![মনোবৃত্তের কৌণিক বিন্দু](uploads/2024/03/29/1711698266.Subornorekha_9-(2)-GOLPO.jpg)
কৃষ্ণপক্ষের আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। জ্যৈষ্ঠের ফলঘ্রাণ মাটি, বাতাসে এখনো ম ম করলেও আষাঢ় ইনিয়ে-বিনিয়ে গা মাখাচ্ছে ভরপুরে। রাত নেই, দিন নেই, মনের মাধুরী মেশানো ছন্দে বৃষ্টি নামার আয়োজন করে। সেই অসময়ের আষাঢ়ে অন্ধকার আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি তলোয়ারের মতো। মনে হয় কেউ ছুরি চালাচ্ছে জমে যাওয়া ঘন কালো মেঘ বিচ্ছিন্ন করতে। অক্লান্ত সম্মুখ মাঠ যোদ্ধার তলোয়ার থামে না- এক দিগন্ত থেকে ধেয়ে আসে অন্য দিগন্তে। জবেদ যখন তাহেরাকে দেখে তার বুকেও আকাশের বিদ্যুতের ঝলকানির মতো বয়ে যায়। ইছরেপাকা আষাঢ়ের বজ্রপাতের মতো ঝাকুনি দেয় শরীর। চোখের দেয়ালের টেরাকোঠায় আঁকা কামদেবী তাহেরাতে হাত-পা স্থির হয়।
জবেদের পাকা শরীর। শিলবিলাতি আলুর মতো খণ্ড খণ্ড মাংসপেশি। দেমাগওয়ালা যজ্ঞী বাবুর পাঠার মতো নাচনবাচন। সুলতানের ছবির মতো তার দেহ গড়ন। প্রান্তিক কিন্তু ধ্রুপদী, এলেবেলে সাংহারি। তার দুহাতে কত স্তনে চাপ দিয়েছে তা জবেদ নিজেও হিসাব করে বলতে পারবে না। পাড়ার ঠাট্টা সম্পর্কের খায়েসওয়ালা রসিয়া ভাবি, মেলার ভিড়ে জড়ো হওয়া সদ্য যুবতীদের টার্গেট করত সে। তাহেরা তার সম্পর্কে শালি হয়। বিয়ে হলেও সংসার টেকেনি। কেমনে ঠিকবে? দশ-এগারো বছরে রজঃ শুরু হয়। তারও আগে গ্রামের তাগড়া মরদ ভাণ্ডারীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাহেরার। পুতুল বোঝার আগে স্বামী। ভাণ্ডারী শ্বশুরবাড়ি এলে দাদি সম্পর্কের মহিলারা তাহেরাকে জোর করে ভাণ্ডারীর সঙ্গে ঘরে ঢুকিয় দিত- অসন্তুষ্ট ভাণ্ডারীর অপেক্ষা সহ্য হয় না। ক্রমেই সুসম্পর্ক দূর সম্পর্কে রূপ নেয়। কিশোরী তাহেরাকে রেখে ভাণ্ডারী এক সমন্ধির বউকে নিয়ে চম্পট দেয়। হই হই রই রই পড়ে যায় পুরো বজরার চরে। লোকজন খোশগল্প জমায়-
-নটা-নটির কারবার-
-কলিকাল এমনি বলে-
-চিকন রাস্তায় ঢোকন কাল-সোমন্বির বউয়ে ধরল হাল।
-সোনার লাঙল-জমি না মেলে-এগ্লা তো হবই।
টং দোকানের আমুদে গল্প দীর্ঘায়িত হয়।
-ক্যা! তারার বউয়ের তিনটা ছাওল-চাষ কী লাঙল ছাড়াই হইছে।
-লাঙল হলই কী অয়-তেরছা শিকশিক্যা ফালি লাগে। ফালির যত ধার-জমির মাটি তত ইধার-উধার।
