সংকট থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মিশন। সংস্থাটি বলেছে, আমদানি সংকোচন ও নীতি কঠোরসহ বেশ কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এসব পদক্ষেপের ফলে দেশটির অর্থনীতি ক্রমশ স্থিতিশীল হবে।
বুধবার (৮ মে) সন্ধ্যায় সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন আইএমএফ মিশনের দলনেতা ক্রিস পাপাজার্জিও। এ সময় তার সফরসঙ্গীরাও উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
বাংলাদেশকে দেওয়া প্রতিশ্রুত ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত পর্যালোচনা করতে গত ২৩ এপ্রিল আট সদস্যের আইএমএফ মিশন ঢাকায় আসে। ঢাকায় পক্ষকাল অবস্থানের সময় প্রতিনিধিদল অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ বিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করে। গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের সফর শেষ হয়। সফর শেষে একটি বিবৃতি দিয়েছে আইএমএফ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সরকারের সঙ্গে তাদের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতে চলমান গৃহীত সংস্কার কর্মসূচিতে আইএমএফ সন্তুষ্ট। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র খবরের কাগজকে জানায়, বাংলাদেশ ঋণের তৃতীয় কিস্তির টাকা পেতে প্রায় সব শর্ত পূরণ করেছে এবং জুন মাসে এই ঋণ ছাড় হবে। তৃতীয় কিস্তিতে বাংলাদেশ ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পেতে পারে।
বিবৃতিতে আইএমএফ বলেছে, ঋণ কর্মসূচির আওতায় চলমান কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে সরকার। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করেছে সরকার। আইএমএফ বলেছে, এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমবে এবং একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ হ্রাস পাবে।
বিনিময় হার পুনরুদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে, তাকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে বহিঃখাতের অভিঘাত মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপে সমর্থন জানিয়েছে আইএমএফ। সুদহার বাজারভিত্তিক করা এবং ডলারসংকট মোকাবিলায় ক্রলিং পেগ চালু করার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত সময়োচিত ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ বলে মনে করে ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থাটি।
গত বছরের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের পর এ পর্যন্ত দুই কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন তৃতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড়ের অপেক্ষায়। এই কিস্তির জন্য গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন শর্তের বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করছে মিশন। আর চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের জন্য আগামী জুনভিত্তিক বেশ কিছু শর্ত পরিপালনের কথা রয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং রাজস্ব আদায় অন্যতম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর নাগাদ পরিপালনের জন্য মোটা দাগে সংশোধিত যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ছাড়া অন্যান্য সব শর্ত পূরণ হয়েছে। তাই তৃতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে প্রতিনিধিদল খুব বেশি আপত্তি তোলেনি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার মনে করছে, আগামী জুনভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে রিজার্ভ ও রাজস্বে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই আবারও এই দুই ক্ষেত্রে ছাড় চায় বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, বাংলাদেশের প্রস্তাবে আইএমএফ মিশন সম্মত হয়েছে।
বিবৃতিতে আইএমএফ বলেছে, সুদের হার উদারীকরণ মুদ্রানীতিতে অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ ও বিনিময় হার সংস্কারের ফলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ কমাতে সহায়তা করবে। আইএমএফ বলেছে, ভবিষ্যতে যদি মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্র হয়, তা হলে নীতি সুদহার আরও কঠোর করার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
আইএমএফ বলেছে, চলতি অর্থবছরের বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আমদানি সংকোচন ও নীতি কঠোর কারণে প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়তে পারে। উল্লেখ্য, এর আগে আইএমএফ আভাস দিয়েছিল বাংলাদেশে এবার প্রৃবদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আগের অবস্থান থেকে সরে আসা হয়েছে কেন- এ প্রশ্নের জবাবে আইএমএফ দলনেতা পাপাজার্জিও বলেন, ‘আগের হিসাব করা হয়েছিল তখন অর্থনীতির চিত্র ছিল ভিন্ন। আমরা হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি বাংলাদেশে চলতি বছর জিডিপি ৫ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি হবে না। তবে আমদানি ঘুরে দাঁড়ালে এবং রিজার্ভের চাপ কমালে আগামী অর্থবছর জিডিপি বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’
আইএমএফ জানায়, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির চাপ আছে। এটি ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। তারা আশা করছে, আগামীতে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমে আসবে এবং মূল্যস্ফীতি কমে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হবে। তারপরও অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ও কিছু ঝুঁকি থাকবে। এসব অভিঘাত মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে।