সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে যুক্ত করার জন্য বিএনপির ওপর বাড়ছে চাপ। বিশেষ করে দীর্ঘ দুই যুগের মিত্র জামায়াতসহ ডান-বাম ঘরানার দলগুলোর ব্যাপারে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে আন্দোলনরত সমমনা শরিক দল ও জোট। আগে যারা জামায়াতের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিলেন, নির্বাচনের পর তারাও কিছুটা সুর পাল্টে ফেলেছেন। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা হিসাব-নিকাশ করে জামায়াত বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে বিএনপি।
যদিও জামায়াতের একাধিক নেতা বলছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও আস্থা বেড়েছে। অতীতের তুলনায় সম্পর্ক এখন ভালো। তবে সেটা খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তা বলা যাবে না। কারণ জোট শক্তিশালী করার ব্যাপারে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো তারা কোনো প্রস্তাব পায়নি। তাদের মতে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একান্ত আগ্রহে জামায়াতের সঙ্গে এখন দূরত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। এমনকি চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও তার অনুরোধে জামায়াত প্রার্থী দেয়নি। যদিও জামায়াতের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই।
কয়েক দিন ধরে টানা বৈঠকে অংশ নেওয়া সমমনা একাধিক দলের শীর্ষ নেতারা বলেন, জামায়াতকে যুক্ত করার কথা বলেছি। কারণ শক্তির বিচারে বিএনপির পরই জামায়াতের অবস্থান। এ ছাড়া ভোট বর্জনকারী ইসলামিপন্থি দলসহ বাম দলগুলোকে কীভাবে এক ব্যানারে নিয়ে আসা যায়, তার দায়িত্ব নিতে বিএনপিকে বলা হয়েছে। তবে জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপি খোলাসা করেনি। তারা কখনো প্রকাশ্য কিছু বলবে না, তাদের মনোভাব বোঝাও যাচ্ছে না। তবে রাজপথের আন্দোলনে বিএনপিও জামায়াতের অনুপস্থিতি কিছুটা হলেও টের পাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান খবরের কাগজকে বলেন, এটা জামায়াত বা ইসলামপন্থি দলের কোনো ব্যাপার নয়। শুধু জামায়াত-বিএনপি নিয়ে কেন কথা ওঠে? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যেসব দল কাজ করছে সবাইকে যুক্ত করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। ভোট বর্জনকারী ৬৩টি রাজনৈতিক দল সবাইকে নিয়েই রাজপথের আন্দোলন জোরদার ও শক্তিশালী করার কথা হয়েছে। কারণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে জনগণকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, প্রতিটি দল ও জোটের আদর্শ আলাদা। তার পরও ‘নির্দলীয় সরকার’- এই কমন ইস্যুতে সবাই আলাদাভাবে রাজপথে রয়েছে। তাই আগামী দিনে গণতন্ত্রবিরোধী সরকার হটাতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।’
সূত্রমতে, কয়েক দিন ধরে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি বৈঠক করছে শরিক দল ও জোটের সঙ্গে। গত রবিবার ১২-দলীয় জোট ও এলডিপি, সোমবার জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, মঙ্গলবার গণ অধিকার পরিষদ ও বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য এবং গত বুধবার গণফোরাম ও গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা। এসব বৈঠকে আলোচনায় গুরুত্ব পায় জামায়াত। মোটাদাগে জামায়াতসহ ভোট বর্জনকারী সব দলকে এক ব্যানারে যুক্ত করে আবারও রাজপথে আন্দোলনের পরামর্শ দিয়েছে শরিক দলগুলো। সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি সমমনাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। এর আগে যুগপৎভাবে ৮ জানুয়ারি কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচি পালন করেছে দলগুলো।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে। আমরা রাজপথে বড় কর্মসূচি পালন করে আসছি। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব আসেনি। তবে যেকোনো উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। জামায়াতে ইসলামী আন্দোলনে ছিল এবং আগামীতেও থাকবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের অন্যতম এক নেতা বলেন, এত বৈঠক করে লাভ কী? আন্দোলনের সময় মাঠে না থাকলে তো হবে না। জামায়াতের মতো কারা এত আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছে? বিএনপি এখন ফিল করেছে জামায়াতকে ছাড়া আন্দোলন শক্তিশালী করা সম্ভব না, জামায়াতকে আন্দোলনে দরকার। তবে আন্দোলন এখন যেভাবে চলছে, আগামীতে একইভাবে চলবে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক আগেও গভীর ছিল না, এখনো নেই। তাই সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে বিএনপিকেই উদ্যোগ নিতে হবে।’
