![শান্তিচুক্তির বছর ২৬ : জীবনমানের ব্যাপক উন্নয়ন](uploads/2023/12/02/1701498871.shantichukti.jpg)
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৬তম বর্ষপূর্তি পালিত হচ্ছে আজ ২ ডিসেম্বর। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অবৈধ অস্ত্র ও চাঁদাবাজির কথা বাদ দিলে চুক্তির হাত ধরে পিছিয়ে পড়া পার্বত্য অঞ্চলে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ।
বিশেষ করে শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা আর পর্যটনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধি এসেছে পাহাড়ের মানুষের জীবনে।
তবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে নানা টানাপোড়েন চলে আসছে গত দুই যুগ ধরে। বেড়েছে অবিশ্বাস আর দূরত্বও। বাস্তবায়ন নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী দুটি পক্ষেরই রয়েছে ভিন্নমত। ২৬ বছর পরেও চুক্তির ‘পূর্ণ বাস্তবায়ন’ না হওয়ায় ক্ষোভ আর হতাশার কথা বলছে চুক্তির স্বাক্ষরকারী দল জেএসএস। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতার ওপর ভরসা রাখতে চায় দলটি। সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে, ৭২টির মধ্যে ৬৯টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।
দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘স্থায়ী শান্তি’ ফিরিয়ে আনাই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু ‘শান্তিচুক্তি’ হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিতি পাওয়া এই চুক্তির ২৬ বছরেও শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে। কেবল পাহাড়ি-বাঙালি জাতিগত সংঘাত কমেছে। বেড়েছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। শান্তির পরিবর্তে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিতে মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে ওঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাহাড়ের এ পরিস্থিতির জন্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়াকে ‘কারণ’ বলে দাবি করছেন চুক্তি সম্পাদনকারী দল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন ‘জনসংহতি সমিতি’।
জনসংহতি সমিতি বিভিন্ন সময় দাবি করে আসছে, মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে এখনো কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে সাধারণ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন এবং প্রত্যাগত জেএসএস সদস্যসহ ‘অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু’ ও ‘প্রত্যাগত উদ্বাস্তু’ পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেই। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে সার্বিক পরিস্থিতি জটিলতর অবস্থা ধারণ করছে।
চুক্তির মূল্যায়ন নিয়ে তরুণ প্রজন্মেও আছে নানান ভাবনা। রাঙামাটি শহরের বাসিন্দা দিশারী চাকমা বলেন, ‘চুক্তির ফলে পাহাড়ে হাজার কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, মেডিকেল কলেজ ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বিদ্যুতায়ন, রাস্তাঘাট বেড়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পাহাড়ের মানুষ এর সুফল ভোগ করছেন।’
শহরের দেওয়ান পাড়ার বাসিন্দা তনয় দেওয়ান বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে আশাতীত উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ অঞ্চলের বনায়ন, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়েনি। পাহাড়ে ভূমির ব্যবহার, বিশেষায়িত জুমচাষ, কৃষি, কাপ্তাই হ্রদের সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর তেমন গুরুত্বারোপ করা হয়নি’।
আলোচনায় আঞ্চলিক পরিষদ, তিন জেলা পরিষদ ও ভূমি বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে না। সরকারের মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে সচল রাখা হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। ভূমি বিরোধই সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে বেশি।
২২ হাজারের বেশি ভূমি বিরোধের আবেদন কমিশনে জমা পড়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন করা হয়। আইনটি ২০১৬ সালে সংশোধন করা হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে থেমে আছে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন’ (ল্যান্ড কমিশন)-এর কার্যক্রম। রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, আঞ্চলিক পরিষদ, ও তিন জেলা পরিষদের নির্বাচন দরকার। নির্বাচন না হওয়ায় জবাবদিহি নাই। এ জন্য জনআকাঙ্ক্ষাও পূরণ হচ্ছে না।
