![শুল্ক কমানোর প্রভাব পড়েনি বাজারে](uploads/2024/02/13/1707804476.goods.jpg)
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে। সরকার রমজান মাসকে কেন্দ্র করে চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরে শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়। কিন্তু পাঁচ দিন চলে গেলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। রমজান আসতে মাত্র এক মাস বাকি। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার কিছু পণ্যের শুল্ক কমিয়েছে বলে তারা শুনেছেন। কিন্তু কোম্পানিগুলো এখনো ওইস ব পণ্যের দাম কমায়নি।
তারা জানান, আগের বেশি দামে কেনা পণ্য বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। এখনো বোতলজাত তেল ১৭৩ টাকা লিটার, ১৪০-১৪৪ টাকা কেজি চিনি, ১০৫-১১০ টাকা কেজি ছোলা, ২৫০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজিতে খেজুর বিক্রি করা হচ্ছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সরেজমিন ঘুরে সংশ্লিষ্ট বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
অন্য বছরে কম দাম থাকলেও এবার ডলারসংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন অজুহাতে রমজান আসার দুই মাস আগেই ছোলার দাম বেড়ে যায়। ৮৫-৯০ টাকার ছোলা ১২০ টাকায় কিনতে হয় ভোক্তাদের। এ নিয়ে হইচই পড়লে নতুন সরকার শুল্ক কমানোর চিন্তা করে। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে আগেই চিনি-তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হলে ভোক্তাদের মাঝে চরম হতাশা দেখা দেয়। সরকার গত ৮ ফেব্রুয়ারি বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল, চিনি, তেল ও খেজুরের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত বৃহস্পতিবার পাঁচটি আলাদা প্রজ্ঞাপনে এসব পণ্যের শুল্ক বিভিন্ন পর্যায়ে কমানোর সিদ্ধান্ত জানায়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী সোনালী ট্রেডার্সের আবুল কাশেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘শুনেছি সরকার কিছু পণ্যে শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু কোম্পানি তো কমায়নি। তারা এখনো আগের রেটেই সব পণ্য বিক্রি করছে। এ জন্য আমাদেরও বেশি দামে তেল বিক্রি করতে হচ্ছে।’ একই বাজারের মিলু ট্রেডার্সের মিলু বলেন, ‘এখনো কম দামের তেল কোম্পানি দিচ্ছে না। সরকার শুল্ক কমালেও কোম্পানি কমায়নি। তাই আগের মতোই এক লিটার ১৬৫ টাকা, দুই লিটার ৩৩১ টাকা ও পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল ৭৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
তেল কোম্পানির বেঁধে দেওয়া সেই রেটে এক লিটার ১৭৩ টাকা, দুই লিটার ৩৪৬ ও পাঁচ লিটার ৮৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান। দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে একই বাজারের ইউসুফ জেনারেল স্টোরের ইউসুফ বলেন, ‘কমেনি কোনো পণ্যের দাম। এখনো আগের রেটেই বিক্রি করতে হচ্ছে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লাতেও বেশি দামে তেল বিক্রি করতে দেখা গেছে।’
উল্লেখ্য, দেশে বছরে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ টন তেল আমদানি হয়। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই ভোজ্যতেলের চাহিদা সাড়ে তিন লাখ টন। রমজান মাস ঘনিয়ে এলে ডলারসংকটের অজুহাতে গত ডিসেম্বরে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রতি লিটার ১৭৩ টাকা ও পাঁচ লিটার ৮৪৫ টাকা। এক মাস আগেও এসব দামে তেল বিক্রি হয় বলে টিসিবি জানিয়েছে।
রমজানে চিনির চাহিদাও অনেক বেড়ে যায়। তাই সরকার এই পণ্যের ওপর থেকেও শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু এখনো বাজারে কম দামের চিনি পাওয়া যাচ্ছে না বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান। কৃষি মার্কেটের সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহের ও কারওয়ান বাজারের সালমান ট্রেডার্সের মাসুম বলেন, বিভিন্ন কোম্পানি চিনির দাম বাড়ানোর পরও সহজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সরকার শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। এখন পাওয়া যাচ্ছে চিনি। তবে আগের বেশি দামেরটাই। প্যাকেটজাত চিনি ১৪৪ টাকা ও খোলা চিনি ১৪০ টাকা কেজি। টাউনহল বাজারসহ অন্যান্য বাজারেও বর্তমানে চিনি পাওয়া যাচ্ছে। তবে দাম কমেনি। কোম্পানি কম দামের চিনি ছাড়েনি।
