ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

মনোবৃত্তের কৌণিক বিন্দু

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০১:৪৪ পিএম
আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০১:৪৪ পিএম
মনোবৃত্তের কৌণিক বিন্দু
অলংকার: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

কৃষ্ণপক্ষের আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। জ্যৈষ্ঠের ফলঘ্রাণ মাটি, বাতাসে এখনো ম ম করলেও আষাঢ় ইনিয়ে-বিনিয়ে গা মাখাচ্ছে ভরপুরে। রাত নেই, দিন নেই, মনের মাধুরী মেশানো ছন্দে বৃষ্টি নামার আয়োজন করে। সেই অসময়ের আষাঢ়ে অন্ধকার আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি তলোয়ারের মতো। মনে হয় কেউ ছুরি চালাচ্ছে জমে যাওয়া ঘন কালো মেঘ বিচ্ছিন্ন করতে। অক্লান্ত সম্মুখ মাঠ যোদ্ধার তলোয়ার থামে না- এক দিগন্ত থেকে ধেয়ে আসে অন্য দিগন্তে। জবেদ যখন তাহেরাকে দেখে তার বুকেও আকাশের বিদ্যুতের ঝলকানির মতো বয়ে যায়। ইছরেপাকা আষাঢ়ের বজ্রপাতের মতো ঝাকুনি দেয় শরীর। চোখের দেয়ালের টেরাকোঠায় আঁকা কামদেবী তাহেরাতে হাত-পা স্থির হয়। 

জবেদের পাকা শরীর। শিলবিলাতি আলুর মতো খণ্ড খণ্ড মাংসপেশি। দেমাগওয়ালা যজ্ঞী বাবুর পাঠার মতো নাচনবাচন। সুলতানের ছবির মতো তার দেহ গড়ন। প্রান্তিক কিন্তু ধ্রুপদী, এলেবেলে সাংহারি। তার দুহাতে কত স্তনে চাপ দিয়েছে তা জবেদ নিজেও হিসাব করে বলতে পারবে না। পাড়ার ঠাট্টা সম্পর্কের খায়েসওয়ালা রসিয়া ভাবি, মেলার ভিড়ে জড়ো হওয়া সদ্য যুবতীদের টার্গেট করত সে। তাহেরা তার সম্পর্কে শালি হয়। বিয়ে হলেও সংসার টেকেনি। কেমনে ঠিকবে? দশ-এগারো বছরে রজঃ শুরু হয়। তারও আগে গ্রামের তাগড়া মরদ ভাণ্ডারীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাহেরার। পুতুল বোঝার আগে স্বামী। ভাণ্ডারী শ্বশুরবাড়ি এলে দাদি সম্পর্কের মহিলারা তাহেরাকে জোর করে ভাণ্ডারীর সঙ্গে ঘরে ঢুকিয় দিত- অসন্তুষ্ট ভাণ্ডারীর অপেক্ষা সহ্য হয় না। ক্রমেই সুসম্পর্ক দূর সম্পর্কে রূপ নেয়। কিশোরী তাহেরাকে রেখে ভাণ্ডারী এক সমন্ধির বউকে নিয়ে চম্পট দেয়। হই হই রই রই পড়ে যায় পুরো বজরার চরে। লোকজন খোশগল্প জমায়-

-নটা-নটির কারবার-
-কলিকাল এমনি বলে-
-চিকন রাস্তায় ঢোকন কাল-সোমন্বির বউয়ে ধরল হাল।
-সোনার লাঙল-জমি না মেলে-এগ্লা তো হবই।
টং দোকানের আমুদে গল্প দীর্ঘায়িত হয়।
-ক্যা! তারার বউয়ের তিনটা ছাওল-চাষ কী লাঙল ছাড়াই হইছে।
-লাঙল হলই কী অয়-তেরছা শিকশিক্যা ফালি লাগে। ফালির যত ধার-জমির মাটি তত ইধার-উধার।

জনগালগল্প ছড়িয়ে পড়ে। তাহেরার বাপ মুখ দেখাতে পারে না। একটা আস্ত পাথর ভার হয়ে তার ঘাড়ে উঠে পড়ে। সেই ভারে পুরো শরীর ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা। মেয়ের লজ্জা যে বাপের মরণসম। পুত্রপিতা তেমন লজ্জাবোধের ক্লেশে ভোগেন না- বরঞ্চ নারীঘটিত বেপারগুলোতে অপেক্ষাকৃত হালকাভাবে পুত্রপিতার লজ্জাস্খলন অনুভূতি দেখা যায়। তাহেরার শেষঅব্দি বজরাচরে স্থির হওয়া হয় না- জীবনস্বপ্ন বিঘ্নিত পিতা জনলজ্জা ঢাকতে তাহেরাকে ঢাকায় পাঠায়। ঠাঁই হয় বোনের কাছে। সময়ের ঘোরে বছর বাড়ে-তাহেরাও বাড়ে বুকে-পিটে। ছোঁয়াছে সময়ের দ্বিপশিখা জ্বালানো শরীরে সক্রিয় হয়ে উঠে আস্ত তাহেরা। পূর্ণ আষাঢ়ে ভরা জলের প্লাবন নামে জমিনে। হাঁসফাঁস করতে থাকা মাটির শিরায় শিরায় পানির সে ধারা প্রবাহিত হতে থাকে- প্রকৃতি মেলে ধরে তার জিওন কাঠির পরশে প্রকাশযোগ্য সমস্ত ঐশ্বর্য- নারী ঐশ্বর্য- পরিণত তাহেরাকে।

যুবতী তাহেরা বোনের সঙ্গেই থাকে। পাশাপাশি রুমে। বেশ কয়েকবার সুযোগ পেলেও তাহেরার প্রস্ফুটিত মাংসপিণ্ড জবেদের হাতের তালুয় জব্দ হয়নি। জবেদের ছোঁকছোকানি কমে না। সে সুযোগ খুঁজে। মোবাইলে টিকটকের গরম ভিডিওর গান জোরে বাজায়- চিল্লায় বলে,