জনগালগল্প ছড়িয়ে পড়ে। তাহেরার বাপ মুখ দেখাতে পারে না। একটা আস্ত পাথর ভার হয়ে তার ঘাড়ে উঠে পড়ে। সেই ভারে পুরো শরীর ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা। মেয়ের লজ্জা যে বাপের মরণসম। পুত্রপিতা তেমন লজ্জাবোধের ক্লেশে ভোগেন না- বরঞ্চ নারীঘটিত বেপারগুলোতে অপেক্ষাকৃত হালকাভাবে পুত্রপিতার লজ্জাস্খলন অনুভূতি দেখা যায়। তাহেরার শেষঅব্দি বজরাচরে স্থির হওয়া হয় না- জীবনস্বপ্ন বিঘ্নিত পিতা জনলজ্জা ঢাকতে তাহেরাকে ঢাকায় পাঠায়। ঠাঁই হয় বোনের কাছে। সময়ের ঘোরে বছর বাড়ে-তাহেরাও বাড়ে বুকে-পিটে। ছোঁয়াছে সময়ের দ্বিপশিখা জ্বালানো শরীরে সক্রিয় হয়ে উঠে আস্ত তাহেরা। পূর্ণ আষাঢ়ে ভরা জলের প্লাবন নামে জমিনে। হাঁসফাঁস করতে থাকা মাটির শিরায় শিরায় পানির সে ধারা প্রবাহিত হতে থাকে- প্রকৃতি মেলে ধরে তার জিওন কাঠির পরশে প্রকাশযোগ্য সমস্ত ঐশ্বর্য- নারী ঐশ্বর্য- পরিণত তাহেরাকে।
যুবতী তাহেরা বোনের সঙ্গেই থাকে। পাশাপাশি রুমে। বেশ কয়েকবার সুযোগ পেলেও তাহেরার প্রস্ফুটিত মাংসপিণ্ড জবেদের হাতের তালুয় জব্দ হয়নি। জবেদের ছোঁকছোকানি কমে না। সে সুযোগ খুঁজে। মোবাইলে টিকটকের গরম ভিডিওর গান জোরে বাজায়- চিল্লায় বলে,
-ফকিন্নির পুতেরা কী বানায় এগ্লা। কার্তিকের কুত্তা সঙ্গম লাগছে মোবাইলের ভেতর।
-টিকটক দেহিস নারে তাহেরা- খারার উপ্রে নষ্ট হয়া যাবি।
জবেদ থামে- চ্যাড়মোড়া দিয়ে উঠে ঠাস করে দরজাটা লাগায় দিয়ে ব্লু ফ্লিম চালায় মোবাইলে।
তাহেরার কান পর্যন্ত শব্দ যাতে পৌঁছায় ততটকু শব্দ ছাড়ে সে।
বস্ত্রহীন নটিদের শিরশিরে গন্ধম শব্দে জবেদ দিগছোটা হয়। কল্পনার ক্যানভাসে উচ্ছল তাহেরাকে এনে হাত মারে জবেদ-দিগ্বিদিকশূন্য জবেদ স্থির হয়- প্রমত্তা থেকে শান্ত নদীতে রূপ নেয়।
জবেদের শরীর পাঠার মতো হলেও ইনকামে ঢেমনা-ভাদাইম্মা। বউ গার্মেন্টস খেটে ইনকাম করে আর সে বসে বসে খায়। বউয়ের গালিগালাজের চাপে মাঝে মাঝে ভাড়া রিকশা খাটে। রিকশায় পুরুষ যাত্রী উঠতে চাইলে সে নিতে চায় না। টং দোকানে বিড়ি ফুকায়, চা খায়। রিকশার ছইয়ে ঠেস দিয়ে ঘুম পাড়ে। নারী যাত্রী পেলে রিকশা হাকায়। মোটরের রিকশা হাওয়ায় ভাসে- রিকশার ছোট আয়নায় স্তন যত দোল খায়- তার রিকশার গতি আরও বাড়ে। রাস্তা খানাখন্দ হলে তার আয়না থেকে চোখ সরে না। জবেদ ভাবে আয়নাটা ছোট হয়েছে আরও বড় সাইজের আয়না লাগাতে হবে। তার ইচ্ছা করে বউয়ের সাজন-গোজন করা বড় আয়নাটা রিকশার সামনে লাগিয়ে দেবে। যেন পুরো ছবিটা দেখা যায়- নবীনগরের সেনা টকিজের পর্দার মতো। জবেদ মাঝে সাঝে পেপার পড়ে কিন্তু তার একটি নির্দিষ্ট স্টাইলে। সে হয়তো একটা পান কিনেছে বা শিঙাড়া যা পুরনো পেপারে মোড়ানো। তার পান মুখে পুরে বা শিঙাড়াটা খাওয়া হলে সেটিই সে পড়া শুরু করে। যেমন আজ একটা কবিতা পেয়েছে। কিন্তু লেখকের নাম নেই। সে রিকশার সিটে পা তুলে ছইয়ে হেলান দিয়ে পড়তে শুরু করে..
