![পাহাড়ি সংগঠনে জিম্মি শিল্পনগরী](uploads/2023/12/02/1701493573.3.-Khagrachhari-BSCIC.jpg)
প্রতিষ্ঠার এক যুগ পার করেছে খাগড়াছড়ি বিসিক। অথচ এই শিল্প নগরীর ৭১ প্লটের বিপরীতে বর্তমানে চালু রয়েছে মাত্র দুটি কারখানা। জেলায় উদ্যোক্তা কিংবা বড় ব্যবসায়ীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। তা সত্ত্বেও এখানে গড়ে ওঠেনি উল্লেখ করার মতো শিল্প প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কেন এই অবস্থা? উত্তর খুঁজতে গিয়ে উঠে এলো সমস্যা ও সংকটের কথা।
পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে শিল্পের বিকাশ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে খাগড়াছড়িতে বিসিক শিল্পনগর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয় সরকার। ১৯৮৯ সালে শহরের জিরো মাইল এলাকায় ১০ একর জমি অধিগ্রহণ করার পর ১৯৯৯ সালে শুরু হয় শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠার কাজ। সেই উন্নয়ন কাজ শেষ হয় ২০০৭ সালের জুন মাসে। এরপর প্লট বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয় ২০১১ সাল থেকে।
খাগড়াছড়ি বিসিক শিল্প নগরীতে মোট প্লট রয়েছে ৭১টি। অথচ গত সাড়ে বারো বছরে ৭১টি প্লটের মধ্যে কেবল ৩৮টি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। আর প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে মাত্র দুটি। এর একটি ‘বেগম অটো পুষ্টি মিল’ এবং অন্যটি ‘আজিজ ফ্লাওয়ার মিল’। এর আগে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও বেপরোয়া চাঁদাবাজি, বিপণনে জটিলতা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং সরকার প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধার অভাবে উদ্যোক্তারা সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘চেঙ্গী মিনারেল ওয়াটার’, ‘তাঁত ও কুঠির শিল্প’ এবং ‘কর্ণফুলী গোল্ডেন পাম কারখানা’ অন্যতম।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বিনিয়োগ বিমুখিতার প্রধান কারণ পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজি। একটি দুটি নয়, অন্তত চারটি সশস্ত্র আঞ্চলিক সংগঠনকে চাঁদা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের।
বেশ কয়েক বছর আগে বিসিকে প্লট বরাদ্দ নিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেননি ব্যবসায়ী আকবর হোসেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র প্রভাব। এটি একেবারেই ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। বছরের পর বছর ধরে শতশত কোটি টাকার নীরব চাঁদাবাজি চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। ব্যবসা করলে ধার্যকৃত চাঁদা পরিশোধ করতেই হবে। অন্যথায় গুম, অপহরণ এবং খুনের শিকার হতে হয় ব্যবসায়ীদের।’
এখন থেকে ঠিক ২৬ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তি চুক্তি) সম্পাদিত হয়। অথচ এখনো পার্বত্যাঞ্চলে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্য দৃশ্যমান। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরের আগে কেবল তৎকালীন গেরিলা সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে (পিসিজেএসএস) চাঁদা দিতে হতো। জেএসএস তখন পরিচিত ছিল ‘শান্তিবাহিনী’ নামে। আর চুক্তির এত বছর পর এসে খাগড়াছড়িতে এখন চাঁদা দিতে হয় চারটি সংগঠনকে।
শান্তি চুক্তি নিয়ে মতবিরোধের জের ধরে এক সময়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) বা শান্তিবাহিনী এখন চার ভাগে বিভক্ত। বর্তমানে পিসিজেএসএস, জেএসএস সংস্কার, প্রসিত বিকাশ খিসার নেতৃত্বাধীন চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে পাহাড়ে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুল মজিদ বলেন, ‘এখনাকার ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ করতে হলে সবার আগে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর লাগাম টানতে হবে। অসহনীয় চাঁদাবাজিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। নইলে কখনোই এখানে বড় শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না।’
বিসিকে প্লট বরাদ্দ নেওয়া উদ্যোক্তা মো. সেলিম বলেন, ‘বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ না থাকায় ব্যবসায়ীরা এখানে পুঁজি খাটাতে চান না। পার্বত্য অঞ্চলের বিরাজমান পরিস্থিতিই বিনিয়োগে আস্থাহীনতার প্রধান কারণ।’
এদিকে নিরাপত্তা সংকট ছাড়াও বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা এখানে রয়েছে। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বিপণনে জটিলতা, সরকার প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধাসহ ব্যাংক ঋণ না পাওয়াকে বড় বাধা বলে মনে করছেন বিসিকে প্লট বরাদ্দ নেওয়া উদ্যোক্তারা।
বিসিকে প্রায় আট বছর আগে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য শতরূপা চাকমা। বলেন, ‘একজন বিনিয়োগকারীকে ব্যাংক থেকে যেসব সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন, তারা সেভাবে এগিয়ে আসছে না। একটি ফ্লাওয়ার মিল চালু করতে কয়েক বছর আগে ঋণের আবেদন করেছি, ব্যাংক থেকে কোনো সাড়া পাইনি। নতুন ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।’
নতুন করে বিসিক এর প্লট বরাদ্দ নেওয়া গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘ড্রেনেজ ব্যবস্থা, রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি এবং নিরাপত্তাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও অনেক সংকট এখানে রয়েছে। বিসিক শিল্প নগরীতে গ্যাসের কোনো সংযোগ নেই। অথচ এই জেলার মানিকছড়ি উপজেলাতেই রয়েছে সেমুতাং গ্যাসক্ষেত্র।’
খাগড়াছড়ি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর পরিচালক সুদর্শন দত্ত বলেন, ‘রামগড় স্থলবন্দরের কল্যাণে নতুন করে রামগড়-বারৈয়ারহাট সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি-রামগড় সড়ক প্রশস্ত করে যুগোপযোগী করা না হলে এখানে ব্যবসার বিকাশ ঘটবে না।’
বিসিক এর খাগড়াছড়ি কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপব্যবস্থাপক আলী আল রাজী বলেন, ‘চলতি বছরের জুলাই মাসে নতুন করে আরও ১৭টি প্লট বরাদ্দ নিয়েছে নতুন ছয়টি প্রতিষ্ঠান। আশাকরি ২০২৪ সালের জুনের মধ্যেই তারা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে পারবে।’
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, ‘পাহাড়ে আঞ্চলিক সংগঠনের চাঁদাবাজির সমস্যা দীর্ঘ বছরের। আমি কিছুদিন হলো এই জেলার দায়িত্ব নিয়েছি। চেষ্টা করছি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে।’
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, ‘দারুণ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে বিসিক শিল্পনগরীটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তবে এই শিল্পনগরীটি পূর্ণাঙ্গভাবে সচল হলে এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। আর্থিকভাবে লাভবান হবেন প্রান্তিক মানুষরা।’