-ফকিন্নির পুতেরা কী বানায় এগ্লা। কার্তিকের কুত্তা সঙ্গম লাগছে মোবাইলের ভেতর। 
-টিকটক দেহিস নারে তাহেরা- খারার উপ্রে নষ্ট হয়া যাবি। 
জবেদ থামে- চ্যাড়মোড়া দিয়ে উঠে ঠাস করে দরজাটা লাগায় দিয়ে ব্লু ফ্লিম চালায় মোবাইলে। 
তাহেরার কান পর্যন্ত শব্দ যাতে পৌঁছায় ততটকু শব্দ ছাড়ে সে।

বস্ত্রহীন নটিদের শিরশিরে গন্ধম শব্দে জবেদ দিগছোটা হয়। কল্পনার ক্যানভাসে উচ্ছল তাহেরাকে এনে হাত মারে জবেদ-দিগ্বিদিকশূন্য জবেদ স্থির হয়- প্রমত্তা থেকে শান্ত নদীতে রূপ নেয়।

জবেদের শরীর পাঠার মতো হলেও ইনকামে ঢেমনা-ভাদাইম্মা। বউ গার্মেন্টস খেটে ইনকাম করে আর সে বসে বসে খায়। বউয়ের গালিগালাজের চাপে মাঝে মাঝে ভাড়া রিকশা খাটে। রিকশায় পুরুষ যাত্রী উঠতে চাইলে সে নিতে চায় না। টং দোকানে বিড়ি ফুকায়, চা খায়। রিকশার ছইয়ে ঠেস দিয়ে ঘুম পাড়ে। নারী যাত্রী পেলে রিকশা হাকায়। মোটরের রিকশা হাওয়ায় ভাসে- রিকশার ছোট আয়নায় স্তন যত দোল খায়- তার রিকশার গতি আরও বাড়ে। রাস্তা খানাখন্দ হলে তার আয়না থেকে চোখ সরে না। জবেদ ভাবে আয়নাটা ছোট হয়েছে আরও বড় সাইজের আয়না লাগাতে হবে। তার ইচ্ছা করে বউয়ের সাজন-গোজন করা বড় আয়নাটা রিকশার সামনে লাগিয়ে দেবে। যেন পুরো ছবিটা দেখা যায়- নবীনগরের সেনা টকিজের পর্দার মতো। জবেদ মাঝে সাঝে পেপার পড়ে কিন্তু তার একটি নির্দিষ্ট স্টাইলে। সে হয়তো একটা পান কিনেছে বা শিঙাড়া যা পুরনো পেপারে মোড়ানো। তার পান মুখে পুরে বা শিঙাড়াটা খাওয়া হলে সেটিই সে পড়া শুরু করে। যেমন আজ একটা কবিতা পেয়েছে। কিন্তু লেখকের নাম নেই। সে রিকশার সিটে পা তুলে ছইয়ে হেলান দিয়ে পড়তে শুরু করে..
আমার পুঁজি তোমার বুক

তোমার টোল পড়া হাসিটুকু।
যখনই ক্লান্ত হই
চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাও।
নীলাম্বরী পাখি হয়ে।
আবার ফিরে আসি 
লোনাজল পাড়ে-
অমীমাংসিত ঠোঁঠের উঠোনে- চুম্বনে আর চুম্বনে।

-দূর বাল, আজাইরা সব কবিতা- এক্করে ছাইপাশ। চোদনা কাব্য আর চোদনা কবি- বলে সে মুষ্টি করে ড্রেনের দিকে ছুড়ে মারে কাগজটি। ময়লা ড্রেনে কবিতার টুকরো পাতা পড়ে থাকে। 

শুক্রবার ছুটির দিন হলেও জবেদের স্ত্রী সাহেনার ডিউটি থাকায় অফিসে গেছে। সকাল বেলা জবেদের সঙ্গে স্ত্রীর ভীষণ ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল। তাদের অভ্যস্ত ঝগড়া আজ একটু বেশি জোরালো হয়েছিল। জবেদ খাসি হলেও স্ত্রীর কাছে ঢোড়াসাপ। স্ত্রী সাহেনা ঝগড়ার সময় ছেনি-বঁটি নিয়ে মাঝে মাঝে তেড়ে আসে জবেদের দিকে। সাহেনা পার করে আসা বেলা-অবেলায় প্রাপ্ত সব অশ্রাব্য শব্দের পূর্ণ প্রয়োগ করে জবেদের ওপর। মুখে ব্যথা হওয়া অব্দি তার উপসংহারে সে আসে না।

-বেশ্যার পোলা লেংটা বঁটিতে তোর গলায় একটা পোজ দিয়া জেল খাটুম- 
-ইতরা চোদা। বান্দির পোলা-কাজে না গেলে আজ আইসা তোরে লেং মাইরা বাইর কইরা দিমু। তোর মতো খোদার 

খাসির দরকার নাই- ইচ্ছে করে লাত্তি মাইর‌্যা তোর হোলের বিচি ফাটাই দেই-
কথার তালে লাত্তি ছোড়া পা জবেদের ঊরু ছুঁয়ে যায়। সাহেনার লাত্তি থেকে বিচিসমেত হোল রক্ষা করে জবেদ কিছুটা বেঁচে গেলাম বোঁধ করে। কিন্তু সাহেনার মুখ চলতে থাকে। কথ্য-অকথ্য গালিগালাজ করে কাজে যায় সে। 

জবেদ কোল বালিশের মতো বেছানায় শুয়ে থাকে। তাহেরা এতক্ষণ ধরে পাশের রুমেই ছিল- রুটিন মাফিক তাদের ঝগড়া তাকে তেমন বিচলিত করে না। 

২.
তাহেরার লেই ফ্যাশন’স সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ থাকে। বিদেশি মালিকের পোশাক কারখানায় চাকরি করলে একটু শান্তি আছে। চাকরির অনেক নিয়ম-কানুন সেখানে তারা ঠিকভাবে পালন করে। শ্রমিকের সুবিধা-অসুবিধা দেখে। কিন্তু অসুবিধা অভারটাইম নেই। অভারটাইম না থাকলে বেতন যা দেয় তা দিয়ে সাভারের এই বর্ধিষ্ণু শহরে ঠিকে থাকা বড় মুশকিল। বাজারে এক ঘুরানি দিলে বেতন উধাও। পেটে-ভাতে কোনো মতে থাকা যায়। পেটে বালিশ বেঁধে থাকার চেয়ে পেটে-ভাতে থাকা কম কীসের! পেটে ভাত না থাকলে কত ভূতই ঘাড়ে এসে পড়ে। কাজ দিবার চেয়ে কাম চায় অনেকে। 