আমার পুঁজি তোমার বুক
তোমার টোল পড়া হাসিটুকু।
যখনই ক্লান্ত হই
চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাও।
নীলাম্বরী পাখি হয়ে।
আবার ফিরে আসি
লোনাজল পাড়ে-
অমীমাংসিত ঠোঁঠের উঠোনে- চুম্বনে আর চুম্বনে।
-দূর বাল, আজাইরা সব কবিতা- এক্করে ছাইপাশ। চোদনা কাব্য আর চোদনা কবি- বলে সে মুষ্টি করে ড্রেনের দিকে ছুড়ে মারে কাগজটি। ময়লা ড্রেনে কবিতার টুকরো পাতা পড়ে থাকে।
শুক্রবার ছুটির দিন হলেও জবেদের স্ত্রী সাহেনার ডিউটি থাকায় অফিসে গেছে। সকাল বেলা জবেদের সঙ্গে স্ত্রীর ভীষণ ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল। তাদের অভ্যস্ত ঝগড়া আজ একটু বেশি জোরালো হয়েছিল। জবেদ খাসি হলেও স্ত্রীর কাছে ঢোড়াসাপ। স্ত্রী সাহেনা ঝগড়ার সময় ছেনি-বঁটি নিয়ে মাঝে মাঝে তেড়ে আসে জবেদের দিকে। সাহেনা পার করে আসা বেলা-অবেলায় প্রাপ্ত সব অশ্রাব্য শব্দের পূর্ণ প্রয়োগ করে জবেদের ওপর। মুখে ব্যথা হওয়া অব্দি তার উপসংহারে সে আসে না।
-বেশ্যার পোলা লেংটা বঁটিতে তোর গলায় একটা পোজ দিয়া জেল খাটুম-
-ইতরা চোদা। বান্দির পোলা-কাজে না গেলে আজ আইসা তোরে লেং মাইরা বাইর কইরা দিমু। তোর মতো খোদার
খাসির দরকার নাই- ইচ্ছে করে লাত্তি মাইর্যা তোর হোলের বিচি ফাটাই দেই-
কথার তালে লাত্তি ছোড়া পা জবেদের ঊরু ছুঁয়ে যায়। সাহেনার লাত্তি থেকে বিচিসমেত হোল রক্ষা করে জবেদ কিছুটা বেঁচে গেলাম বোঁধ করে। কিন্তু সাহেনার মুখ চলতে থাকে। কথ্য-অকথ্য গালিগালাজ করে কাজে যায় সে।
জবেদ কোল বালিশের মতো বেছানায় শুয়ে থাকে। তাহেরা এতক্ষণ ধরে পাশের রুমেই ছিল- রুটিন মাফিক তাদের ঝগড়া তাকে তেমন বিচলিত করে না।
২.
