বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, স্বর্ণে যেমন খাদ রয়েছে তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপির হিসাব পরিমাপেও খাদ রয়েছে। প্রশ্ন করে তিনি বলেন, দেশে বিনিয়োগ নেই, ঋণের প্রবৃদ্ধিও শ্লথ গতি। তাহলে এত প্রবৃদ্ধি কী ভাবে হয়।
তার মতে, এই হিসাব অতিমূল্যায়িত করে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এটি যদি সত্যি হয় তাহলে উন্নয়নের হিসাব, ঋণের হিসাব এবং রাজস্ব আদায়ের হিসাব-এসবকিছুই কম হবে।
মঙ্গলবার (৭ মে) ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) কার্যালয়ে আয়োজিত সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন স্মারক বক্তৃতায় প্রধান আলোচক হিসেবে ড. দেবপ্রিয় এসব কথা বলেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, যে হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সে অনুযায়ী কর আদায় হচ্ছে না। যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তা শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ দিয়ে হয়েছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নাই, কর নাই, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়েনি। অথচ জিডিপি বেড়েছে। আমি পূর্বেও বলেছিলাম এই যে অতিমূল্যায়িত জিডিপি একদিন গলার কাঁটা হয়ে পড়বে। বলেছিলাম বৈদেশিক ঋণ একদিন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এখন কি হয়েছে? পাঁচ বিলিয়ন ডলারের পরিশোধযোগ্য ঋণ ফেরত দিতে পারছেন না। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে বিদেশি কোম্পানিকে মুনাফা প্রত্যাবাসন করতে দিতে পারছেন না। ফলাফল কি হলো! বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আমাদের যে সুনাম এতদিন ছিল তা আমরা হারাতে বসেছি।
পদ্মা সেতু আমাদের গর্ব- এ কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এর পাশাপাশি ব্যর্থতার গল্পও আছে। আমাদের বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়নি, নারী নির্যাতন বেড়েছে, মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে সঞ্চয় ভেঙে বা দেনা করে চলছে সাধারণ মানুষ, গড় আয়ুষ্কাল কমেছে, শিশুমৃত্যু-মাতৃমৃত্যু বেড়ে গেছে, করোনার পরে ধার করে চলা খানার সংখ্যা বেড়েছে এবং সর্বোপরি, খাদ্য নিরাপত্তাহীন পরিবারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এসব তথ্য স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করতে হবে।
তিনি বলেন, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতি তিন মাস পর জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসেবে গত অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২৩ প্রান্তিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ হিসেব এখন নিয়মিত প্রকাশ হওয়ায় আমরা অনেকগুলো সূচক সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছি। এ হিসাবটা প্রকাশ যেন বন্ধ হয়ে না পড়ে সেদিকটা বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রমাণ আছে এর আগে একবার পরিসংখ্যান ব্যুরো নিয়মিত প্রতি প্রান্তিকে জিডিপি অনুমিতি প্রকাশ করার পর স্পর্শকাতর তথ্য জানাজানি হয়ে যায় বিধায় তা বন্ধ করে দিয়েছিল।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, এসব নিয়ে রাজনীতিকরা কথা বলার কথা ছিল। কিন্তু তারা বলেন না। কারণ কি? কারণ হলো তারা আমলাদের ভয় পান। তারা হয় জনগণের কস্ট বা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বুঝেন না অথবা বুঝতে চান না।
তিনি বলেন, এসব সরকারের তথ্য। অর্থনীতির পরা বাস্তবতায় এসব তথ্য যেন হঠাৎ আলোর ঝলকানি। রোদে চশমা লাগিয়েও এ আলো থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। আমি বলব, অর্থনীতির এই চরম দুঃসময়ে আর্থসামাজিক এসব সূচক একটি মন্দার ইঙ্গিত দেয়। সরকারকে বৈদেশিক ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের দিকে যেতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অংশীদার হলো জাপান। আমাদের এবারের বড় শক্তি হলো ধানের ভালো ফলন। খাদ্য সংগ্রহ করে স্টক করুন। তাহলে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জনগণ স্বস্তি পাবে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আপনারা গণমাধ্যমে প্রতি বছর লিখে থাকেন যে বাজেট বাড়ছে। মেগা বাজেট আসছে। কিন্তু প্রকৃত বাজেট গত ১৫-২০ বছরে বাড়েনি। প্রতিবার এ বাড়তি বাজেটের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বিপাকে পড়ে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ, এনবিআর। তিনি বলেন, দাবি করা হচ্ছে যে কর বেড়েছে। আরও বাড়ানোর কথাও শুনা যাচ্ছে। এই যে কর বাড়ল এবং আরও বাড়ানো হবে সেটা কখন হচ্ছে। এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন অর্থনৈতিক মন্দা বা সংকট চলছে। এটিও তো ভালো হলো না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকেও বাঁচাতে হবে। সে উদ্যোগও বাজেটে থাকতে হবে। পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতার বালাই নেই। কোন কোম্পানি টাকা তুলে নিচ্ছে তারও যাচাই বাছাই ঠিকমতো হয় না। বিনিয়োগকারীদের আচরণ ঠিক নেই। ফলে সব সময় একটা অস্থিরতা থাকেই।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমি মনে করি বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি। এ জন্য আপনাকে সমালোচনা সইতে হবে এবং তা আমলে নিতে হবে। তাহলেই কেবল এ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আইএমএফ-এর কারণে আমাদের ভর্তুকি কমাতে হবে। এটি সমন্বয় করতে হবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া আর্থিক নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। ফলে আমদানি-রপ্তানি, বৈদেশিক ঋণ এবং তা পরিশোধে বিনিময় হারের গুরুত্ব প্রতিফলন ঘটে না। এটি যেন এক পরাবাস্তবতা। এখানে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা খুবই জরুরি। আমাদের ক্রমান্বয়ে সুদহার ও বিনিময় হারে নমনীয় নীতির দিকে যেতে হবে। তিন-পাঁচ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়াতে পারবেন না। কারণ রেমিট্যান্সের টাকায় এখন শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে। বিনিময় হার নমনীয় না করলে হুন্ডি বন্ধ করতে পারবেন না। আবার সুদের হার বাড়িয়ে শিল্পের উৎপাদনও বাড়াতে পারবেন না।
ড. দেবপ্রিয় সরকারের কাছে দাবি করেন কার্ডে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের সুবিধাভোগীর নাম কেন্দ্রীয়ভাবে বা সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হোক। তিনি বলেন, এতে করে কারা এসব কার্ডের সুবিধা পাচ্ছেন তা যেমন প্রকাশ হবে তেমনি কারা পাওয়ার যোগ্য অথচ পাচ্ছেন না সেটিও জানা যাবে। এটি দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক ও খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ হবে।
আইএমএফ প্রসঙ্গে বলেন, সংস্থাটি বিভিন্ন শিল্প থেকে অব্যাহতি তুলে দেওয়ার কথা বলেছে। আমি মনে করি, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে এই কাজটি করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে জনজীবন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এমএমই, গ্রামীণশিল্প ও বিকাশমান শিল্পের কর সুবিধা বহাল রাখতে হবে। আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৩ শতাংশ, শিক্ষায় ২ শতাংশ ও স্বাস্থ্যে ২ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করেন তিনি। একই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।