তাছাড়া তাহেরা তার বোন-দুলাভাইয়ের সঙ্গে থাকায় খরচ অনেকটা কম হয়। অনেক খরচ আছে তার বোন সাহেনা করে দেয়। তার দুলাভাই জবেদকে আগে অসহ্য লাগলেও এখন তার ভালোই লাগে। খুব খোঁজখবর রাখে তার। কিন্তু সে দুলাভাইয়ের কাছে খুব ঘেঁষে না। পুরুষে বিশ্বাস নাই। পুরুষ মানুষের মন-সাক্ষাৎ ক্ষুধার্ত বাঘ- চপলা হরিণ পেয়ে যদি কামড় বসিয়ে দেয়। এই তো গত মাসে এক নারী কলিগ তার খালাতো দুলাভাইয়ের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। 

দুজনই বিবাহিত-দুজনারই ছেলেমেয়ে আছে। বাচ্চা পোলাপানগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না। বাপ-মা থাকতেও এক্কেবারে এতিমের মতো। মানুষ খোঁচায় পলাটির ছেলেমেয়ে বলে। পিতা-মাতার এই অমোচনীয় অপবাদ আজীবন ধরে এই সন্তানদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহেরাও বোঝে তার দুলাভাই জবেদ তার দিকে কোন নজরে চায়। সে জানে তার বোনজামাই জবেদ কালো ভ্রমর- ফুল না ফুটলেও কলিতেই সে মধু খোঁজে। 

সকাল থেকে তাহেরা তার বোন-দুলাভাইয়ের ঝগড়া শুনলেও ঘর থেকে বেরোয়নি। ঝগড়া তাদের কাছে ডালভাত। দিনে একবেলা ঝগড়াঝাটি না করলে তাদের কারও পেটের ভাত হজম হয় না। তাহেরার ভয় করে- কোনদিন না আবার কোন অঘটন ঘটে যায়। পুরুষ মানুষের মাথা-রক্ত উঠলে যদি দায়ের কোপ বসিয়ে দেয় সাহেনার ঘাড়ে বা গভীর ঘুমে থাকা অবস্থায় যদি বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলে। এরকম নানান কুচিন্তা আসে তাহেরার। সে ঘর থেকে ডাক দেয়-

-দুলাভাই কি ঘুমে? খাইবেন না?
দেয়ালের ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না। তাহেরা ভাবে হয়তো তার দুলাভাই ঘুমে আছে- তাই শুনতে পাচ্ছে না। সে বাইরে এসে দেখে দরজায় ভেতর থেকে লক করা। 

দরজায় খোটান দিতে দিতে ডাকতে থাকে তাহেরা-
-কী ঘুমে কাইত গো- আবার খোটান দিয়ে ডাক দেয়,
-আরে তাড়াতাড়ি উঠেন- এক বান্ধবী আসব, নবীনগর যামু ঘুরতে।
নিয়া যাবেন না?
এতক্ষণ চুপ করে থাকা জবেদের মুখ খোলে-
-কাই যাইব রে?
-কহিনুর- ওই যে বোগড়ার মাইয়্যাটা-ফিনিশিংয়ে আমার লগে কাম করে, হেয়।
ওহ-
-ওরে না কইর‌্যা দে- আমার লগে তুই যাবি। রিকশায় দুজন চড়া যাইত না- শুধু তোরে লমুনে।
কী কন?
-হ- ঠিকই কই। মানা কইরা দে আর রেডি হ। 

আচ্ছা বলে তাহেরা জবেদকেও রেডি হতে বলে- তাড়াতাড়ি রেডি হন- বুবু আসবার আগেই আইতে হইব।
জবেদ টান মেরে দরজা খুলে তাহেরার সামনে এস দাঁড়ায়। পরনের লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বলে- দেরি হইত না- এক্ষুনি যামু।

৩.
মোড়ে মোজাফর ডাকনামে মজুর মনিহারি দোকান কাম হোটেল। প্রয়োজনীয় ঘর গৃহস্থালির প্রায় জিনিসই এখানে পাওয়া যায়। ভেতরে টেবিল চেয়ারে বসে চা শিঙাড়া-সামুচা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সকাল হলেই দোকানের মাথায় থাকা জিগার গাছে শালিক, কাকের মেলা বসে। দোকানের বিক্রি না হওয়া বাসী পরোটা খাবার হয় কিচিরমিচির করা পাখিদের। তেল পরোটার ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দের সঙ্গে বক্সে মমতাজের গান বাজে-

আমি লাইলীর প্রেমে পাগল পাড়ার একটা পোলা
চিপা চাপা জিন্স প্যান্ট পরা বুকের বোতাম খোলা
ডাবল কাটিং ফুল ফিটিং কানে পরছে দুল 
পাড়ার লোকে নাম রাখছে তার পাংকু আবুল।

মাঝে মাঝে সকালে করুণ ওয়াজ ছাড়েন, কখনো সুফি-মারফতি গান। ঢাকার কোনো এক ওরসের পীরের সেবক মজু। সেই দরবারের কিছু বয়ানও বাজান চক্রাকারে। মজুর মোড়ের মজুর দোকান একটা ছোটখাটো প্রান্তিক আশ্রমের মতো। ভিখারি, রিকশাচালক, অটো-মিশুকওয়ালা, আন্তঃজেলা-দূরপাল্লার ওস্তাদ-সাগরেদ-চ্যালা, বাইপাইলের ওভারব্রিজের নাইট শিফটের শিলা নটি, পাকারমাথার বিথী হিজরার দল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বটতলায় পড়াতে যাওয়া হোম-টিউটর আর গার্মেন্টস শ্রমিকরা তো আছেই। 

জবেদ-তাহেরা মজুর দোকানে ঢুকে কোনার টেবিলে মুখোমুখি বসে। 
-কী খাবা?
-আপনে খান- আমি খাইছি।
-দূর, আবার খাও। আজ পুরাদিন শুধু খাওন আর খাওন। 
-খাইবি না! রঙিন রূপভান।
-খাওনের জন্যি বার হইছি- সব খামু- সোনার চান। দেকুমনে কী খাওয়ান আপনে?