বিএনপির কাছেও প্রধান্য পাচ্ছে জামায়াত, নরম সুর অন্যদের
নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপির পাশাপাশি কর্মসূচি পালন করে আসছে জামায়াতে ইসলামী। শরিক দলগুলোর মতো এবার কর্মসূচি নির্ধারণে দলটির মতামত নিতে পারে বিএনপি। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, আন্দোলনে রাজপথে এবারও পাশে থাকবে জামায়াত। আগে জামায়াতের ব্যাপারে একটি জোটের শীর্ষ নেতাদের আপত্তি থাকলেও বর্তমানে তা অনেকটাই কমেছে। যুগপৎ আন্দোলন নয়, এক মঞ্চে জামায়াতের ব্যাপারে তাদের আপত্তি রয়েছে। তবে চূড়ান্ত সময়ে সেটিও থাকবে না বলে মনে করছেন অনেকেই।
জানা গেছে, জামায়াত প্রশ্নে আগে আপত্তি থাকলেও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা এখন সেই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। বিশেষ করে নির্বাচন বর্জনের পর সবাই জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎভাবে আন্দোলনে যেতে সমস্যা দেখছেন না। তবে দুই বা তিনটি দলের এখানো আপত্তি রয়েছে। তাদের দাবি, জামায়াতকে যুক্ত করতে অন্য দলগুলোকে দিয়ে কথা বলাচ্ছে বিএনপি।
যদিও সমমনা দলের নেতাদের দাবি, বিএনপি বা জামায়াত কেন আমাদের দিয়ে প্রস্তাব করাবে? কথা বলতে বলবে? বিএনপির পরই জামায়াতের সাংগঠনিক ভিত্তি। সবাই জামায়াতের অনুপস্থিতি অনুভব করছে। আন্দোলন সফল করতে হলে জামায়াতকে লাগবে- এমন কথা হয়তো আমার প্রকাশ্যে বলেছি, আবার অনেকে গোপনে গোপনে বলছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক খবরের কাগজকে বলেন, সব রাজনৈতিক দল যার যার মতো করে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। এখানে জামায়াত থাকলেও কারও কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কারণ জামায়াত তাদের নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে।
১২-দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, এবারের আন্দোলনে জামায়াত পাশে থাকলে তাদের তরফ থেকে কোনো আপত্তি নেই। কারণ দেশের মানুষের মনোভাব বুঝে রাজনীতি করতে হবে।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর খবরের কাগজকে বলেন, গত ১৬ বছরে সরকার এতটাই শক্তিশালী হয়েছে যে তাদের সরানো খুবই কঠিন। তাই সব রাজনৈতিক দলকে একমত হতে হবে। সেখানে জামায়াত থাকলেও কোনো আপত্তি নেই। কারণ জামায়াতের শক্তি কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, অনেকেই বলছেন বিগত আন্দোলনে জামায়াত থাকলেও সেভাবে তাদের শক্তি প্রদর্শন করেনি। এ জন্য বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েন দায়ী। তাই জামায়াতকে কাজে লাগিয়ে এক ব্যানারে বা এক প্ল্যাটফরমে আন্দোলন করতে হবে।
ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি
বিএনপির সঙ্গে বেশ কয়েকটি ইসলামি দলের সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যে ইসলামি দলগুলোও নিজেদের মধ্যে বন্ধন তৈরিতে আগ্রহী। তাই মতভেদ ভুলে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে কেন্দ্রীয় নেতারা কাজ করছেন বলেও বিএনপির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। তবে এখনই যুগপৎভাবে আন্দোলনে যোগ দিতে রাজি নয় বলে জানিয়েছেন ইসলামি দলগুলোর একাধিক নেতা।
ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। তবে নির্বাচনের পর সেই আলোচনাও থেমে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের মতো রাজপথে থাকব। প্রস্তাব পেলেও যুগপৎভাবে আন্দোলনে যোগ দেব না।’
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটসঙ্গী ছিল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। পরে ২০০৬ সালে জোট থেকে বের হয়ে আসে। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জালালুদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে কমবেশি যোগাযোগ রয়েছে তাদের। প্রস্তাব পেলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।