তাহেরার লেই ফ্যাশন’স সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ থাকে। বিদেশি মালিকের পোশাক কারখানায় চাকরি করলে একটু শান্তি আছে। চাকরির অনেক নিয়ম-কানুন সেখানে তারা ঠিকভাবে পালন করে। শ্রমিকের সুবিধা-অসুবিধা দেখে। কিন্তু অসুবিধা অভারটাইম নেই। অভারটাইম না থাকলে বেতন যা দেয় তা দিয়ে সাভারের এই বর্ধিষ্ণু শহরে ঠিকে থাকা বড় মুশকিল। বাজারে এক ঘুরানি দিলে বেতন উধাও। পেটে-ভাতে কোনো মতে থাকা যায়। পেটে বালিশ বেঁধে থাকার চেয়ে পেটে-ভাতে থাকা কম কীসের! পেটে ভাত না থাকলে কত ভূতই ঘাড়ে এসে পড়ে। কাজ দিবার চেয়ে কাম চায় অনেকে।
তাছাড়া তাহেরা তার বোন-দুলাভাইয়ের সঙ্গে থাকায় খরচ অনেকটা কম হয়। অনেক খরচ আছে তার বোন সাহেনা করে দেয়। তার দুলাভাই জবেদকে আগে অসহ্য লাগলেও এখন তার ভালোই লাগে। খুব খোঁজখবর রাখে তার। কিন্তু সে দুলাভাইয়ের কাছে খুব ঘেঁষে না। পুরুষে বিশ্বাস নাই। পুরুষ মানুষের মন-সাক্ষাৎ ক্ষুধার্ত বাঘ- চপলা হরিণ পেয়ে যদি কামড় বসিয়ে দেয়। এই তো গত মাসে এক নারী কলিগ তার খালাতো দুলাভাইয়ের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
দুজনই বিবাহিত-দুজনারই ছেলেমেয়ে আছে। বাচ্চা পোলাপানগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না। বাপ-মা থাকতেও এক্কেবারে এতিমের মতো। মানুষ খোঁচায় পলাটির ছেলেমেয়ে বলে। পিতা-মাতার এই অমোচনীয় অপবাদ আজীবন ধরে এই সন্তানদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহেরাও বোঝে তার দুলাভাই জবেদ তার দিকে কোন নজরে চায়। সে জানে তার বোনজামাই জবেদ কালো ভ্রমর- ফুল না ফুটলেও কলিতেই সে মধু খোঁজে।
সকাল থেকে তাহেরা তার বোন-দুলাভাইয়ের ঝগড়া শুনলেও ঘর থেকে বেরোয়নি। ঝগড়া তাদের কাছে ডালভাত। দিনে একবেলা ঝগড়াঝাটি না করলে তাদের কারও পেটের ভাত হজম হয় না। তাহেরার ভয় করে- কোনদিন না আবার কোন অঘটন ঘটে যায়। পুরুষ মানুষের মাথা-রক্ত উঠলে যদি দায়ের কোপ বসিয়ে দেয় সাহেনার ঘাড়ে বা গভীর ঘুমে থাকা অবস্থায় যদি বালিশচাপা দিয়ে মেরে ফেলে। এরকম নানান কুচিন্তা আসে তাহেরার। সে ঘর থেকে ডাক দেয়-
-দুলাভাই কি ঘুমে? খাইবেন না?
দেয়ালের ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না। তাহেরা ভাবে হয়তো তার দুলাভাই ঘুমে আছে- তাই শুনতে পাচ্ছে না। সে বাইরে এসে দেখে দরজায় ভেতর থেকে লক করা।
দরজায় খোটান দিতে দিতে ডাকতে থাকে তাহেরা-
-কী ঘুমে কাইত গো- আবার খোটান দিয়ে ডাক দেয়,
-আরে তাড়াতাড়ি উঠেন- এক বান্ধবী আসব, নবীনগর যামু ঘুরতে।
নিয়া যাবেন না?
এতক্ষণ চুপ করে থাকা জবেদের মুখ খোলে-
-কাই যাইব রে?
-কহিনুর- ওই যে বোগড়ার মাইয়্যাটা-ফিনিশিংয়ে আমার লগে কাম করে, হেয়।
ওহ-
-ওরে না কইর্যা দে- আমার লগে তুই যাবি। রিকশায় দুজন চড়া যাইত না- শুধু তোরে লমুনে।
কী কন?