দুজনে ঐতিহাসিক যুগপৎ এক অবাঞ্চিত সময়ের ডেরায় চোখ বুলায়। তাহেরার চোখে-মুখে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো ঈষৎ আলোর রেখা খেলা করে। জবেদ হাত পাকায়- কাঁচা পাটের রসঝড়া দড়ির মতো। 
-মজু ভাই- তেলে ডুবাই চারটা পরোটা আর দুটো ডিম দেও- সাথে মুগডাল।

সাহেনা অফিস থেকে বাসায় আসতে সন্ধ্যা নামে। কম ওভারটাইম হলে মাগরিব বাদ বেশি হলে রাত ১০টাও বাজে। জবেদ খোঁজ নেয় সাহেনার আজ ফিরতে দেরি হবে। কোরিয়ান ইয়াংওয়ানের থেকে নতুন অর্ডার আসায় কাজের চাপ আছে- ১০টা-১১টাও বাজতে পারে। সময় যেন বিজলীর মতো ছুটছে আজ। মজুর দোকান থেকে বের হতেই দুপুরের কাছাকাছি। আর ঘণ্টখানেক পরই জোহরের আজান দেবে। জোহরের আজান দিলেই দিন আর থাকে না। তাহেরাকে রিকশায় চেপে নিয়ে টান দেয় জবেদ। রিকশা গ্যারেজ করে ঢুকে পড়ে নবীনগর পার্কে। শত মানুষের সঙ্গে মিশে যায় তারা। পশ্চিমের দিকে শিরীষ গাছের শান্ত ছায়ায় শরীর হেলান দেয়। সময় গড়াতে থাকে। কিন্তু শখের নারীর সময় কম- ঘরে ফেরার তাড়া তার। 

-বুবু আইব- চলেন যাই-
-দেরি হইব তোর বুবুর।
-আপনার সঙ্গে আইছি জানলে- কেলেংকারি রটি যাবে- এমনিতে ঘরপোড়া গরু।
-কেলেংকারে ভয় পাস তাহেরা?

তাহেরা চুপ থাকে- জবেদ এদিক-সেদিক তাকায়। নির্জনতা বুঝে জড়িয়ে ধরে তাহেরাকে। তাহেরার নরম মাটির দলার মতো স্তন হাতের মুটোয় ভরে নেয় জবেদ। তাহেরা ফুলে পড়া প্রজাপতির মতো নিশ্চুপ থাকে। পুরো দিন আপন রঙে রাঙিয়ে গা মাখানো অন্ধকারে বাসায় ফেরে দুজন। আগের স্তব্ধতা কেটে যায়- নতুন ভাবে গা মলাটের পৃষ্ঠা উল্টানো শুরু হয়। 

পুরনো জবেদকে এখন আর সাহেনা মেলাতে পারে না। সাহেনা যেমন জবেদ চায় তেমনভাবে জবেদ নিজেকে হাজির করে নিয়মিত। পুরনো গড়পড়তা নৈমিত্তিক ক্যাচালের কোনো মঞ্চায়ন নেই। জবেদের অলসতা নেই- দিন বিরানে কামাই রোজগারের মাত্রা বেড়ে গেছে। একজন পুরোদস্তুর আদর্শ স্বামী হিসেবে জবেদের চিত্রায়ণে মোহিত হয় সাহেনা। সাহেনা নিজেকে আশ্বস্ত করে। বোন তাহেরাকে ডেকে জবেদের প্রশংসা করে। একমাত্র দুলাভাই হিসেবে জবেদের যত্নআত্তি করতে বলে তাহেরাকে। তাহেরা সায় দেয় মাথা নেড়ে। জবেদের নদীতে ডুব দেয় তাহেরা-

চোখের কোণে কৈলাশটিলা
মরি ডুবে জলে।
হাত বাড়িয়ে দাও গো ভ্রমর
নাও না আমায় তুলে।

তাদের চোখ আড়ালের মাখামাখিতে দিন গড়ায়। আমরা তিনজনের মনোবৃত্তের কৌণিক বিন্দুর অবস্থান নির্ণয়ে সিদ্ধান্তের কাঁটাকম্পাস ঘোরাতে থাকি। সময় আরও গড়ায়-

শবেবরাতের ছুটি কাটানোর দুই দিন পার হলেও অফিসে যায়নি সাহেনা। অফিস থেকে ফোন করলেও ফোন ধরেনি সে। স্বামী জবেদের নম্বরে ফোন করলেও সে নম্বর বন্ধ দেখায়। সেদিন মজুর দোকানে কাক, শালিক ডাকার আগেই পুলিশের একটি ভ্যান এসে দাঁড়ায়। সাহেনা যে বাসায় থাকে সে বাসা থেকে কীসের যেন ছ্যাচানি পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। রাতেই ফোন করে আশুলিয়া থানায় খবর দিয়েছিল কেউ। পুরো বাসাটি বাইরে থেকে তালা মারা। পুলিশ তালা ভেঙে ভেতরে ডোকে। গন্ধ বের বের হচ্ছে তাহেরা যে রুমে থাকত সে রুম থেকে। পুলিশ সেটি ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এলোমেলো ঘরের মেঝেতে শরীর ফুলে দুর্গন্ধ ছড়ানো সাহেনার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৫ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম
বাংলাদেশ

তোমার দুচোখ ক্লান্ত ভারী, চুলও এলোমেলো
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে উড়ে মেঘের দেশে গেল
ঘুমাওনি কি কাল সারা রাত চোখের কোনে কালি
অনাদরে কাটছে সময়? দেয়ালজোড়া বালি?

