খুলনার কয়রার শাকবাড়ীয়া নদীর তীরে গাববুনিয়া বেড়িবাঁধ। গত ৩০ বছর ধরেই দুর্যোগে কিংবা জোয়ারে পানির চাপে ভাঙছে সেটি। যেনতেনভাবে সংস্কার হয়। কিন্তু টেকসই বাঁধ নির্মাণ হয় না। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই আবারও বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বাড়িঘর, কৃষিজমি।
কয়রার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নে গাববুনিয়া বেড়িবাঁধের মতো মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা, হরিণখোলা-ঘাটাখালী, মহারাজপুর, কাশিয়াবাদ, দশহালিয়া এলাকায় বেড়িবাঁধ নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাওনেওয়াজ শিকারী জানান, সারা বছর ধরেই ঠিকাদারের মাধ্যমে বাঁধের সংস্কারকাজ হয়। কিছু যেনতেনভাবে সংস্কারকাজে সরকারি বরাদ্দের লুটপাট ছাড়া সাধারণ মানুষের লাভ হয় না। আগে বাঁধের নিচে ৬০ ফুট চওড়া ছিল। ঢালের মতো বাঁধের উপরের অংশে ছিল ১০-১২ ফুট। এখন ঠিকাদার-ওয়াপদা (পানি উন্নয়ন বোর্ড) কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বাঁধের নিচের মাটি এস্কাভেটর দিয়ে কেটে ওপরে সংস্কার করা হয়। এতে বাঁধের উপরে ১০-১২ ফুট ঠিক থাকলেও নিচের দিকে মাটি কমে যাওয়ায় বাঁধ দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে বাঁধ সংস্কারের কিছুদিনের মধ্যেই পানির তোড়ে সহজে বাঁধ ভেঙে যায়।
জানা যায়, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নে কালীবাড়ি, গিলাবাড়ি সিংহের কোনা, হড্ডা চৌকিদারপাড়া, আলোর কোলসহ ১০-১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। বাঁধ ভাঙলে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়ে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হবে।
এদিকে বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপ তৈরি হওয়ায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে উপকূলে। আবহাওয়া অফিস বলছে, সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপে রূপ নিয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপপরিচালক শামীম হাসান বলেন, নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলে তা বাংলাদেশের সুন্দরবন, খুলনা এবং তৎসংলগ্ন কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চল দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে ২৬-২৭ মে ঝড়টি হতে পারে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে।
অপরদিকে সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কাজ শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা। খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছার ৬০৪টি আশ্রয় কেন্দ্র ও ৩টি মুজিবকেল্লা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন উপজেলায় ৫ হাজার ২৮০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত থাকতে প্রয়োজনীয় নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে।
৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ : ঘূর্ণিঝড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন খুলনাসহ উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার মানুষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট সাতক্ষীরার প্রায় ৫১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। নদ-নদীতে পানির চাপ বাড়লে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) খুলনা পওর বিভাগ-২-এর আওতায় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। কয়রার মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা ও হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় দুই কিলোমিটার বাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। মহারাজপুর, কাশিয়াবাদ, মঠেরকোনা মঠবাড়ি দশহালিয়ায় দুই কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। দাকোপে সুতারখালি, কালাবগী, চেয়ারম্যানবাড়ি, বটিয়াঘাটা বুজবুনিয়ায় বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-১ ও ২ আওতায় ১৩ কিলোমিটার ও বাগেরহাটে আরও ১৫ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
বরাদ্দের টাকা নয়ছয়, টেকসই বাঁধ হয় না: খুলনার দাকোপ উপজেলার ৩২ নম্বর পোল্ডারের ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও দুই কিলোমিটার নদীশাসন কাজে গত কয়েক বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন একই বাঁধ সংস্কারে আরও ১৫২ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে পাউবোর পক্ষ থেকে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পটি সার্ভে হয়েছে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নদীর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। ফলে আরও ছয় কিলোমিটার জায়গা নদীশাসনে আনা প্রয়োজন। এতে প্রায় ১৫২ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
একইভাবে ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৪-২০১১ পর্যন্ত সমন্বিত টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯৮-২০০৫ সালে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প পোল্ডার নং-৩৪/২ (অংশ) (আমিরপুর-ভাণ্ডারকোট-বালিয়াডাংগা) সংস্কারকাজ বাস্তবায়িত হয়।
বর্তমানে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটার বিভিন্ন অংশে বাঁধ মেরামত কাজ চলছে। খুলনা পওর বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম জানান, উপকূলীয় এলাকায় বন্যা ব্যবস্থাপনায় বাঁধ মেরামত ও টেকসই করতে নিয়মিত সংস্কারকাজ চলছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোথাও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের জন্য জিও ব্যাগ, সিনথেটিক ব্যাগ মজুত রাখা হয়েছে।
টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি স্থানীয়দের: বেড়িবাঁধ নিয়ে সমন্বয় সভায় আসেন না পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। ঠিকাদারদের মাধ্যমে যেনতেনভাবে বাঁধ সংস্কার করা হয়। স্থানীয়দের বাঁধ নির্মাণকাজে সম্পৃক্ত করা হয় না। কেউ টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি তুললে ঠিকাদারের কাছে চাঁদা চাওয়া হয়েছে বলে তাকে হয়রানি করা হয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পরপর কয়েক বছরের দুর্যোগ ও নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। বিলীন হয়েছে বাজার, চলাচলের রাস্তাসহ একাধিক স্থাপনা। আর এ ভাঙন মোকাবিলায় পাউবোর জরুরি সংস্কারের নামে গা ছাড়া কাজ চলছে সারা বছর ধরেই। বেড়িবাঁধ রক্ষায় এলাকায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানানো হলেও কার্যকরী পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভাঙনে বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যায়।