লোকসভা নির্বাচনের আগে এবার ভারতে যে কয়টি বড় চমক দেখা গেছে, তার মধ্যে অন্যতম বলা চলে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার নির্বাচনি বন্ড-সংক্রান্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাটি। এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন সরগরম ছিল গণমাধ্যম। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনি বন্ডকে অসংবিধানিক ঘোষণা করেন এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে এরকম বন্ডের তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দেন।
নির্বাচনি বন্ড রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান দেওয়ার একটি মাধ্যম, যা ভারতের যেকোনো নাগরিক বা সংস্থা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার নির্বাচিত শাখাগুলো থেকে কিনতে পারেন এবং পছন্দের যেকোনো রাজনৈতিক দলকে বেনামে দান করতে পারেন। যদিও কালো টাকার লেনদেন রুখতেই নির্বাচনি বন্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে দাবি করেছিল কেন্দ্র সরকার।
প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৭ সালে চালু হওয়া এই নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে বিগত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপি। ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিজেপি নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে ৬ হাজার ৯৮৬ কোটি রুপি পেয়েছে। নির্বাচনি বন্ডের দ্বিতীয় সুবিধাভোগী পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল। এ দলটি ওই সময়ের মধ্যে পেয়েছে ১ হাজার ৩৯৭ কোটি রুপি। একই সময়ে কংগ্রেস পেয়েছে ১ হাজার ৩৩৪ কোটি রুপি।
ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের স্বামী অর্থনীতিবিদ পরাকলা প্রভাকর এ বিষয়ে মন্তব্য করেন, ‘নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়েছে, তা সবাই দেখতে পেয়েছেন। সবাই এটাও বুঝতে পেরেছেন, এটি শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। এটা বিজেপিকে ভোগাবে বলেই মনে হয়। এই দুর্নীতির কারণে কেন্দ্রের বর্তমান সরকারকে ভোটাররা শাস্তি দেবেন।’
নির্বাচনি বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ দেওয়ার বিষয়টিতে দুর্নীতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে, কারণ এর সঙ্গে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া-নেওয়ার বিষয় জড়িত রয়েছে। যেমন- ভারতের আর্থিক অপরাধবিষয়ক সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর হায়দরাবাদ থেকে পি সারাথ চন্দ্র রেড্ডিকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে নয়াদিল্লিতে মদ জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। এর ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় অরবিন্দ ফার্মা নামের এক প্রতিষ্ঠান পাঁচ কোটি ডলার মূল্যের নির্বাচনি বন্ড কেনে। এ অর্থের পুরোটাই যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিতে। ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের একজন ছিলেন রেড্ডি। এর ৭ মাসের মাথায় ২০২৩ সালের জুনে রেড্ডি পরিণত হন রাজসাক্ষীতে। পরে ২০২৩ সালের নভেম্বরে আরও আড়াই কোটি ডলারের বন্ড কিনতে দেখা যায় অরবিন্দ ফার্মাকে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সমালোচকরা বলছেন, রেড্ডির মতো ঘটনা একটি নয়, আরও ঘটেছে। ২০১৭ সালে এ ধরনের বন্ডের ধারণা প্রথমে সামনে নিয়ে এসেছিল মোদি সরকারই।
লোকসভা নির্বাচনের আগে এরকম বিষয়গুলো সামনে আসার কারণে শঙ্কা দেখা দেয় যে ভারতের রাজনৈতিক দল ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হয়তো কোনো আঁতাত হয়েছে। হয়তো চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মতো ঘটনাও ঘটেছে। প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, নির্বাচনি বন্ডের শীর্ষ ১০ দাতার বিরুদ্ধে গত পাঁচ বছরে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তদন্ত চালিয়েছে। আর ওই ১০ প্রতিষ্ঠানই কোনো না কোনো মূল্যের নির্বাচনি বন্ড কিনেছে, যে অর্থ গেছে বিজেপির তহবিলে। হিসাব বলছে, শুধু ওই ১০ প্রতিষ্ঠানই নির্বাচনি বন্ড কিনেছে ১ হাজার ৩০০ কোটি রুপির বেশি।
বিজেপির রাষ্ট্রীয় মুখপাত্র জাফর ইসলাম অবশ্য কোনো আঁতাত থাকার কথা স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, ‘পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশি সদস্য আমাদের। বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভাতেও আমাদের নির্বাচিত সদস্যরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। যোগ্যতার ভিত্তিতেই আমরা অনুদান পাই। এখানে অন্য কোনো সন্দেহ করা অনুচিত।’
তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, দুই ধরনের ঘটনা দেখা গেছে। প্রথমটি হলো- নির্বাচনি বন্ড কেনা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় বড় সরকারি চুক্তি জিতে নিয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হলো- কোনো তদন্তের অধীনে থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রেহাই পেয়ে গেছে বন্ড কেনার পর।
কোন রাজ্যে কে আছে ক্ষমতায়, সেটির ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনি বন্ড কেনার রকমফেরও হতে দেখা গেছে। যেমন- বন্ড কেনায় শীর্ষে রয়েছে বিতর্কিত লটারি ব্যবসায়ী মার্টিন সান্তিয়াগোর সংস্থা ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস’। তারা কিনেছে মোট ১ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকার নির্বাচনি বন্ড। তাদের কেনা বন্ডের বড় একটি অংশ (৫৪০ কোটি রুপির বন্ড) গেছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। শুধু তা-ই নয়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জড়িত তিন ব্যক্তি লটারি জিতেছেন। তারা প্রত্যেকে পেয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার ডলার সমমূল্যের অর্থ।
বিজেপিকে এক্ষেত্রে দেখা গেছে বিপরীত ভূমিকায়। তারা অভিযোগের আঙুল তুলেছে ফিউচার গেমসের দিকে। অন্যদিকে তৃণমূল জানিয়েছে, কোনো অসদাচরণের ঘটনা ঘটেনি। এদিকে, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে পার্টি ও পরবর্তী সময়ে বিজেপির নির্বাচনি বন্ডও কিনেছিল ফিউচার গেমস। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। রাষ্ট্রীয় সংস্থার রোষানল এড়াতে পারেনি তারা।
এটিকেই হয়তো পুঁজি করে বিজেপি মুখপাত্র ইসলাম বলছেন, ‘প্রমাণের ভিত্তিতে সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করছে। সরকার এর সঙ্গে জড়িত নয়। বিজেপি কিছু করছে না।’ তবে স্বচ্ছতার পক্ষে থাকা ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর পিপল’স রাইট টু ইনফরমেশনের সহ-আহ্বায়ক অঞ্জলি ভরদ্বাজ বলেছেন, ‘নির্বাচনি বন্ড নিয়ে স্বাধীন তদন্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো দল বা দাতাকে নির্দোষ দাবি করা যাবে না।’ দিনশেষে এ বিষয়গুলো ভারতের লোকসভা নির্বাচনে কোনো প্রভাব রাখে কি না, এখন সেটিই দেখার বিষয়।