![জেলার নেতাদের সঙ্গে লড়বেন ইউনিয়নের নেতারা](uploads/2024/04/17/1713341793.Up-Election.jpg)
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ ও মিরসরাই উপজেলায় জেলা, উপজেলা নেতাদের সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতারা। ফলে সিনিয়র-জুনিয়ররা নির্বাচনের মাঠে মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের প্রার্থী না দেওয়ায় লড়াইটা নিজেদের মধ্যেই হচ্ছে আগের মতো। এই তিন উপজেলায় দলটির ২৮ নেতা-নেত্রী চেয়ারম্যান ও পুরুষ-মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন।
সীতাকুণ্ড উপজেলা: বন্দরনগরীর প্রবেশদ্বার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা। ভৌগোলিকভাবে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবেও এর গুরুত্ব বেশ। এই উপজেলায় এবারের নির্বাচনে ২ জন আওয়ামী লীগ নেতা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। একজন ইউনিয়নের নেতা। যিনি গেল ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নৌকার প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়েছেন। আরিফুল আলম চৌধুরী রাজু নামের ওই নেতা লড়বেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ৩ বারের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও একসময়ের প্রতাপশালী আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ মঞ্জুর সঙ্গে। আরিফুল আলম চৌধুরী রাজু বর্তমান সংসদ সদস্য এস এম আল মামুনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। গেল ইউপি নির্বাচনের পর তিনি ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন। তার সঙ্গে থাকা ২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তিনিও দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। বাইরে ছিলেন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের। অনেকটা আড়ালে, নীরবে, নিভৃতে থাকা এই নেতা উপজেলা নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আবারও আলোচনায় আসেন।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সীতাকুণ্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ সদস্য আ ম ম দিলসাদ, বাড়বকুণ্ড ইউপি চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী, সৈয়দপুর ইউপি চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম নিজামীসহ আরও কয়েকজন সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হবেন, এমন আলোচনা ছিল। এমনকি গেল দুই সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়েও দলীয় মনোনয়ন না পাওয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়াও প্রার্থী হবেন বলে গুঞ্জন ছিল। যার নিজস্ব বলয় তথা বিশাল কর্মী বাহিনী আছে। তিনি দীর্ঘ ৩ দশক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। দলে পরীক্ষিত ও ত্যাগী এই নেতার আছে বলার মতো রাজনৈতিক স্বতন্ত্র পরিচয়। কিন্তু তিনিও সবার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তার স্ত্রীও আওয়ামী লীগ নেত্রী। এরপরও দুজনের কেউই প্রার্থী হননি।
আলোচনায় থাকা অন্য সিনিয়র নেতারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঈদের আগেই নির্বাচন না করার ঘোষণা দেন। এরপরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে কনিষ্ঠ নেতা আরিফুল আলম চৌধুরী রাজুর নাম। বর্তমানে এই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ মঞ্জু ১৯৯১ সাল থেকে ১৭ বছর সৈয়দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮২ সালে ছিলেন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজের ভিপি। পরে তিনি জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার বাবা মরহুম মিছির আহমেদও ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রথিতযশা শিক্ষক। ১৯৯৬ সাল থেকে মহিউদ্দিন মঞ্জু প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে দলের মনোনয়ন চেয়ে আসছেন। কিন্তু প্রতিবারই দল সেটার মূল্যায়ন করেনি। এবার তিনি উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।
অপরদিকে আরিফুল আলম চৌধুরী রাজু ১৯৯২ সালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ছিলেন সভাপতি। বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। রাজু চৌধুরীর বাবা মরহুম দিদারুল আলম চৌধুরীও ছিলেন বাঁশবাড়িয়ার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর ভাগিনা ও ব্যক্তিগত সহকারী।
সীতাকুণ্ডের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বয়স ও রাজনীতিতে কনিষ্ঠ হলেও রাজু চৌধুরী বর্তমান সংসদ সদস্যের বিশ্বস্ত হওয়ায় তিনি হতে পারেন উপজেলা চেয়ারম্যান। অপরপক্ষের মত হচ্ছে, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন মঞ্জু দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত সিনিয়র নেতা। নির্বাচনে যেহেতু অন্য দলগুলো অংশ নেয়নি, এখানে ভোট পড়বে আওয়ামী লীগ সমর্থক ও কিছু ভাসমান ভোটারের। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন। কেননা জ্যেষ্ঠতার কারণে দলে বেশির ভাগ নেতাকর্মী তার সঙ্গে থাকবেন। তা ছাড়া দীর্ঘ ১৭ বছর জনপ্রতিনিধি থাকায় তিনি পুরো এলাকায় ব্যাপক পরিচিত। এই উপজেলায় পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন গোলাম মহিউদ্দিন ও জালাল আহম্মদ। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জমা দিয়েছেন শাহিনুর আক্তার বিউটি, হামিদা আক্তার ও শামীমা আক্তার লাভলী।
মিরসরাই: একইভাবে মিরসরাইয়েও উপজেলা নির্বাচনে লড়াই করবেন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতারা। মোট ১৩ জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩ জন। অধিকাংশ পদে জুনিয়র নেতারা সিনিয়র নেতার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন।
চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান, তার সঙ্গে লড়বেন জুনিয়র নেতা করেরহাট ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক এনায়েত হোসেন নয়ন, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌস আরিফ, বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি উত্তম কুমার শর্মা ও লন্ডনপ্রবাসী সাবেক যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ মোস্তফা। এখানে ৪ জনই শেখ আতাউর রহমানের জুনিয়র।
চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন বারইয়ারহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য মো. জালাল উদ্দিন। ভাইস চেয়ারম্যান পদেও সিনিয়র জুনিয়রে লড়াই হচ্ছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাহ্ উদ্দিন আহম্মদ লড়বেন বয়সে তার সিনিয়র নেতা করেরহাট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে, অপেক্ষাকৃত জুনিয়র মিরসরাই সদর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল আলমও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ইসমত আরা ফেন্সি, যিনি উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী। তার সঙ্গে লড়বেন জুনিয়র নেত্রী উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি বিবি কুলছুমা চম্পা, অপরজন মীরসরাই উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি মরহুম মোমিনুল ইসলাম টিপুর সহধর্মিণী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা মহিলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম কলি।
সন্দ্বীপ উপজেলা: চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এখানে ৩ পদে মোট ৮ জন মনোনয়ন দাখিল করেছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১ জন আর মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২ জন। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা হলেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান প্রবীণ নেতা ফোরকান উদ্দিন আহমেদ। তার সঙ্গে লড়বেন তার জুনিয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাঈনউদ্দিন মিশন ও মগধরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আনোয়ার হোসেন। উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আনোয়ার হোসেন কিছুদিন আগে ইউপি চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. নাজিম উদ্দিন প্রকাশ জামশেদ, শেখ মোহাম্মদ জুয়েলও মনোনয়ন দাখিল করেছেন। যারা দলীয় পদ অনুসারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় জন থেকে সিনিয়র। পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে জমা দিয়েছেন বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ওমর ফারুক। মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা হলে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জমা দিয়েছেন উপজেলা যুব মহিলা লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হালিমা বেগম ও নাহিদ তানমী।