সারা বছরে ২০ লাখ টন চিনি লাগে। তবে রমজান মাসে চিনির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। প্রতি মাসে দেড় লাখ টন লাগলেও রমজানে দ্বিগুণ লাগে। অন্যান্য পণ্যের মতো আগে থেকেই বেড়ে গেছে এর দাম। ডলারসংকটের অজুহাতে গত ১৩ আগস্ট দেশের বাজারে চিনির দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। খোলা চিনি ১৪০ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১৪৪ টাকা কেজিতে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারও সেই দাম ঘোষণা দেয়। কিন্তু কয়েক মাস ধরে কোনো কোনো বাজারে ১৪৫-১৫০ টাকা পর্যন্ত কেজিতে বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে বর্তমানে কিছুটা কমে ১৪০-১৪৪ টাকায় খোলা ও প্যাকেট চিনি বিক্রি করা হচ্ছে বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান।
রমজানে ইফতারি আইটেম হিসেবে ছোলার কদর বেড়ে যায়সব শ্রেণির মানুষের কাছে। অন্যান্য পণ্যের মতো ছোলার দামও অনেক বেড়ে যায়। এক মাস আগে ছোলা ছিল ৮৫-৯০ টাকা কেজি। কয়েক দিন আগে ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। তবে এ সপ্তাহ থেকে কিছুটা কমে ১০৫-১১০ টাকা হয়েছে বলে বিক্রেতারা জানান। কারওয়ান বাজারের সালমান ট্রেডার্সের মাসুম বলেন, আগে দাম বাড়লেও কয়েক দিন থেকে কমেছে। বর্তমানে ১০০-১০৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হচ্ছে। কম দামে কেনা হলে আরও কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হবে।
দেশে বছরে দেড় লাখ টন ছোলার চাহিদা। রমজানেই এক লাখ টনের মতো লাগে। অন্যান্য পণ্যের মতো এই পণ্যের দামও বেড়ে গেছে। আগে ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও বিভিন্ন অজুহাতে সেঞ্চুরি ছাড়িয়েছে।
রমজানে অন্যান্য জিনিসের মতো আদার চাহিদাও বেড়ে যায়। তাই ক্রেতাদের বাড়তি দামেই কিনতে হয়। বর্তমানে ২০০-২২০ টাকা কেজি বিক্রি বলে বিক্রেতারা জানান। টাউনহল বাজারের রফিক বলেন, দাম কমে না। রমজানে হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেড়ে যায়। তবে বর্তমানে ২০০-২২০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যান্য বাজারেও এসব দামে আদা বিক্রি হচ্ছে বলে খুচরা বিক্রেতারা জানান।
রমজানে বিভিন্ন আইটেম তৈরি করতে পেঁয়াজেরও চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। সারা দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টনের মতো হলেও রমজানে পেঁয়াজ লাগে প্রায় পাঁচ লাখ টন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও ভারত আমদানি বন্ধ ঘোষণা করায় দেশে টালমাটাল হয়ে পড়ে পেঁয়াজের বাজার। বর্তমানে ১০০ টাকার কম বিক্রি হচ্ছে না।
ইফতারির প্রথম ও প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে খেজুর। অন্যান্য পণ্যের মতো খেজুরের চাহিদাও ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ধনী-গরিব সবার পাতে ওঠে খেজুর। বছরে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টন খেজুর লাগলেও রমজানে প্রায় ৫০ হাজার টন লাগে। অন্যান্য পণ্যের মতো বাজেটের পর থেকেই বেড়ে গেছে খেজুরের দাম। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, মান ভেদে ৫০-৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে দাম। কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর ভ্যারাইটিজ স্টোরের আওলাদ বলেন, সব খেজুরের দাম আগেই বেড়ে গেছে। বর্তমানে বস্তার জাহেদী খেজুর ২২০ টাকা, তিউনিশিয়ার খেজুর ৫০০-৫৫০ টাকা, আম্বার ও মরিয়ম খেজুর ১২০০ টাকা, আদম খেজুর ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারাও বলছেন, রমজানের আগেই গত বছরের চেয়ে খেজুরের অনেক বেশি দাম বেড়ে গেছে। শুনেছি সরকার শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু আমরা কম দামের খেজুর কিনতে পারিনি। তাই বিক্রিও করা যাচ্ছে না।
অন্যান্য পণ্যের মতো শীতের ভরা মৌসুমে ইফতারির প্রয়োজনীয় পণ্য শসার দামও বেড়ে গেছে। কারওয়ান বাজারের করিম নামে এক খুচরা বিক্রেতা জানান, আগে কম দামে বিক্রি করা হলেও বর্তমানে শসার দাম বেড়ে ৬০-৭০ টাকা কেজি, বেগুনের কেজি ৬০-৮০ টাকা। তবে কাঁচামরিচের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমেছে। বর্তমানে কাঁচামরিচের কেজি ৫০-৬০ টাকা। লেবুর ডজন ৬০-৯০ টাকা।