-হ- ঠিকই কই। মানা কইরা দে আর রেডি হ।
আচ্ছা বলে তাহেরা জবেদকেও রেডি হতে বলে- তাড়াতাড়ি রেডি হন- বুবু আসবার আগেই আইতে হইব।
জবেদ টান মেরে দরজা খুলে তাহেরার সামনে এস দাঁড়ায়। পরনের লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বলে- দেরি হইত না- এক্ষুনি যামু।
৩.
মোড়ে মোজাফর ডাকনামে মজুর মনিহারি দোকান কাম হোটেল। প্রয়োজনীয় ঘর গৃহস্থালির প্রায় জিনিসই এখানে পাওয়া যায়। ভেতরে টেবিল চেয়ারে বসে চা শিঙাড়া-সামুচা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সকাল হলেই দোকানের মাথায় থাকা জিগার গাছে শালিক, কাকের মেলা বসে। দোকানের বিক্রি না হওয়া বাসী পরোটা খাবার হয় কিচিরমিচির করা পাখিদের। তেল পরোটার ছ্যাৎ ছ্যাৎ শব্দের সঙ্গে বক্সে মমতাজের গান বাজে-
আমি লাইলীর প্রেমে পাগল পাড়ার একটা পোলা
চিপা চাপা জিন্স প্যান্ট পরা বুকের বোতাম খোলা
ডাবল কাটিং ফুল ফিটিং কানে পরছে দুল
পাড়ার লোকে নাম রাখছে তার পাংকু আবুল।
মাঝে মাঝে সকালে করুণ ওয়াজ ছাড়েন, কখনো সুফি-মারফতি গান। ঢাকার কোনো এক ওরসের পীরের সেবক মজু। সেই দরবারের কিছু বয়ানও বাজান চক্রাকারে। মজুর মোড়ের মজুর দোকান একটা ছোটখাটো প্রান্তিক আশ্রমের মতো। ভিখারি, রিকশাচালক, অটো-মিশুকওয়ালা, আন্তঃজেলা-দূরপাল্লার ওস্তাদ-সাগরেদ-চ্যালা, বাইপাইলের ওভারব্রিজের নাইট শিফটের শিলা নটি, পাকারমাথার বিথী হিজরার দল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বটতলায় পড়াতে যাওয়া হোম-টিউটর আর গার্মেন্টস শ্রমিকরা তো আছেই।
জবেদ-তাহেরা মজুর দোকানে ঢুকে কোনার টেবিলে মুখোমুখি বসে।
-কী খাবা?
-আপনে খান- আমি খাইছি।
-দূর, আবার খাও। আজ পুরাদিন শুধু খাওন আর খাওন।
-খাইবি না! রঙিন রূপভান।
-খাওনের জন্যি বার হইছি- সব খামু- সোনার চান। দেকুমনে কী খাওয়ান আপনে?
দুজনে ঐতিহাসিক যুগপৎ এক অবাঞ্চিত সময়ের ডেরায় চোখ বুলায়। তাহেরার চোখে-মুখে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো ঈষৎ আলোর রেখা খেলা করে। জবেদ হাত পাকায়- কাঁচা পাটের রসঝড়া দড়ির মতো।
-মজু ভাই- তেলে ডুবাই চারটা পরোটা আর দুটো ডিম দেও- সাথে মুগডাল।
সাহেনা অফিস থেকে বাসায় আসতে সন্ধ্যা নামে। কম ওভারটাইম হলে মাগরিব বাদ বেশি হলে রাত ১০টাও বাজে। জবেদ খোঁজ নেয় সাহেনার আজ ফিরতে দেরি হবে। কোরিয়ান ইয়াংওয়ানের থেকে নতুন অর্ডার আসায় কাজের চাপ আছে- ১০টা-১১টাও বাজতে পারে। সময় যেন বিজলীর মতো ছুটছে আজ। মজুর দোকান থেকে বের হতেই দুপুরের কাছাকাছি। আর ঘণ্টখানেক পরই জোহরের আজান দেবে। জোহরের আজান দিলেই দিন আর থাকে না। তাহেরাকে রিকশায় চেপে নিয়ে টান দেয় জবেদ। রিকশা গ্যারেজ করে ঢুকে পড়ে নবীনগর পার্কে। শত মানুষের সঙ্গে মিশে যায় তারা। পশ্চিমের দিকে শিরীষ গাছের শান্ত ছায়ায় শরীর হেলান দেয়। সময় গড়াতে থাকে। কিন্তু শখের নারীর সময় কম- ঘরে ফেরার তাড়া তার।
-বুবু আইব- চলেন যাই-
-দেরি হইব তোর বুবুর।
-আপনার সঙ্গে আইছি জানলে- কেলেংকারি রটি যাবে- এমনিতে ঘরপোড়া গরু।
-কেলেংকারে ভয় পাস তাহেরা?