দণ্ড

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৩ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম
দণ্ড

ডাকলে যদি ফিরলে কেন তবে?
স-ব দ্বিধা মেঘ ঝেড়ে ফেলে
              দাঁড়িয়েছিলাম সবে।

যেই মেলেছি আলোকিত ভোরের দিকে চোখ,
কিন্তু কেন আকাশজুড়ে নামল ব্যাকুল শোক?
সেই শোকেতে জীবনভরা নিমজ্জিত রই,
দিয়েছিলাম কবে তোমার পাকা ধানে মই?

দণ্ড দিলে দণ্ড নিলাম দু’হাত পেতে আমি,
তার বদলে সারা জীবন সুখে থেকো তুমি!

এসো তবে রাগ-বেহাগে

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪০ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪০ পিএম
এসো তবে রাগ-বেহাগে

আমায় নিয়ে চলছে এখন দয়াল রসের খেলা…
তোমার সঙ্গে মেলে না আর রৌদ্র-বৃষ্টির কোনো একটি বেলা?
তুমি থাকো সোমেশ্বরী কিংবা ধরো কংস পরপারে
যমনগরে তোমার পাশে, থাকি আমি- ডাকি বারে বারে।

যখনই আমি দেখব বলে মুখটি বাড়াই ধীরে
তুমি তখন বিরল-পাখি যাও চলে যাও আরও দূরে 

মৃত্যুরূপে আসো যদি, প্রণয়বিধুর, বন্ধু তো হও আগে!
যখনই হোক- এসো তবে মাতৃরূপেন রাগ-বেহাগে…

বহুমূত্র

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২৪ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২৪ পিএম
বহুমূত্র
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

পিঠ চুলকাচ্ছে, কিন্তু হাত পেছনে নিতে পারছিল না ফজর আলি। এতটাই চুলকাচ্ছে, কোথাও দাঁড়িয়ে-বসিয়েও থাকতে পারছিল না সে। অগত্যা সরু এবং কিছুটা মসৃণ একটা আমগাছের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে ঘষতে লাগল। এতটাই ঘষাঘষি করল পিঠের ছাল-চামড়া উঠে প্রায় রক্তাক্ত; যা দেখে আমগাছও বেকুব।

তখন প্রায় দুপুর। চোত মাসের ঠা ঠা গরম। তবুও তার ঘন ঘন হিসু চাপছিল। লুঙ্গির কাছা তুলে আমগাছের গোড়াতেই সোঁ সোঁ করে বদনাখানেক হিসু করল সে; যা দেখে আমগাছ আরও বেকুব। আমগাছের মতো সে নিজেকে বেকুব ভাবল  না; বরং মজাই পাচ্ছিল; কারণ, দেখতে না দেখতে পিঁপড়েরা সারি বেঁধে তার হিসুর আশপাশ জড়ো হচ্ছিল। প্রায় দেড় যুগ ধরে খেয়াল করছে বিষয়টা; তবে আজকের মতো নয়। কোত্থেকে এত এত পিঁপড়ে এসে হাজির! তার হিসুতে চিনি আছে নাকি, মনে মনে হাসল সে। 

বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, এখনো বিয়ে থা করেনি। শরীর ঝিমঝিম করা, হাত-পা জ্বালা, ঘাড় টনটন করা, মাথাঘোরা, চোখে অন্ধকার দেখা, ঘন ঘন হিসু- এগুলো দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু ডাক্তারের কাছে কখনো যায়নি সে। যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি। খুব বেশি কাবু মনে করলে পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতো। ডাক্তার তাকে তার নিজস্ব উদ্ভাবনী বটিকা সেবনের পরামর্শ প্রদানের পর খাদ্যতালিকাও ধরিয়ে দিত; যেখানে বেশি বেশি ভাত খাওয়ার কথা থাকত এবং শারীরিক দৌর্বল্য কাটাতে ইচ্ছেমতো আখের রস, গুড়ের সরবত কিংবা গ্লুকোজ।

তাতেও স্বাস্থ্য ফিরছিল না; বরং দিনকে দিন তালপাতার সেপাই বনে যাচ্ছিল। বাড়ির সবাই চিন্তায় পড়ল। বিশেষ করে তার মা। সবাই বলাবলি করল বিয়ে না দিলে তার স্বাস্থ্য ফিরবে না। কিন্তু যে বেটা বিয়ে করবে তার মধ্যে তো জোশ থাকতে হবে? তার মধ্যেই জোশ নেই। বিয়ের কথা শুনলে কেমন যেন গুটিয়ে যেত সে! ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাইত। চক্ষুলজ্জার ভয়ে পালাত না ঠিকই, বিয়ের সম্বন্ধ এলেই দূরে দূরে থাকত। কিন্তু এভাবে বেশি দিন দূরে দূরে থাকতে পারল না আর। পাশের গ্রাম থেকে সম্বন্ধ এলে পরিবারের সবাই জোর করে বিয়ের কড়া পরিয়ে দিল তার হাতে।

পাত্রী বেশ নাদুসনুদুস এবং খাটো। বেঢ়পও বটে; ছোটখাটো হস্তির মানুষরূপী সংস্করণ। গুনে গুনে ধাপ ফেলত; এবং যেখানে ফেলত সেখানকার মাটি আধা ইঞ্চি দেবে যেত। মাংসজাত খাবার এবং কুম্ভকর্ণের ঘুম তার পছন্দের তালিকায়। স্বামীগৃহে পা ফেলেই রান্নাঘরে ঢুকল সে। থালায় ভাত নিলে পোষায় না; তাই গামলায় ভাত নিয়ে শক্ত চেয়ারে বসে কাঁচালঙ্কাসহকারে জাবর কাটতে লাগল। নতুন বউ দেখার জন্য বাড়িতে মানুষের ঢল; সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে হাতিমার্কা পা দু-খানা দোলাতে দোলাতে জাবর কাটার কাজ শেষ করল; তার পর হাই তুলতে তুলতে, এ-বাড়ির ঘর-দরজা তার আগে থেকেই পরিচিত এরকম ভাব করে, ঘুমুতে গেল। 

বউমার এহেন আচরণে হতভম্ব শাশুড়ি দৌড়ে গেলেন রান্নাঘরে। ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা তোলার পর তার চক্ষুচড়ক। হাঁড়ির তলানিতে যে কটা ভাত পড়ে আছে তা চশমা ছাড়াই গোনা যায়। মাথায় হাত তুলে ছেলেকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ওরে ফজর আলি, দে হাত তালি। এরকম বউমাই তো চেয়েছিলাম রে। এতদিন খেয়ে খেয়ে শুকেছিস, এবার না খেয়ে খেয়ে শুকাবি। বউমার পেট ভরানোর মতো ধান গোলায় আছে তো?’

