সমবায় সমিতির খপ্পরে ৫০ হাজার গ্রাহক](uploads/2024/04/04/1712206223.Jamalpur-Somobai-Somittee.jpg)
মাদারগঞ্জ পৌর শহরের বালিজুড়ি বাজার। শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতি নামে একটি অফিস এই বাজারে রয়েছে। আগে প্রায়ই এখানে জমশেদ মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে দেখা যেত। চলাফেরায় অক্ষম সত্তর-ঊর্ধ্ব এই ব্যক্তি হামাগুঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সমিতির অফিসে উঠতেন। জানতে চাইতেন তার টাকা কবে পাবেন। কিন্তু তাকে দীর্ঘদিন ঘোরানো হয়। এখন ওই অফিসটি তালাবদ্ধ। গ্রাহকদের টাকা না দিয়েই তারা পালিয়ে গেছেন। পেশায় ভিক্ষুক জমশেদ মিয়া শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। অধিক লাভের আশায় ওই টাকা রেখেছিলেন শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতিতে। ভেবেছিলেন প্রতি মাসে পাওয়া মুনাফার টাকায় জীবন কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু এখন তিনি আসল-মুনাফা দুটোই হারিয়েছেন।
প্রবাসী ছেলের পাঠানো টাকা ও বিদেশফেরত স্বামীর সারাজীবনের জমানো ৪৫ লাখ টাকা একটি সমবায় সমিতিতে জমা রাখেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আলিয়া বেগম। কথা ছিল সুবিধামতো সময়ে ওই টাকা তুলে তিনতলা বাড়ি বানাবেন, জীবনের শেষ সময়গুলো কাটাবেন সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে। বাড়ি করার জন্য সব প্রস্তুতি নিলেও টাকা উত্তোলনের সাত দিন আগেই উধাও হয়ে যান ওই সমিতির কর্মকর্তারা। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা আলিয়া বেগমের চোখে এখন শুধুই হতাশার জল। অর্থের অভাবে স্বামী ও নিজের চিকিৎসা করাতেও হিমশিম খাচ্ছেন। শুধু তারাই নন বিভিন্ন সমিতির গ্রাহক খোদেজা বেগম, শাহাদাত হোসেন, সুশান্ত চন্দ্র ঘোষ, শাপলাসহ আরও অনেক গ্রাহকের গল্প কমবেশি একই রকম।
জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় সমবায় কার্যালয়ের নিবন্ধন নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রমের আদলে গ্রাহকদের আমানত সংগ্রহ করে উধাও হয়ে গেছে বেশ কিছু সমবায় সমিতি। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা এসব সমিতি ব্যাংকের চেয়ে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করে। শুরুর দিকে গ্রাহকদের মুনাফা দিলেও বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকজন টাকা নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। ফলে সর্বস্ব হারিয়ে গ্রাহকরা এখন দিশেহারা। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, সমিতিগুলোর অনিময় তদন্ত করে দেখা হবে।
জানা গেছে, উপজেলা সমবায় কার্যালয় থেকে নিবন্ধন নিয়ে মাদারগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক সমবায় সমিতি। এগুলোর মধ্যে মাদারগঞ্জ আল-আকাবা বহুমুখী সমবায় সমিতি, শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতি, স্বদেশ বহুমুখী সমবায় সমিতি, নবদ্বীপ বহুমুখী সমবায় সমিতি, জনতা শ্রমজীবী সমবায় সমিতি অন্যতম। বিভিন্ন পেশার অন্তত ৫০ হাজার গ্রাহক এসব সমিতিতে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার আমানত জমা রাখেন। সবচেয়ে বেশি টাকা হাতিয়েছে আল-আকাবা আর শতদল বহুমুখী সমিতি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান।
সরেজিমনে দেখা যায়, মাদারগঞ্জ শহরের বিভিন্ন আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে বাহারি নামের বিভিন্ন সমবায় সমিতি। একটি ভবনেই পাওয়া যায় অন্তত ১০টি সমিতির কার্যালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে একেকজন গ্রাহক সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে শুরু করে কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত রেখেছেন। এখন প্রায় সব সমিতির কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। আর গ্রাহকরা লভ্যাংশ তো দূরের কথা জমানো আমানত কীভাবে ফিরে পাবেন সেই আশায় প্রতিদিন সমিতির কার্যালয়ের সামনে এসে ভিড় করছেন।
আল-আকাবা বহুমুখী সমবায় সমিতির গ্রাহক শিল্পী আক্তার জানান, নিজের ও স্বামীর জমানো সাড়ে ছয় লাখ টাকা তিনি ওখানে জমা রাখেন। আমানতের বিপরীতে প্রতি মাসে ভালো মুনাফা পাওয়ায় ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার জন্য মা আনোয়ারা বেগমের সঞ্চিত সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা রাখেন শতদল বহুমুখী সমবায় সমিতিতে। কিন্তু গত এক বছর ধরে সমিতি দুটি মুনাফা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। হঠাৎ গত তিন সপ্তাহ আগে সমিতির অফিসে তালা ঝুলতে দেখা যায়।
মাদারগঞ্জ উপজেলা সমবায় কার্যালয়ের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত আল-আকাবার আমানত ৪১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, শতদলের ২২১ কোটি ৮৫ লাখ ৮১ হাজার ৫৫ টাকা, নবদ্বীপের ২৫ কোটি ৮০ লাখ, স্বদেশের ৫৬ কোটি ৮৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫১ টাকা। এ ছাড়াও আরও ১০ থেকে ১৫টি সমিতির আমানত ১ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে বলা হলেও বাস্তবে এসব সমিতির মূলধন ও সম্পদের পরিমাণ সমবায় কার্যালয়ের হিসাবের চাইতেও কয়েক গুণ বেশি।
মাদারগঞ্জ কেন্দ্রীয় বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রায়হান রহমতুল্লাহ রিমু বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেনের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘নিয়ম না থাকলেও সবাই যেভাবে টাকা লেনদেন করেছে, আমরাও সেভাবে করেছি। তবে টাকা নিয়ে সমিতির অন্য পরিচালকরা ঝামেলা করছে বুঝতে পেরে আমি কেন্দ্রীয় বমুমুখী সমবায় সমিতি এবং রূপসী বাংলা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি থেকে কয়েক মাস আগে পদত্যাগ করেছি।’
জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী বলেন, ‘প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় এতগুলো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আমানত আত্মসাৎ করতে পেরেছে। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাকদের কাছ থেকে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছে।’
জেলা সমবায় কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, ‘আইন অনুযায়ী সমিতিগুলো ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। তারা এতদিন ধরে অবৈধ লেনদেন করছিল। বিষয়টি জানতে পেরে মাদারগঞ্জ উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খানকে শোকজ করা হয়েছে। এসব সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হবে। সমিতির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের মামলা করার পরামর্শ দেন তিনি।
জেলা প্রশাসক শফিউর রহমান বলেন, ‘আমরা সরেজমিন তদন্ত করে দেখব, কেন এতগুলো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তারা আইন মেনে আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল কি না, সেটাও দেখা হবে।’ এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার আগে সাধারণ মানুষকে ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জেনে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।