তাহেরা চুপ থাকে- জবেদ এদিক-সেদিক তাকায়। নির্জনতা বুঝে জড়িয়ে ধরে তাহেরাকে। তাহেরার নরম মাটির দলার মতো স্তন হাতের মুটোয় ভরে নেয় জবেদ। তাহেরা ফুলে পড়া প্রজাপতির মতো নিশ্চুপ থাকে। পুরো দিন আপন রঙে রাঙিয়ে গা মাখানো অন্ধকারে বাসায় ফেরে দুজন। আগের স্তব্ধতা কেটে যায়- নতুন ভাবে গা মলাটের পৃষ্ঠা উল্টানো শুরু হয়।
পুরনো জবেদকে এখন আর সাহেনা মেলাতে পারে না। সাহেনা যেমন জবেদ চায় তেমনভাবে জবেদ নিজেকে হাজির করে নিয়মিত। পুরনো গড়পড়তা নৈমিত্তিক ক্যাচালের কোনো মঞ্চায়ন নেই। জবেদের অলসতা নেই- দিন বিরানে কামাই রোজগারের মাত্রা বেড়ে গেছে। একজন পুরোদস্তুর আদর্শ স্বামী হিসেবে জবেদের চিত্রায়ণে মোহিত হয় সাহেনা। সাহেনা নিজেকে আশ্বস্ত করে। বোন তাহেরাকে ডেকে জবেদের প্রশংসা করে। একমাত্র দুলাভাই হিসেবে জবেদের যত্নআত্তি করতে বলে তাহেরাকে। তাহেরা সায় দেয় মাথা নেড়ে। জবেদের নদীতে ডুব দেয় তাহেরা-
চোখের কোণে কৈলাশটিলা
মরি ডুবে জলে।
হাত বাড়িয়ে দাও গো ভ্রমর
নাও না আমায় তুলে।
তাদের চোখ আড়ালের মাখামাখিতে দিন গড়ায়। আমরা তিনজনের মনোবৃত্তের কৌণিক বিন্দুর অবস্থান নির্ণয়ে সিদ্ধান্তের কাঁটাকম্পাস ঘোরাতে থাকি। সময় আরও গড়ায়-
শবেবরাতের ছুটি কাটানোর দুই দিন পার হলেও অফিসে যায়নি সাহেনা। অফিস থেকে ফোন করলেও ফোন ধরেনি সে। স্বামী জবেদের নম্বরে ফোন করলেও সে নম্বর বন্ধ দেখায়। সেদিন মজুর দোকানে কাক, শালিক ডাকার আগেই পুলিশের একটি ভ্যান এসে দাঁড়ায়। সাহেনা যে বাসায় থাকে সে বাসা থেকে কীসের যেন ছ্যাচানি পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। রাতেই ফোন করে আশুলিয়া থানায় খবর দিয়েছিল কেউ। পুরো বাসাটি বাইরে থেকে তালা মারা। পুলিশ তালা ভেঙে ভেতরে ডোকে। গন্ধ বের বের হচ্ছে তাহেরা যে রুমে থাকত সে রুম থেকে। পুলিশ সেটি ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এলোমেলো ঘরের মেঝেতে শরীর ফুলে দুর্গন্ধ ছড়ানো সাহেনার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।