তিনি যতটা হতভম্ব তার চেয়ে ফজর আলি অনেক বেশি তার নবোঢ়ার ঘুমানো দেখে। শোয়ামাত্রই তার নাকের সরব গর্জনে পুরো ঘরটাই যেন কাঁপছিল। থেকে থেকে মুখ হা করে সাইলেন্সার পাইপের মতো ভোঁস ভোঁস করে বাতাস ছাড়ছিল; ফলে খাটের ওপর মশারির যে ছাদ বেশরমভাবে নাচানাচি করছিল। মাকে ডেকে এনে উঠোনের দিকে হা করা জানালার পাশে দাঁড়াল যেন ঘরের ভেতর মজাদার কৌতুক পরিবেশিত হচ্ছে। তারা তাদের চোখ সরাতে পারছিল না; কারণ, শুধু মশারির ছাদ নাচানাচি করছিল তা না, আলনায় রাখা কাপড়-চোপড়ও। হঠাৎ বউ তাদের দিকে পাশ ফিরাল এবং নাক দিয়ে শুশুকের মতো ভোঁস করে বাতাস ছাড়ল। সেই বাতাসের ঝাপ্টা বদ্ধ ঘরের দূষিত বাতাস ঘর ছেড়ে পালানোর মতো ছুটে এল জানালার দিকে;  আর তাতেই মা-ছেলের ঝড়ের কবলে পড়ার মতো অবস্থা হলো।

সেখান থেকে সরে এসে ফজর আলি মায়ের হাত ধরে বলল, ‘আম্মা, তুমি তোমার বউমা নিয়ে থাকো, আমি পালাই।’ বলতে বলতে সে এমন ভাব করছিল যেন সে এক্ষুনি পালাবে। ছেলের হাত খপ করে টেনে ধরে মা বললেন, ‘কোথায় যাবি রে বাপ? আজ তোর বাসররাত না!’

তখন বিকেলের শেষ আলো ইতিউতি তাকাচ্ছিল, কখন অন্ধকারের সহিস ফিরে আসে! অবশেষে ফিরে এসে গাঢ় কণ্ঠে তাদের ডেকে নিয়ে গেল বাসরঘরে। বাপ-দাদার আমলের ঢাউস খাট। তোষকের ওপরে নতুন চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন মা। হাজার হলেও তার একটামাত্র ছেলে। হাত-পা জ্বালা করে, তাই ছেলের জন্য গ্লুকোজের ঘন সরবত আর বউমার জন্য গরম দুধের গ্লাস তেপায়ার ওপর রেখে দিয়েছেন তিনি। সঙ্গে কিছু ফলফলাদি।

‘আমাকে পেয়ে তুমি খুশি?’
‘খুব খুশি। তোমার মতো স্লিম ফিগারের বউ কজনার ভাগ্যে জোটে?’
‘আর কোনো গুণ নাই?’
‘গুণের শেষ নাই তোমার। মুখে দুটো দাঁত 
থাকলে সার্কাস পার্টি থেকে ভালোই আয় করতে পারতাম। নাক ডাকলে পাখার বাতাসের দরকার পড়বে না। আর হ্যাঁ, বেশি দিন বাঁচলে দেশে দুর্ভিক্ষ আসতেও সময় নেবে না।’
মন খারাপ করলে ফজর আলি তার গালে টোকা দিয়ে আবার বলল, ‘মন খারাপ করছ কেন, লক্ষ্মীটি? আমি তো তোমার প্রশংসাই করছি। তোমার নামটাও অনেক সুন্দর; থত্থরি বেগম।’
থত্থরি বেগম একটু আহাল্লাদি হলো বটে; তবে অভিমানও ঝরাল, ‘শুধু নামটাই; আমার হাসিটা?’
‘আহারে! হাসিতে অমাবস্যার চন্দ্রযোগ।’
‘গায়ের ত্বক? মা বলে দুধেআলতা।’
‘তোমার মায়ের চোখ না চুলা?’
থত্থরি বেগম হেসে উঠে স্বামীর দিকে পাশ ফেরাল। তার বুকে হাত রেখে প্রসঙ্গ পাল্টাল, ‘তোমার বুকের পাটা দেখে আমার নানার কথা মনে পড়ছে।’
‘তোমার নানা কি আমার মতন?’
‘হ্যাঁ গো। দুপুরবেলা নানা শীতলপাটিতে চিৎ হয়ে শুলে আমরা নাতি-নাতিনরা তার পাটার মতো বুকের ওপর শোয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কী বাহাদুর ছিলেন! বুঝতেই দিতেন না তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। 
নানার কথা মনে পড়ায় তোমার বুকের ওপর শুতে 
ইচ্ছা করছে।’
‘সে আর কি! শোও। তোমার ইচ্ছা পূরণ করি।’

কষ্টেসৃষ্টে তার বুকের ওপর উঠে শুয়ে পড়ল থত্থরি বেগম। যেন কোনো দরবেশ তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন; তার ওপর কুদরতি ফুঁ দিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল সে। এদিকে ফজর আলির অবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা। যেন দেয়ালচাপায় পড়েছে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। দুহাতে দেয়াল ওপরের দিকে ঠেলছিল, কিন্তু ঠেলতে পারলে তো? গড়ানি দিয়ে কোনোরকমে বুকের ওপর থেকে দেয়ালটা নামাতে সক্ষম হলো সে; তারপর ঢকঢক করে সরবতটা গলায় ঢেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বাইরে এল। পিঠ চুলকাচ্ছিল; উঠোনের কোণায় আমগাছ, তার বাকলে পিঠ ঘষতে লাগল। 

