সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের টাঙ্গুয়ার হাওরের দুর্গম এক গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে ফারজিনা আক্তার (৯)। তার পরিবারের কোনো জমি নেই, ঘর নেই। শিশুশিল্পী ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পর ফারজিনা স্বপ্ন দেখে, পুরস্কারের টাকায় হাওরপাড়ে ঘর বানানোর। শিশুটির স্বপ্নপূরণে কিছু জমি দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সেখানে ঘর করার জন্য অর্থও বরাদ্দ হয়। কিন্তু ছয় মাস হতে চললেও মাথা গোঁজার ঘর আর হয়নি। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে ঘুরতে ঘুরতে অতিষ্ঠ ফারজিনার বাবা মো. সায়েম। ক্ষোভ-অভিমানে শেষ পর্যন্ত পুরো পরিবার নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন তিনি।
মো. সায়েমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বালা নাই। নিজের ঘর না থাখায় উরা বাইন্দা (চলে) আইলাম। ঘর ফাইমু ফাইমু (পাব) আশায় আইলাম, কিন্তু শেষমেশ আশাহত অইয়া নিজের এলাকা ছাইরা পরিবার লইয়া জীবিকার আশায় সিলেট আইচ্ছি (আসছি)। নিজের বসতবাড়ি নাই, ভাবছিলাম সরকারের দেওয়া জমিত ঘর বানাইয়া নিজের এলাকাত থাকমু, কিন্তু গত কয়েকটা মাস, এই অফিস তিকি (থেকে) হেই অফিস দৌড়তে দৌড়তে জানের খাম (জীবন) শেষ, কুনতাই (কিছুই) অইলো না।’ এভাবে নিজের অভিমান আর হতাশার কথা বলছিলেন তিনি।
নিজ এলাকায় না থেকে সিলেট কেন থাকছেন প্রশ্ন করলে ফারজিনার বাবা বলেন, ‘আমাদের এলাকায় অন্যের জায়গায় থাকতে দেয় না, ভাড়াও দেয় না। তাই সিলেট চলে এসেছি, যাতে থাকার জায়গা হয়। আবার শ্রমিকের কাজও করতে পারি। ঘর না থাকলে থাকব কোথায়? ঘরের জন্য ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হয়ে গেছি। কী করমু, এলাকা থেকে চলে আসা ছাড়া তো কোনো উপায় নাই।’
সায়েমের মা সিলেটে থাকেন। তিনি শ্রমিকের কাজ করেন। আপাতত মায়ের কাছে উঠবেন। পরিবার চালাতে যে কাজ পাবেন, সেটাই করার ইচ্ছা তার। গতকাল সোমবার (১৩ মে) সকালে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার ঢাকা দক্ষিণ এলাকায় পাড়ি দেন তিনি।
জানা যায়, এর আগে সুনামগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরীর সঙ্গে ফারজিনাসহ তার পরিবারের সবাই দেখা করেন। জেলা প্রশাসক তাদের মিষ্টি খাওয়ান। পরিবারের আর্থিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। ফারজিনার লেখাপড়ার জন্য ২০ হাজার টাকাও দেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদের একটি ঘর করে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সব সময় তার পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন তিনি।
সায়েম এরপর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ঘরের জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ডিসেম্বর মাসে ফারজিনার পরিবারকে একটি ঘর দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সময়ে ফারজিনার বাবা ও মায়ের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় ১০ লাখ টাকার একটি পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলার সীমান্তবর্তী বড়ছড়া মৌজায় ফারজিনার পরিবারকে ১৭ শতক জমি দেওয়া হয়। ওই জমিতে একটি ঘর করে দেওয়ার জন্য সমাজসেবা কার্যালয়ের অনুকূলে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দও দেওয়া হয়। কিন্তু সমাজসেবা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। ৭ মাস পার হয়ে গেলেও ঘর আর হয়নি। ফলে জমিটিও বেদখল অবস্থায় পড়ে আছে। এ জন্য উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন সায়েম। উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কার্যালয়ে গিয়ে কোনো সহযোগিতা পাননি তিনি।
এ বিষয়ে সোমবার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিজন কুমার সিংহ বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমি বন্দোবস্ত দিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘরের বরাদ্দটি এসেছে সমাজসেবা কার্যালয়ের অনুকূলে। আমি এ বিষয়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালকের সঙ্গে দুবার কথা বলেছি। দ্রুত কাজটি করার অনুরোধ করেছি। কিন্তু কেন তারা এটি করছে না, সেটি বুঝতে পারছি না।’
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক সুচিত্রা সরকার বলেন, ‘আমরা উপজেলা কমিটির কাছে টাকা দিয়ে দিয়েছি। তিন দিন আগেও তাদের তাগাদা দিয়েছি দ্রুত ঘরটি করে দেওয়ার জন্য।’