উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারী এমপি-মন্ত্রী ও তাদের স্বজনদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত পরিষ্কার হয়নি। প্রথম দিকে স্বজনদের নির্বাচনে না দাঁড়ানোর নির্দেশনা দিলেও এখন বলা হচ্ছে এমপি-মন্ত্রীরা যেন প্রভাব বিস্তার না করে। দলের কেন্দ্রের এমন দোলাচলের কারণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
জেলা পর্যায়ের সাতজন নেতা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ‘কার্যক্রম’ কী হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো নির্দিষ্ট বার্তা পাননি তারা। তবে যা-ই হোক, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুসারে চলতেই বাধ্য তৃণমূল। এর বাইরে তাদের আর কোনো বক্তব্য নেই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা প্রার্থী হতে পারবেন না, প্রার্থী হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে এমন কথা একাধিকবার বলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের বিষয়ে দলের কী সিদ্ধান্ত, তা এখনো সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এখন আবার বলা হচ্ছে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করলে ব্যবস্থা নেবে আওয়ামী লীগ।
গতকাল রবিবার উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা আওয়ামী লীগের নীতিগত সিদ্ধান্ত, এখানে আইনি কোনো বিষয় নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, প্রতীক ছাড়া নির্বাচন করলে নির্বাচন বেশি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে- এমন ভাবনা থেকে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ স্থগিত করেছে।
দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তৃণমূল পর্যায়ে বিতর্ক ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এড়াতে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের বিষয়ে কঠোর না হয়ে এখন নরম হয়েছে আওয়ামী লীগ। এখন দলের নজর উপজেলা নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখা। কারণ নির্বাচনে দলের অনেক এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এমনকি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেক স্বজনরাও নির্বাচনে আছেন। যদি এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ কঠোর হয়, তাহলে দলের তৃণমূলে ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে যেতে পারে। তাই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের ওপর সরাসরি কোনো চাপ প্রয়োগ করতে চায় না কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে তৃণমূলে এখনই স্বজনদের বিষয়ে কঠোর বার্তা দিলে নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বেন। কেউ এমপি-মন্ত্রীর পক্ষে থাকলেও তৃণমূলের নেতারা দলীয় নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে চাইবেন। ফলে এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব মেটানো যাবে না বরং বাড়বে। গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি।
উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের প্রার্থী হওয়া নিয়ে দলের তৃণমূলকে কী বার্তা দেওয়া হয়েছে- জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন- উপজেলা নির্বাচন। আমরা প্রভাবমুক্ত, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করতে চাই। নির্বাচন সম্পন্ন করার পর দলের নির্দেশ অমান্যকারীদের বিষয়ে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলের শাস্তি মাঝেমধ্যে অভ্যন্তরীণভাবেও হয়।’
এদিকে দলের কেন্দ্রীয় অবস্থান যা-ই থাকুক, তা মেনে নেবেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। যদিও জেলার নেতাদের মধ্যে একধরনের দোলাচল কাজ করছে। জেলা পর্যায়ের অনেক নেতার মধ্যে ক্ষোভও কাজ করছে। তবে তারা তা প্রকাশ্যে এখনই আনতে চান না বলেই জানিয়েছেন। এ বিষয়ে এক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা এখনো আমরা দল থেকে পাইনি। আমার জেলায় দুজন প্রার্থী তারা এমপির কোনো স্বজন না। তবুও তাদের বিষয়ে এমপিদের প্রভাব রয়েছে। দলের এ বিষয়টি এই মুহূর্তে আমরা দলের কেন্দ্রকে বলতে পারছি না। কিন্তু হয়তো পরে বলতে পারব।’
বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘আমার জেলায় এমপি-মন্ত্রীদের তেমন কোনো সমস্যা নেই। দল এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি। দেখি দল কী সিদ্ধান্ত জানায় তারপর ভাবা যাবে।’
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী কাজী আব্দুল ওয়াদুদ দারা বলেন, ‘আসলে দল আমাদের যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটা বাস্তবায়ন করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা সেই লক্ষ্যেই রয়েছি।’
চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারী বলেন, আসলে উপজেলা প্রার্থীদের সবাই স্থানীয় এমপির সাহায্য চান। এটা স্বাভাবিক বিষয়। তিনি মনে করেন, দল যে নির্দেশনা দিয়েছে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে। কারণ হিসেবে দুলাল বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে এমপি গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে গোলাম মূর্তজা পাপ্পা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। নাটোরে প্রতিমন্ত্রী পলকের শ্যালক মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। আরও অনেকে করবেন। দলীয় ব্যবস্থা সব সময় তো ওপেন হয় না। কিছু ব্যবস্থা অভ্যন্তরীণও হয়। আমার জেলায় এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের বিষয়টি নেই। থাকলে আমরাও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মানতাম।’
গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক মণ্ডল বলেন, ‘আসলে এখানে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই। কেন্দ্র আমাদের যে নির্দেশ দেয়, আমরা তা বাস্তবায়নে মাঠে কাজ করি। আমার এই জেলায় দলের নেতা-কর্মীরা যে যার মতো করে তার প্রার্থীর জন্য কাজ করছেন। দল আমাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি তাই আমরাও এ বিষয়ে বেশি মন্তব্য করতে চাই না।’
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীরজাদা কাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কেন্দ্র থেকে আমরা এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। যা করতে বলবে আমরা তা বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করব।’
এদিকে গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সভায় এমপি-মন্ত্রীদের উপজেলা নির্বাচনে প্রভাবমুক্ত রাখতে বার্তা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগপ্রধান দলীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের জন্য ছাড় দিতে এমপি-মন্ত্রীদের নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং না করতে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা।
যদিও উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাইয়ের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে, কিন্তু দলের অনেক এমপি, এমনকি মন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন। তবে কয়েকজন এমপির স্বজন সরেও দাঁড়িয়েছেন। স্বজনদের বড় একটি অংশ এখনো সরে দাঁড়াননি। এর আগে দলীয় সিদ্ধান্তের পর আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালকসহ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির স্বজন ভোটের লড়াই থেকে সরে দাঁড়ান। তৃতীয় ধাপে সারা দেশে এমপি-মন্ত্রীদের প্রায় দুই ডজন স্বজন প্রার্থী হয়েছেন।
গতকাল নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই শাহাদাত হোসেনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়। শাহাদাত তার হলফনামায় মামলা ও আয় বিবরণীর তথ্য গোপন করায় গতকাল দুপুর ১২টায় রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইসমাঈল তার মনোনয়ন বাতিল করেন। তবে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে ওবায়দুল কাদেরের ভাগ্নে (আপন বোনের ছেলে) মাহবুবুর রশীদ মঞ্জু প্রার্থী হয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান পদে।