![রাবার বাগানে লোকসান ৫৭ কোটি টাকা](uploads/2024/02/20/1708416635.habigonj.jpg)
দেশে ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত রাবার বাগানের একটি হবিগঞ্জের শাহজীবাজার রাবার বাগান। ২ হাজার ১০৪ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা বাগানটি একসময় লাভজনক থাকলেও ২০১৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৭ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে।
বাগান কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪ কোটি ৫৭ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪ কোটি ৭০ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ কোটি ২৬ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ কোটি ৬৪ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ কোটি ৮৮ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭ কোটি ৮০ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ কোটি ৭৪ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ কোটি ৭১ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।
অপরিকল্পিতভাবে বাগান পরিচালনা, গাছের জীবনচক্র শেষ হওয়া এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া লোকসানের বড় কারণ বলছে বাগান কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ থেকে ৩২ বছর পর্যন্ত একটি রাবারগাছের কষ দেওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা থাকে। কিন্তু শাহজীবাজারের গাছগুলোর বয়স ৪০ বছরের বেশি। ফলে এক দশক আগেই কষ দেওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বাগানটি। যে কারণে কষ সংগ্রহের পরিমাণ দিনদিন কমছে।
শাহজীবাজার রাবার বাগানে নিয়মিত ২৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তবে বাগানের কাজ করার সময় সাপ-বিচ্ছু, বিষাক্ত পোকামাকড় ও বন্যজন্তুদের আক্রমণের শঙ্কা থাকলেও ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধারও অভাব রয়েছে এসব শ্রমিকের।
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে এই বাগানে কাজ করেন আব্দাল মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে চলা বর্তমান সময়ে অনেক কঠিন। এ ছাড়া আমাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাও নেই। প্রতি বছর শীত মৌসুমে আমাদের জুতা, গ্লাভস, রেইনকোট দেওয়ার কথা। কিন্তু কোনো কিছুই দেওয়া হয় না। সুযোগ-সুবিধার কথা বললে, আমাদের বলা হয় বাগান লোকসানে আছে।’
বাগানের সহকারী মাঠ তত্ত্বাবধায়ক শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘গাছ থেকে কষ সংগ্রহের পর রাবার প্রসেসিং শেডে আনা হয়। এখানে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরল কষকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কিন্তু এই বাগানে যে যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় সেগুলো অনেক পুরোনো। আধুনিক যন্ত্রাংশ না থাকায় একদিকে রাবারের শেড তৈরি করতে গিয়ে সময় বেশি লাগছে, অন্যদিকে কমছে রাবারের গুণগত মান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাগানের গাছগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বয়স বেশি হওয়ায় গাছগুলোতে যথেষ্ট কষ আসে না। সেই সঙ্গে অর্ধেকের চেয়ে বেশি গাছ থেকে এক ফোঁটা কষও পাওয়া যায় না। সেগুলোতে পোকামাকড় আক্রমণ করেছে।’
বাগানের ব্যবস্থাপক নন্দী গোপাল রায় বলেন, ‘অনেক কারণে বাগানটি দিনের পর দিন লোকসান গুনেছে। এর মধ্যে তিনটি বড় কারণ অপরিকল্পিতভাবে বাগান পরিচালনা, গাছের জীবনচক্র শেষ এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া লোকসানের বড় কারণ। গত ১০ বছরে রাবার উৎপাদনে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে শাহজীবাজার বাগানে প্রতিকেজি রাবার উৎপাদনে খরচ হচ্ছে সাড়ে ৩০০ টাকার বেশি। বিপরীতে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকায়।’
তিনি বলেন, ‘রাবার মূলত কৃষিপণ্য। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এটিকে শিল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় শুকনো রাবার বিক্রির সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৪ শতাংশ আয়কর পরিশোধ বাধ্যতামূলক। এনবিআরের এমন সিদ্ধান্ত রাবার শিল্পের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।’
নন্দী গোপাল রায় আরও বলেন, ‘বাগানটিকে লাভজনক করতে ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা প্রস্তাব রাবার বোর্ডে পাঠিয়েছি। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে। যদিও ইতোমধ্যে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। যেমন, পরিত্যক্ত গাছ কেটে দেড় হাজার হেক্টর জায়গাজুড়ে নতুন চারা লাগানো হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বাকি বাগানও এভাবে পুনর্বাসন করা হবে।’
অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে রাবারকে সাদা সোনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রাবার দিয়ে বিশ্বের প্রায় ৪৬ হাজার পণ্য তৈরি হয়।
বাংলাদেশে রাবার শিল্পের যাত্রা শুরু ১৯৬০ সালে। দেশে প্রতি বছর রাবারের চাহিদা প্রায় ২০ হাজার টন। এর বিপরীতে দেশে বছরে উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ১১ হাজার টন। এর মধ্যে সরকারি বাগান থেকে বছরে ৬ হাজার টন এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান থেকে ৫ দশমিক ৫০ হাজার টন রাবার উৎপাদন হচ্ছে। বাকি রাবার আমদানি করতে হয়।