জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বারবার আলোচনার পরও সংবিধান সংশোধন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে ঐকমত্য কমিশনকে। আগামী রবিবার এ বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সংধিবানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। তবে গণভোট ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় হাত দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠায় নেতারা একমত হতে না পারায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার কমিশনের ওপরই দিয়েছেন। এ বিষয়ে রবিবার সিদ্ধান্ত দেবে ঐকমত্য কমিশন। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরাতেও দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত নেই।
রাষ্ট্র সংস্কারের অমীমাংসিত মৌলিক ইস্যু নিয়ে মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের ১৪তম দিনের আলোচনা শেষে এসব তথ্য জানান তিনি।
কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে অংশ নেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ আমন্ত্রিত ২৮টি রাজনৈতিক দল ও ২টি জোটের প্রতিনিধিরা। আগে আংশিক ঐকমত্য হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো এবং সোমবার আলোচিত সংসদে নারী আসন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ বিষয়ে তারা আলোচনা করেন।
বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দ্বিকক্ষ পার্লামেন্ট নিয়ে আগামী রবিবার সিদ্ধান্ত দেবে ঐকমত্য কমিশন। সেটা আসার পর আমরা সম্মতি বা অসম্মতির বিষয়ে জানাতে পারব। আর দেশের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে একেক জন একেক প্রস্তাব দিচ্ছেন। কেউ চান পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি। এখানে আবার পাওয়ার ফাংশনের বিষয় আছে। সাধারণ বিল কীভাবে পাস হবে, সংবিধান সংশোধন হলে উচ্চকক্ষে কীভাবে পাস হবে- এমন নানা কথা বলা হচ্ছে। তিন দিন আলোচনা করেও এ বিষয়ে ঐকমত্যে আসা যায়নি। তিনি জানান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ভবিষ্যতে কেউ যেন হাত দিতে না পারে, সে জন্য সংবিধানে শক্তিশালী সংশোধনী এনে গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) নির্বাচনব্যবস্থা কোনো বড় একটি দলের বিরোধিতায় আটকে গেলে তা হবে অবিচার। এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, এনসিপি, চরমোনাই পীর, সব ইসলামী দল, গণঅধিকার পরিষদসহ অধিকাংশ দলই পিআর নির্বাচনব্যবস্থার পক্ষে। আমাদের কোনো এক জায়গাতে একটা সমাধানে আসতে হবে।
সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠিত না হলে অথবা গঠিত হওয়া পর্যন্ত সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থন প্রয়োজন হবে। তবে কিছু সুনির্দিষ্ট অনুচ্ছেদ, যেমন- প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ৫৮ক, ৫৮খ এবং ৫৮ঙ) সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে। কমিশন আশা করছে, আগামী সপ্তাহে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কীভাবে নিযুক্ত হবেন, সে বিষয়ে একটি সমাধান আসবে।
নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে সাংবিধানিক মর্যাদার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণআন্দোলনে, বিশেষ করে গত বছরের গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের অনবদ্য ভূমিকার কথা স্মরণ করে তাদের সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।
গত ৩ জুন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ পর্যন্ত ১৩টি বৈঠক করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তাদের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফা আলোচনায় এ পর্যন্ত ৮টি বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ, উপজেলা পর্যায়ে আদালত সম্প্রসারণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা। দ্বিতীয় দফা বৈঠকে এ পর্যায়ে আরও বেশ কিছু ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে আংশিক ঐকমত্য হয়েছে। এখনো ৭টি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয় অমীমাংসিত। কয়েকটি মৌলিক ইস্যু এখনো আলোচনায় আসেনি।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গতকালের বৈঠকের পর এসব ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে বুধ ও বৃহস্পতিবার কমিশন নিজেরা আলোচনা করবে। এরপর দুই দিন বিরতির পর দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের বৈঠক বসবে আগামী রবিবার।