রাজশাহীতে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহ ও অনাবৃষ্টিতে খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, জলাশয় শুকিয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে কৃষকের খেতসহ সবখানে। এ ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর-গভীর অনেক নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে দেখা দিয়েছে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। সেচের জন্যও ভোগান্তিতে পড়েছেন চাষিরা। বৃষ্টির আশায় বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ নামাজ আদায় করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে ব্যাঙের বিয়ে। তবুও দেখা নেই বৃষ্টির, এমনকি তাপপ্রবাহের পারদ ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের জনজীবন। পাশাপাশি আম, লিচু, বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
খরা মৌসুমে পানিসংকটের আলোচনায় এত দিন উত্তরাঞ্চলে শুধু রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত তানোর উপজেলার নাম শোনা যেত। তবে গত বছর থেকে রাজশাহীর প্রায় সব উপজেলাতেই ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত ও তিনটি মৌসুমের পুরো চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারকে দায়ী করা হচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, বৃষ্টির অভাবে বর্ষা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক না হওয়া ও নির্বিচারে পানি তোলায় এ অঞ্চলে তাপপ্রবাহের সময়সীমা বেড়েছে। এতে কৃষিকাজ ও খাওয়ার পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
তারা আরও বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে সবুজ প্রকৃতি ও জলাধার হারিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বৃষ্টিপাতও কমে এসেছে। যেটুকু বৃষ্টি হচ্ছে, সেটুকুর পানিও কোনো কাজে লাগছে না। ফলে প্রতিবছর রাজশাহী অঞ্চলে ৪ ফিট করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে তাপমাত্রা।
সরেজমিনে দেখা যায়, খরায় বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহীর সর্বত্র পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি দেখা দিয়েছে তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নে। পানি সংকটের কারণে এখানকার বাসিন্দারা প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি সংগ্রহ করছেন তাদের গৃহস্থালি কাজ ও খাওয়ার জন্য। একই চিত্র বাঘা উপজেলার কয়েকটি গ্রামেও। টিউবওয়েল ও ডিপ-টিউবওয়েলেও উঠছে না পানি। এসব গ্রামের মানুষকেও পানি সংগ্রহের জন্য ছুটতে হচ্ছে দূরদূরান্তে।
এদিকে পানির অভাবে ও তীব্র তাপপ্রবাহে রাজশাহী অঞ্চলে কৃষিজমি ফেটে চৌচির হয় গেছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
তাপপ্রবাহে ধানের জমিতে সেচের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানান তানোর উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের কৃষক লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, রাতে জমিতে সেচ দিলে দুপুরের পর তা শুকিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হতে হতে ধানের খেত ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এখন ধান রক্ষাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সেচ ছাড়া বোরো ফসল বাঁচানো কোনোভাবে সম্ভব নয়।
তানোরের মাহালিপাড়ার বাসিন্দা মর্জিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে পানি পাওয়া যায় না। পাশে যাদের ডিপ (গভীর নলকূপ) আছে, ট্যাংক আছে তাদের কাছে থেকে খাবার পানি নিয়ে আসছি। প্রতিদিন সময় করে ৪-৫ বার পানি আনতে হচ্ছে।’
বাঘা উপজেলার চক রাজাপুর এলাকার বাসিন্দা মো. মোস্তাকিম। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিনই খাবার পানির জন্য অন্য এলাকায় ছুটতে হচ্ছে। আসলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে আমাদের এখানে পানি উঠছে না। তাই বাধ্য হয়েই পাশের এলাকা থেকেই পানি আনতে হচ্ছে।’
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) তথ্য বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কম বৃষ্টিপাত, দীর্ঘস্থায়ী খরা ও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামছে। গত গ্রীষ্মে রাজশাহীর তানোর এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমেছে ১১৩ ফুট পর্যন্ত। ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরণ (স্বাভাবিক) না হওয়ায় গড়ে এ অঞ্চলে চার ফুট করে নেমেছে পানির স্তর। সেইসঙ্গে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে তাপমাত্রা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, অনাবৃষ্টি, তাপপ্রবাহ, প্রচণ্ড খরায় রাজশাহী অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে দ্বিগুণ হারে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২৫-৪০ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে মাটির নিচে পানি থাকবে না।
সমস্যা সমাধানে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টির পানির অপচয় না করে এই পানিকে কার্যকরভাবে মাটির নিচে পৌঁছে দিতে হবে। আর নদীনালার পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেচে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য নদীনালা, খালবিল খনন করে পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া অধিক সেচনির্ভর বোরোর পরিবর্তে কম সেচের ফসল আবাদ করতে হবে। বরেন্দ্র এলাকায় প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে, তাহলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত বাড়বে। বৃষ্টিপাত বাড়লে পানির স্তর স্বাভাবিক থাকবে।