তাহমিনা পারভীন শ্যামলী, বগুড়ায় নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম। যারা এ শহরের বাসিন্দা বা বগুড়ায় যাওয়া-আসা করেন তাদের অনেকেই তাকে চেনেন সদালাপী একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। বগুড়া শহরের মফিজ পাগলার মোড় এলাকায় তিনি রোচাস হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করছেন প্রায় ৫ বছর ধরে। বগুড়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি নাহিদুজ্জামান নিশাদসহ আরও কয়েকজন এ হোটেলটি প্রতিষ্ঠা করলেও রোচাস পরিচালনার দায়িত্বে আছেন শ্যামলী।
তিনি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টেকনিক্যাল এডুকেশন বোর্ড (বিটিইবি) ও ন্যাশনাল স্কিলস ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এনএসডিএ) থেকে রান্না করা, খাদ্যমান ও পরিচালনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও কোর্স শেষ করেছেন। এখন তিনি পড়ালেখা করছেন প্রশিক্ষক ও পরীক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। ১৯৯২ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে। বগুড়া শহরে সবচেয়ে মানসম্পন্ন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ভিএম বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল হিসেবে পরিচিত। হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি তিনি সম্পাদনা করেন ‘সূর্য তোরণ’ নামে সাপ্তাহিক একটি পত্রিকা। সাংবাদিকতাতেও ভালো করতে চান শ্যামলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ালেখা করছেন সান্ধ্যকালী মাস্টার্স কোর্সে। ইতোমধ্যে প্রথম সিমেস্টার শেষ করেছেন।
কেন হোটেল মোটেল ব্যবসায় আসা এ প্রশ্নের জবারে শ্যামলী বলেন, ‘বাবা তাইফুল ইসলাম তোফা ১৯৭৯ সালে বগুড়ায় প্রথম শুরু করেন চাইনিজ রেস্তোরাঁর ব্যবসা। সে সময় ওই ব্যবসায় যে জৌলুস ছিল তাই আমাকে হোটেল ও রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় আকৃষ্ট করে। আমার বাবা তাইফুল ইসলাম তোফা বগুড়া শহরের মফিজ পাগলার মোড় এলাকায় বগুড়ায় প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট বৈকালী প্রতিষ্ঠা করেন। একটা সময় রেস্টুরেন্টি বন্ধ করে দেন। পরে শহরের সাতমাথা এলাকায় সপ্তপদী মার্কেটে ১৯৮৬ সালে শুরু করেন ম্যান্ডোলিন হোটেল অ্যান্ড চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পারিবারিক ঐতিহ্য হওয়ায় আমি তা ধরে রাখার চেষ্টা করছি।’
হোটেল-মোটেল আর রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন এ প্রশ্নের জবাবে তাহমিনা পারভীন শ্যামলী বলেন, ‘প্রথম বাধা আসে পরিবারের পক্ষ থেকে এরপর অর্থনৈতিকসংকট মোকাবিলা করতে হয়। ব্যাংক কম সুদে সহজ শর্তে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিলেও আমাদের মতো নারীদের ঋণ পাওয়া সহজ ছিল না। মানসিক শক্তি আর কাছের মানুষদের প্রেরণায় সকল সংকট দূর করেছি। আর্থিকসংকট মোকাবিলার জন্য পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করেছি।’
১৯৯৪ সালে বাবা তাইফুল ইসলাম তোফা মারা যাওয়ার পর তার রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠান ম্যান্ডোলিনেই তার হাতেখড়ি। টানা কয়েক বছর ম্যান্ডোলিন পরিচালনার পর শহরে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শুরু হলে ম্যান্ডোলিন হোটেলের কিছু অংশ হুকুমদখল করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় তার প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সালে রানার প্লাজা বিপণিবিতানে ম্যান্ডোলিন ক্যাফে নামে নতুন আরেকটি রেস্তোরাঁ দেন। সেখানে তিনি বিক্রি করেন চাইনিজ ও ফাস্ট ফুড। তিনি একই সঙ্গে পরিচালনা করেন ম্যান্ডোলিন ক্যাফে ও রোচাস।
শ্যামলী তার পাশাপাশি অন্য নারীদের উদ্যোক্তা করতে প্রায়ই আয়োজন করেন নানা ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও মেলার। নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে কী কী করছেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত তিন বছরে অন্তত ২৫টি কর্মশালার আয়োজন করেছি। পিঠা আর গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবার নিয়ে আয়োজন করেছি অন্তত ১২টি মেলার। এসব মেলায় যারা এসেছেন তাদের অনেকেই এখন সফল উদ্যোক্তা, যেমন এনএস ফুড কর্নার ও রিদিস ডাইন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব আয়োজনের উদ্দেশ্য নারীদের সাবলম্বী করার পাশাপাশি গ্রামীণ সাংস্কৃতির বিকাশ আর ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা। এ ছাড়া রেসকিউ আওয়ার পিপল এভার (রোপ) নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। প্রতিষ্ঠানটি নারীদের উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ এবং সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ নিয়েও কাজ করছে। রোপ ইতোমধ্যে বগুড়ায় কর্মরত ৩০ জন সাংবাদিক নিয়ে এক দিনের মৌলিক সাংবাদিকতাবিষয়ক একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে।’
নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেছে রোপ। সমাজসেবা ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে নিবন্ধন করা বেসরকারি এ উন্নয়ন সংস্থা আর্থিকসংকটের কারণে লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না। তবে ব্যক্তিগতভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব কিছুর পাশাপাশি পরিবেশ নিয়েও কাজ করছেন শ্যামলী। আরও নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য কী প্রয়োজন এ প্রশ্নের জবাবে শ্যামলী বলেন, ‘নারীদের আরও সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। সেই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন বারবার সুযোগ-সুবিধা না পায়। নারীদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এসব কাজ তার পক্ষে অনেকটাই করা সম্ভব যদি রোপকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করা যায়। একা ভালো থাকার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, অন্যকেও ভালো রাখা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব তাই অন্যকে ভালো রাখতে তাদের দায়িত্ব নিতে চাই।’
রোচাস রেস্টুরেন্টে কী ধরনের খাবার পাওয়া যায় এ প্রশ্নের জবাবে শ্যামলী বলেন, ‘দেশীয় সব ধরনের খাবারের পাশাপাশি পাওয়া যায় চাইনিজ, ইতালিয়ান, আমেরিকান ও কন্টিনেন্টাল খাবার। তবে বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবারের মধ্যে সামুচা ও কালাভুনা খিচুরি সুনাম অর্জন করেছে রোচাস। বগুড়ার মতো একটি শহরে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা কোনোভাবেই সহজ ছিল না। পদে পদে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। হোটেল রেস্তোরাঁর ব্যবসায় নারীদের সম্পৃক্ততা আমাদের সমাজ সহজভাবে নেয় না, এটি একটি বড় সমস্যা। তবে এ সমস্যা আমি পার করতে পেরেছি রাজনীতিবিদ বাবার সুনাম ও প্রভাব পতিপত্তির কারণে। কিন্তু সাধারণ নারীদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই এ বাধা ডিঙানো সহজ হয় না। সে কারণে তারা ব্যবসা শুরু করলেও টিকে থাকতে পারে না।