![এক নারীর নিয়ন্ত্রণে ৮০ হাজার জলদস্যু!](uploads/2024/03/16/1710567844.bi-jabe45.jpg)
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ক্যান্টন শহরের ভাসমান পতিতালয়ে বাস করতেন এই নারী। তবে পরবর্তী সময়টা ছিল তার কাছে স্বর্ণযুগ। সমুদ্র ছিল এ নারীর শাসনে। ৮০ হাজার জলদস্যু তার আঙুলের ইশারায় উঠত-বসত। ১ হাজার ৮০০-এরও বেশি যুদ্ধজাহাজ ছিল তার আয়ত্তে। সেগুলো তার কথা অনুসারেই সমুদ্রের বিভিন্ন জাহাজ লুটপাটে নিযুক্ত ছিল।
ভাসমান পতিতালয়ে এই নারীর সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয় ঘটে চেং আইয়ের। যিনি ছিলেন দক্ষিণ চীন সাগরের এক ভয়ংকর জলদস্যু। ১৮০১ সালে জলদস্যু জিং ইয়েই তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। বিয়ের পর থেকে স্বামীর সঙ্গে দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযানেও অংশ নিত সাহসী এই নারী।
বলছি ‘চেং ই সাও’-এর কথা। তবে তিনি ‘চিং শি’ নামেই পরিচিত। জন্ম ১৭৭৫ সালে চীনের গুয়াংডং জেলায়। বাবা-মা নাম রেখেছিল শিল জিয়াং গু। ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এবং সফল নারী জলদস্যুদের একজন ছিলেন তিনি।
১৮০৪ সালের মধ্যেই চেং আইয়ের আয়ত্তে ছিল ১ হাজার ২০০টি জাহাজ এবং প্রায় ৭০ হাজার জলদস্যু। ১৮০৭ সালে বিয়ের ছয় বছরের মাথায় ৪২ বছর বয়সে চেং আই মারা যান। এরপর চেং আইয়ের পরবর্তী উত্তরাধিকার হিসেবে দায়িত্ব চলে যায় তার পালকপুত্র চেং পো পো সইয়ের ওপরে। তিনি একসময় চিং শি অর্থাৎ সম্পর্কে মা হলেও, তার প্রেমে পড়েন। পরবর্তী সময়ে তাদের বিবাহ হয় এবং দস্যুরানি হয়ে ওঠেন তিনি। দ্বিতীয় স্বামীর সব দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেন। তারা একত্রে ‘রেড ফ্ল্যাগ’ বাহিনীর মাধ্যমে সমুদ্র শাসন করতে থাকে। ম্যাকাও থেকে ক্যান্টন পর্যন্ত দক্ষিণ সমুদ্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল চিং শি নেতৃত্বতাধীন এ দস্যু বাহিনীর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চেংয়ের দত্তক নেওয়া ছেলে চেং পো পো সইয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেই স্বামীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। চিং শি ভালোভাবেই জানতেন, স্বামীর মৃত্যুর পর তার দত্তক নেওয়া ছেলের হাতেই দস্যু সাম্রাজ্যের ধ্বজা উঠবে। তাই আগেই সৎছেলেকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়েছিলেন।
সিংহাসন নিজের দখলে রাখার শর্তে বিয়েও করেছিলেন। দত্তক নেওয়া ছেলে চেং পো পো সইয়ের সঙ্গে চিং শির স্বামীর সম্পর্ক নিয়েও বিভিন্ন মত রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। অনেকের মতে, চেং পো পো সই আসলে একজন জেলে ছিলেন। তাকে বন্দি করা হয়েছিল। পরে তাকেই দত্তক নিয়েছিলেন চেং। কিন্তু তাদের মধ্যে সে অর্থে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিল না।
অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও চতুর ছিলেন চিং শি। স্বামী মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পুরো দস্যুবাহিনীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন। দস্যু জাহাজগুলোর জন্য একটি কঠোর আইন তৈরি করেছিলেন। তার নির্দেশ ছিল উপকূলীয় কোনো গ্রামবাসীদের কাছ থেকে লুটপাট করা যাবে না। এ ছাড়া জাহাজে অপহরণ করা নারী বা শিশুর সঙ্গে কোনো দস্যু যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হতে পারবে না। যদি বন্দিনীর সম্মতি থাকে তবু কেউ এই আদেশ অমান্য করতে পারত না। ধরা পড়লে সেই জলদস্যুর শিরশ্ছেদ করা হতো আর বন্দিনীর পায়ে পাথর বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। জলদস্যু জাহাজের কোনো নাবিক বিনা ছুটিতে অনুপস্থিত থাকত তাহলে তার এক কান কেটে ফেলা হতো।
রিচার্ড গ্লাসপুল নামক একজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ১৮০৯ সালের সেপ্টেম্বরে চিং শির জলদস্যুদের হাতে ধরা পড়েন। ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাকে আটকে রাখা হয়েছিল দস্যু জাহাজে। তিনি ভয়ংকর ওই অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ৮০ হাজার জলদস্যুকে একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন এই নারী। প্রায় হাজারখানেক বড় জাহাজ এবং ৮০০টি ছোট জাহাজ এবং নৌকা ছিল তার আয়ত্তে।
চিং শির নেতৃত্বে ‘রেড ফ্ল্যাগ’ জলদস্যুরা অসংখ্য জাহাজ লুট করেছে। চীনের কুইং রাজাদের প্রচুর চেষ্টা সত্ত্বেও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলেন এ দস্যু বাহিনী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পর্তুগিজ নৌ সেনাও তাকে থামাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। অবশেষে সরকার ১৮০৮ সালে এই জলদস্যুদের দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সরকারের নৌবাহিনী আর এই কুখ্যাত জলদস্যু বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে নৌবাহিনীর এতটাই ক্ষতি হয়েছিল যে, বলা হয়- সরকারের কাছে মাছ ধরার জাহাজও ছিল না।
স্বামীর মৃত্যুর পর ১৮০৭ থেকে ১৮১০- এই তিন বছর একা সমুদ্র শাসন করার পর চীন সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে নিজের সাম্রাজ্য ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হন চিং শি। তার এক কথায় সব দস্যু অস্ত্র ত্যাগ করেছিল। চেং পো পো সই সরকারি কর্মচারী হিসেবে বাকি জীবন পার করে দেয়। আর চিং শি গুয়াংজো শহরে একটি ব্রোথেল চালানো শুরু করে। তাকে মনে করেই বিখ্যাত ছবি ‘দ্য পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’-এর একটি পার্ট তৈরি হয়েছিল। শুধু চলচ্চিত্রই নয়; তাকে নিয়ে অসংখ্য বই, উপন্যাস ও ভিডিও গেমও তৈরি হয়েছে। ১৮৪৪ সালে ৬৯ বছর বয়সে মারা যান ইতিহাসের কুখ্যাত ও নিষ্ঠুর এই নারী।
সূত্র: ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি
থটকো ও উইকিপিডিয়া
কলি