সপ্তাখানেক পরেই কুরবানির ঈদ এসে হাজির। শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে লোকজন এসে জামাই ও তাদের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গেল। ফজর আলির শাশুড়ি মাশআল্লাহ! কুমায়ন অঞ্চলে চড়ে বেড়ানো হস্তিনীর মতো দেখতে। নিজে সামনে যা পান তাই খান, অন্যকেও সেভাবে খাওয়াতে চান। নতুন জামাইকে গণ্ডেপিণ্ডে খাওয়াচ্ছিলেন; জামাই বাধা দিলে বললেন তিনি, ‘কোরবানির গোশত খেলে কিচ্ছু হয় নারে বাবা। আল্লার বরকত আছে। পেট ঠ্যাসে খাও। হকনল্লি পর্যন্ত ডুবে খাও।’ পরক্ষণে হাসলেন, ‘তোমার শ্বশুর হরিপদ গোয়ালার কাছ থেকে মিষ্টি দই আর লক্ষণের দোকান থেকে রসগোল্লা এনেছে। গোশতে বেশি বেশি ঝাল-মসল্লা দিয়েছি, যাতে দই-মিষ্টি খাইতে মজা পাও।’ শ্লেষ্মা ঝেড়ে এবার কণ্ঠ ভেজালেন অহংবোধে, ‘আমাদের সবাই হাতির বংশধর রে বাবা। কয়েকদিন এই শাশুড়ির হাতের রান্না খাও, দেখবে তোমার পাতলাপুতলা শরীর কেমন মোটাতাজা হয়।’

কেন সে পাতলাপুতলা, তার ভেতরে কী সমস্যা, একমাত্র ফজর আলির দেহের কলকব্জারা তা ভালো জানে। এমনিতে মিতবাক সে। কথার পিঠে কথা বলা অনাবশ্যক মনে করল; তবে তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি ফুটল।

চিলমচিতে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়াল সে। তার পর কাঁচা সুপারি দিয়ে মুখভর্তি পান চিবাতে চিবাতে শোবার ঘরে এল। তার খুব ঘুম পাচ্ছিল; যাকে বলে মরণঘুম। পিঠও চুলকাচ্ছিল। চন্দ্রকলার চক্রে তখন অমাবস্যা। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে বাইরে যেতে মন সায় দিল না। বিছানায় এসে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল; তার পর বউকে ইঙ্গিত করল তার পিঠ চুলকে দিতে। তার পাশে আসনপিঁড়ি হয়ে বসতে থত্থরি বেগমের কষ্ট হচ্ছিল; তবুও তার পিঠ চুলকে দিচ্ছিল সে। ফজর আলির চুলকানির অত্যাচারের অসহনীয় মাত্রা কমছিল না তো বটেই; বরং বেড়ে যাচ্ছিল। অসন্তুষ্ট চিত্তে শরীর ঝাঁকাল সে, ‘হাতির মতো শরীর; হাতে কি জোর নাই?’

থত্থরি বেগমও রেগে ফায়ার; কড়া জবাব তার, ‘তিন ইঞ্চি করে লম্বা নখ দিয়ে চুলকে দিচ্ছি তা-ও হচ্ছে না! কোদাল আনব?’

‘কোদাল দিয়ে তো কবর খোঁড়ে,’ শীতল কণ্ঠে জবাব দিল ফজর আলি।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠছিল না সে। চারদিকে বলাবলি শুরু হলো ফজর আলি মানুষটা অনেক ভালো মানুষ ছিল। ঘুমের মধ্যে আল্লাহ তাকে তার কাছে নিয়ে গেছেন।

ধারাবাহিক উপন্যাস ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:১৬ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২০ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

গত সংখ্যার পর

তোমরা আজ হয়তো ভাবতে পারবে না- এ সময় দিনেরাতে নদীর স্রোতের মতো ছিন্নমূল মানুষ প্রবেশ করতে থাকে ত্রিপুরার নানা অঞ্চল দিয়ে। এত বড় শরণার্থী বিপর্যয় আগে কোথাও ঘটেনি পৃথিবীতে! একটি হিসাব থেকে বুঝতে পারবে ত্রিপুরার মানুষ বাংলাদেশের যুদ্ধের দাহন কতটা ভোগ করেছে। ১৯৭১ সালে রাজ্যের মোট লোকসংখ্যা যেখানে ১৫.৫৬ লাখ, সেখানে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩.৪২ লাখ বা প্রায় ১৪ লাখ। পরের দিকে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। ফলে ত্রিপুরার জনজীবন ও অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। কী করবে মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: স্যার, একটি প্রশ্ন করি। সমাজ, অর্থনীতিতে এই যে ভয়ংকর রকম চাপ, সাধারণ মানুষের এত যে কষ্ট, এর পরও কেন সবকিছু মেনে নেয় ত্রিপুরার মানুষ? 

রথীন দত্ত: সঠিক প্রশ্নই করেছ। ব্যাপারটা স্বভাবতই ভাববার। তবে আমার কী মনে হয় জান, প্রকৃতির, মাটির একটা টান আছে, যা ভঙ্গুর নয়, নানা টানাপোড়েনে ভূখণ্ড ভাগ হয়ে গেলেও সেই অবিভাজ্য টান ধরে রাখে প্রকৃতি। এর মধ্যে আছে ভাষা-সংস্কৃতি ও জলবায়ুর এক গন্ধ। হয়তো সে কারণেই কষ্টকে কষ্ট বলে ভাবেনি ত্রিপুরাবাসী। 