সংঘাত থামছে না
‘পাহাড়ের মানুষের অধিকার আদায়’ আর চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের ‘দৃশ্যমান দাবি’র আড়ালে পাহাড়ে এখন সক্রিয় ৬টি আঞ্চলিক সংগঠন সশস্ত্র তৎপরতার লিপ্ত। সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও প্রসীত খীসার ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ ন্যাশনালিস্ট পার্টি এবং সদ্য জন্মানো কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) আলাদা ‘জোট’ করে সংঘাতে জড়িয়ে আছে। তবে নেতৃত্ব আর মতের বিরোধিতা থাকলেও এই চার আঞ্চলিক দলই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়।
অভিযোগ আছে, নানান উৎস থেকে বছরে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা চাাঁদাবাজি করে আসছে আঞ্চলিক দলগুলো। এসবের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা আর আধিপত্য বিস্তারে নির্বিচারে একের পর এক খুন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় অস্থির হয়ে উঠেছে পাহাড়ের পরিস্থিতি। আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতে প্রাণহানির পরিসংখ্যান নেই কারও কাছেই। তবে গণমাধ্যমে আসা তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে এখন পর্যন্ত গত ১০ বছরে পাহাড়ি তিন জেলায় খুন হয়েছেন চার শতাধিক মানুষ। অপহরণের শিকার সাড়ে ৫০০-এর বেশি। এ ছাড়া প্রসীতপন্থি ইউপিডিএফের ৩৫০ জন, সংস্কারপন্থি জেএসএস (এমএন লারমা) দলের ৮৩ জন খুন হয়েছেন প্রতিপক্ষের হাতে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হাবিব আজম বলেন, আঞ্চলিক দলগুলো বিভিন্ন উৎস থেকে বছরে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে আসছে। এতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা আর আধিপত্য বিস্তারে নির্বিচারে একের পর এক খুন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় অশান্ত হয়ে আছে পাহাড়ের পরিস্থিতি।
চুক্তি বাস্তবায়ন কত দূর
দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য চুক্তিতে সংবিধানের সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক’ ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছে পাহাড়ের স্থানীয় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। গতকাল শুক্রবার রাঙামাটি শহরে এই দাবিতে মানববন্ধন করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ (পিসিসিপি)। মানববন্ধনে নেতারা বলেন, চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য ২৬টি জাতীয় আইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামসম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট ১২টি আইনসহ মোট ৩৮টি আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘আমরা বলতে বলতে হয়রান হয়ে গেছি। এটা আমরা আশা রাখব, সারা দেশের ১৮ কোটি মানুষ এবং সরকার, আমাদের মাননীয় নেত্রী শেখ হাসিনা উনি আমাদের বিষয়ে সংবেদনশীল। আমরা আশা রাখব, আমাদের যেন আর বলতে না হয়। এবারে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করে এলাকায় যেন স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রত্যাশা করব।’
রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘শান্তিচুক্তির মূল বিষয় ভূমি কমিশন, পুলিশ, বন বিভাগ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। তবে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। ৭২টির মধ্যে ৬৯টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। কাঁঠালের আমসত্ত্ব হয় না। আওয়ামী লীগ চুক্তি করেছে, বাস্তবায়নও করবে। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব রেখে ও নেতা-কর্মীদের হত্যা করে এর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’
দীপংকর আরও বলেন, যারা শান্তিচুক্তিকে কালোচুক্তি, সংবিধানবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী বলেছিল তাদের সঙ্গে জনসংহতি সমিতি আঁতাত করে ২০০১ সালের নির্বাচন করেছে। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। এগুলো চুক্তি বাস্তবায়নে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা। যেকোনো মূল্যে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি সিদ্ধান্ত নিতে না পারি, বিবেচনায় আনতে না পারি, তাহলে ২৬ বছর পরেও আরও অনেক বছর পার হবে। তারপরও আমরা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের মুখ আমরা দেখব না।’