![জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের পরিকল্পনা](uploads/2024/02/25/1708853687.petrobangla.jpg)
অভ্যন্তরীণ জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সরকার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলা অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ২০২৫-২৮ সালের মধ্যে ১০০টি নতুন এবং পুরোনো কূপ খনন করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
পেট্রোবাংলা ২০২২ সাল থেকে ৪৮টি কূপ খনন ও পুনর্খননের কাজ করছে। এই কাজ শেষ হলে কূপগুলো থেকে ৬১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। এরই মধ্যে ১১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে উৎপাদন বণ্টন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) বিদেশিদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে চূড়ান্ত করা হয়েছে গত বছরের জুলাই মাসে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের এক্সন মোবিল, শেভরনসহ বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অধিকতর আগ্রহ প্রকাশ করে। আগামী মার্চের প্রথম সপ্তাহে সমুদ্রে ২৬টি ব্লকের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে।
সরকারের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে কূপ খননের জন্য তিনটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির পরিকল্পনার কথা নিশ্চিত করেছে পেট্রোবাংলা। এই তিন কোম্পানি হচ্ছে সিনোপ্যাক, গ্যাজপ্রম ও এরিয়েল। ১০০ দিনের পরিকল্পনায় আরও আছে, কক্সবাজারের মাতারবাড়ী স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণে জায়গা চূড়ান্ত করা, ভারত থেকে এলএনজি আমদানির জন্য এজ এনার্জির সঙ্গে খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত করা, মহেশখালী তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণে সামিটের সঙ্গে খসড়া চুক্তি সই, দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানির জন্য সামিটের সঙ্গে পৃথক আরও একটি চুক্তির খসড়া সই, দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি আমদানির জন্য পেরিন্টিস মালয়েশিয়ার সঙ্গে খসড়া চুক্তি চূড়ান্ত করা।
দেশি কোম্পানি বাপেক্সের পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিকেও কাজ দিচ্ছে সরকার। চীনের সিনোপ্যাককে সিলেট গ্যাস ক্ষেত্রের পাঁচটি ও রাশিয়ার গ্যাজপ্রমকে ভোলায় পাঁচটি কূপ খননের কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। উজবেকিস্তানের কোম্পানি এরিয়েলকে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ৭টি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দ্রুত বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ বিধানে এই কাজ তাদের দেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ মিলিয়ন ডলার।
সিনোপ্যাক ও গ্যাজপ্রম এরই মধ্যে তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। তাদের প্রস্তাব নিয়ে দর-কষাকষি করছে জ্বালানি বিভাগ। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বিদেশি কোম্পানির চেয়ে বাপেক্সের কূপ খনন খরচ কম। তা ছাড়া দর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ দিলে প্রতিযোগিতা হতো, খরচ কমে আসত। তবে জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা শুধু বাপেক্সকে দিয়ে সম্ভব নয়। দ্রুত কাজ করতে হবে। তাই বিশেষ বিধানে সমঝোতার মাধ্যমে সিনোপ্যাক ও গ্যাজপ্রমকে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। দুটিই যোগ্য কোম্পানি। আগেও তারা বাংলাদেশে কাজ করেছে।
বাপেক্স বলছে, ২০২৪ সালের মধ্যে সংস্থাটি তাদের নিজস্ব গ্যাস ফিল্ডে মোট ১৯টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর মধ্যে অনুসন্ধান ৯টি এবং উন্নয়ন কূপ ১০টি। এর মাধ্যমে নতুন করে আরও ১৮ কোটি ১০ লাখ ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার খবরের কাগজকে বলেন, গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে নানা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আগামী মার্চে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। চলতি বছরই এই কাজ দেওয়ার টার্গেট রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন ৪৮টি কূপ খনন করা হচ্ছে। আগামী ২০২৬ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে আরও ১০০টি কূপ খনন করা হবে। এ জন্য তিন শতাধিক সম্ভাবনাময় এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে ১০০টি কূপ চূড়ান্ত করা হবে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আমরা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করব এবং অবিলম্বে আমাদের বর্তমান এবং সাবেক প্রকৌশলী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে।’
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু আমদানি করা ৬৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসসহ দৈনিক গড় সরবরাহ মাত্র ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ প্রায় ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের দৈনিক ঘাটতি রয়েছে দেশে। ২০২৯-৩০ সালের মধ্যে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৬ হাজার ৬৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট হবে বলে অনুমান করছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৪ হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পেট্রোবাংলার নথির বিবরণ অনুযায়ী এ ব্যবধান পূরণ করতে সরকার অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, অনশোর এবং অফশোর প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘১০টি কূপ সফলভাবে খননের মাধ্যমে আমরা দৈনিক ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের প্রত্যাশা করেছিলাম। কার্যত তা বেড়ে হয়েছে ১৩ কোটি ঘনফুট।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সাধারণত ২ হাজার ৬০০ মিটার থেকে ৪ হাজার মিটার পর্যন্ত কূপ খনন করে গ্যাস তোলা হয়। তবে ফেঞ্চুগঞ্জ-২সহ কিছু কূপে ৪ হাজার ৯০০ মিটার পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। পাবনার মোবারকপুরসহ ২টি কূপে আরও ডিপ ড্রিলিং (গভীর খনন) করার কাজ শুরু করেছি। আমরা ডিপ ড্রিলিং থেকেও অনেক ভালো ফল আশা করছি।’
এ বিষয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘দেশি ক্ষেত্র থেকে গ্যাস পেলে প্রতি ইউনিট ৪ টাকায় পাওয়া যায়, একই পরিমাণ গ্যাস আমদানি করতে খরচ হয় ৬০ টাকা। মাত্র ২৩ শতাংশ গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে না হলে অনেক সাশ্রয় হতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছি। ২ বছরের মধ্যে দেশে গ্যাস উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়বে। এ জন্য এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব নুরুল আলম বলেন, ‘আমরা মার্চের প্রথম সপ্তাহে আমাদের অফশোর বিডিং গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি। এই প্রচেষ্টায় আপনার (অংশীজন) মূল্যবান মতামত জরুরি। আমরা অফশোর তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য অবিলম্বে দরপত্র আহ্বান করতে প্রস্তুত।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘অতিরিক্ত জ্বালানি আমদানিনির্ভরতা বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট তৈরি করেছে। যে সংকট হয়েছে তার তড়িঘড়ি কোনো সমাধান নেই। নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পরিমাণ কমে গেছে। গ্যাস উত্তোলন ব্যাপক হারে না হলে আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ সংকট সমাধান সম্ভব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বড় দুটি গ্যাসক্ষেত্র আছে কৈলাশটিলা ও রশিদপুর। এই দুই জায়গা থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে পারলে বড় সহায়তা হবে।’ তিনি বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন ক্রমেই কমেছে। দেশে শিল্পোন্নয়ন বৃদ্ধির কারণে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে চলছে। এসবের বিপরীতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও অনুসন্ধান কার্যক্রম আশানুরূপ ছিল না। এর ফলে আগের উৎপাদনমাত্রা ধরে রাখা যায়নি। বর্তমানেও গ্যাস উৎপাদন হ্রাসের ধারা চলমান। ফলে ঘটে গ্যাসের স্বল্পতা ও তা থেকে গ্যাসসংকট। এটিই হলো অভ্যন্তরীণ কারণ।’