ইতিহাসগতভাবে ত্রিপুরায় যে বাঙালি তার ৯৫ ভাগ পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে- প্রায় সবাই ওপারের মানুষ- বলতে পার দেশ ভাগে বিতাড়িত মানুষ। এই মানুষদের সবাই হিন্দু ধর্মালম্বী, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নতুন ভারতে পাড়ি দিয়েছে ১৯৪৭-এর দাবানলে পুড়ে। আবার এমন অনেকে আছেন যাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজ দরবারের কর্মচারী। কিন্তু এদের সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা, রাগ-বিরাগ বৈশিষ্ট্য এক। অতএব, ১৯৪৭-এর আগে-পরের যে বিভেদ তা টিকে থাকেনি- নিমিশে উবে গেছে! হিন্দু, মুসলমান, পাহাড়ি ও নানা ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর ভেতরে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মুসলমান এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিবাদে ঠাঁই করে নিয়েছে- মানুষের ভেতরে মানুষ যেভাবে ঠাঁই করে নেয়! এই আত্মীয়তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও কলোনিয়াল লিগেসি বিরোধ টানেনি। ধর্ম যে ব্যক্তির একান্ত আপনার বিষয়, রাষ্ট্র বা সমাজের নয় এবং ধর্ম বিশ্বাস যে ভাষা-সংস্কৃতির বিভাজন মানে না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তা নতুন করে শিখিয়ে দিয়েছে। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: হয়তো তাই হবে। কিন্তু এপার ওপারে দুই পারেই যেভাবে উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, নতুন করে বিভেদ তৈরি হচ্ছে, তাতে কিন্তু শঙ্কার কারণ আছে। 

সার্জন রথীন দত্ত: নিশ্চয়ই, শঙ্কার কারণ তো আছেই। দেখ, ১৯৭১ কেবল বাংলাদেশের নয়, ভারতেরও সমানভাবে। ভারতের সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী। অকাতরে প্রাণ দিয়েছে মুক্তিবাহিনী, রক্ত গেছে মিত্রবাহিনীরও। অতএব, দুই দেশকে এক রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল ১৯৭১, নতুন ইতিহাস তৈরি করেছিল। সেই ভাতৃত্বকে উগ্র ধর্মবাদ চর্চা দিয়ে বিনষ্ট করা কখনো সমীচীন নয়। 
মল্লিকা সেনগুপ্ত: ঠিক বলেছেন, স্যার। এবার তাহলে আগের প্রসঙ্গে যাই আমরা। 

সার্জন রথীন দত্ত আবারও আগের প্রসঙ্গে ফিরলেন। ফেরার আগে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিলেন। 

বুঝলে, পরিস্থিতি যথেষ্টই ঘোলাটে তখন। কী হবে, কীভাবে পরিস্থিতি সামলানো যাবে? ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত কতটা নামবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে- কিছুই নিশ্চিত নয়। মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি সশরীরে থাকলে পরিস্থিতি একরকম হতো। কিন্তু তিনি তো নেই। এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও দলের হুইপ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স তাদের দেখাশোনা করছে। অন্য নেতাদের কেউ কেউ গোপন পথে মেঘালয় ও আসামে পাড়ি দিয়েছেন। কে কোথায় উঠেছেন কেউ খবর রাখে না। একটা সুখবর খবর হলো তাজউদ্দীন আহমদ এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বুঝতেই পার সাক্ষাৎকারটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ- ভারতের সমর্থনের প্রশ্নে কত বড় ইতিবাচক ঘটনা। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: স্যার, পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা আছে, থাকবেও। তবু শ্রীমতি গান্ধী সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? 
সার্জন রথীন দত্ত: দেখ, আমি রাজনীতির মানুষ নই। মিসেস গান্ধীর রাজনৈতিক বিরোধীরা যা ইচ্ছে বলতে পারেন। কিন্তু যদি ১৯৭১ সালের কথা বল, তাহলে আমার মতামত খুবই স্পষ্ট। আমার মনে হয় কি জান, ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে যদি অন্য কেউ থাকতেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির সঠিক রূপয়ানে গুরুত্ব না দিত এবং বাংলাদেশ যুদ্ধের রাজনৈতিক মূল্যায়ন মস্কোর ভূমিকা যথার্থ না হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিলম্বিত হওয়ার কারণ ছিল। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: বুঝলাম স্যার, এবার আগের কথায় ফিরি আমরা। 

শোন, তাজউদ্দীনের সঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর পরপর দুটি বৈঠক হয়। বিস্তারিত আলোচনার পর স্থির হয়, অনতিবিলম্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হবে, যে সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করবে। আরও ঠিক হয় ভারত তার ভূমি ব্যবহার করে রেডিওসহ সব ধরনের প্রচার কাজ চালাতে দেবে। আরও বড় সিদ্ধান্ত হয় ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠবে- যার দেখাশোনা করবে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিল বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেওয়া নেতৃবৃন্দের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপিত না হওয়ায়। এ ক্ষেত্রে বিএসএফ সহায়তা করল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলো। 

এদিকে আগরতলায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা, বিশেষ করে যারা ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে এমএনএ বা এমপিএ হয়েছেন তারা পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিলেন। ২ এপ্রিল ১৯৭১ তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসলেন মেলারমাঠে অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে। 

সেদিনের বৈঠকটি ছিল পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ, যা এক মাইলফলক। জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভা থেকে আওয়ামী লীগের ৩৫ জন এমএনএ, এমএলএ সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীর সামনে একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করলেন। বিবৃতিটি পাঠানো হয় জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট-এর কাছে। Stop this Genocide- ‘বন্ধ কর এই গণহত্যা’ শিরোনামে ইংরেজিতে তৈরি হয় বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রথম যৌথ বিবৃতিটি।

চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ-আল-হারুন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তী এবং পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কম্পাস’ সাময়িকীর নিজস্ব প্রতিনিধি অমর রাহা এটি রচনা করতে সহায়তা করেন। এরা সবাই তখন আগরতলায়। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) বার্তা সংস্থার অফিসের একটি পুরনো টাইপ রাইটারে এই বিবৃতি টাইপ করা হয়। পিটিআইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি মধুসুধন গুহ রায় তখন বাংলাদেশের যুদ্ধ ‘কভার’ করতে আগরতলায় আছেন। মধুবাবু টেলিফোনে কলকাতায় হেয়ার স্ট্রিটের পিটিআই অফিসে খবরটি পাঠিয়ে দিলেন। এটি ছিল তার ‘স্কুপ নিউজ’। কারণ অন্য কাউকেই খবরটি তখনো দেওয়া হয়নি। পরদিন সব জাতীর স্তরের খবরের কাগজে খবরটি ফলাও হয়ে বেরোল। এরপর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। 

চলবে...

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

৯ম পর্ব

১০ম পর্ব

১১তম পর্ব