![দুর্বিষহ শব্দদূষণ, বেপরোয়া হর্ন](uploads/2024/02/28/1709101887.Sound_Pollution.jpg)
রাজধানীর আসাদ অ্যাভিনিউতে প্রতিদিনই শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তা পার হন, তখন অনেককেই দেখা যায় দুই হাতে কান চেপে ধরতে। বয়স্ক মানুষ অস্থির হয়ে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়েন। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এমন পরিস্থিতি। একই রকম দৃশ্য চোখে পড়ে ফার্মগেট, বাংলামোটর, মহাখালী, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যস্ত সড়কে।
বছিলায় ছোট বস্তির ঘরে বড় ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে থাকে ১৫ বছর বয়সী পরিবহন শ্রমিক মো. রাহুল হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৭টায় বেরিয়ে আবার ঘরে ফিরতে বেজে যায় রাত ১১টা-১২টা। চার বছর ধরে তার কাজ মোহাম্মপুর টু ফার্মগেট রুটের টেম্পোতে। গত কয়েক মাস ধরেই তার মনে হচ্ছে কানে ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করতে থাকে। বিষয়টি জানার পর বড় ভাই মকবুল হোসেন তাকে নিয়ে যান মহাখালীর নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটে। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে তার শ্রবণযন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে তার মস্তিষ্কের কিছু কোষেও সমস্যা তৈরি হয়েছে।
হাতিরপুল কাঁচাবাজারের কাছেই ছোট্ট চায়ের দোকানে মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন অনেকটা সময় কাটায় ৪ বছরের শিশু সুমাইয়া। কিছুদিন ধরেই ঘুমের মধ্যে লাফিয়ে ওঠে কান চেপে ধরে শিশুটি কান্নাজুড়ে দিচ্ছে। সারা রাত আর তার ঘুম হয় না। এক দিন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের শিশু বিভাগে। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওই বিভাগ থেকে তাকে পাঠানো হয় শ্রবণ বিভাগে। প্রতিদিনের ইতিহাস শুনে ও পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানান, অসহনীয় মাত্রার শব্দদূষণের প্রভাবে এই পরিণতি হয়েছে শিশুটির।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের নাক, কান, গলা বিভাগের অধ্যাপক মনিলাল আইচ লিটু খবরের কাগজকে বলেন, দেশে বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীতে শব্দদূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা মানুষের কেবল শ্রবণশক্তিই নয়, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অন্য অনেক রোগের কারণও হয়ে উঠেছে। এমনকি হৃদরোগ, স্মৃতিভ্রম, স্নায়ুর সমস্যাও হচ্ছে মানুষের। তিনি জানান, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিশেষ কিছু পেশার মানুষের মধ্যে শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব খুবই বেশি দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. এহসান খবরের কাগজকে বলেন, ‘শব্দদূষণের কারণগুলো আমরা সবাই জানি। এটা নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। এমনকি প্রয়োজনে আরও কঠোর কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়াও এখন জরুরি। জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে।’
এদিকে শব্দদূষণ নিয়ে দেশে খুব কাছাকাছি তেমন কোনো গ্রহণযোগ্য গবেষণা, তথ্য-উপাত্তও হয়েছে কম। তবে সংশ্লিষ্টদের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে নাক, কান, গলা বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক খবরের কাগজকে জানান, দিনে দিনে দেশে শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, যা একসময়ে বড় এক জনগোষ্ঠীর বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।
সর্বশেষ ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের রাজপথে শব্দদূষণ এবং শব্দদূষণের কারণে রাজপথে কর্মরত পেশাজীবীদের শ্রবণ সমস্যা’ নিয়ে গবেষণার আওতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের শব্দদূষণের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এ সময় ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্ট, বাসচালক ও হেলপার, পিকআপচালক, সিএনজিচালক, লেগুনাচালক, দোকানদার, মোটরসাইকেল, রিকশাচালক এবং প্রাইভেটকারচালক-শ্রমিকদের শ্রবণশক্তি পরিমাপ করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফলে জানানো হয়, শ্রবণশক্তি কম থাকা মানুষের মধ্যে ৪২ শতাংশই রিকশাচালক। বাকিদের মধ্যে ৩১ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ, ২৪ শতাংশ সিএনজিচালক, ২৪ শতাংশ দোকানদার, ১৬ শতাংশ বাসচালক, ১৫ শতাংশ প্রাইভেটকারচালক এবং ১৩ শতাংশ মোটরসাইকেলচালক।
বিশেষজ্ঞরা জানান, শব্দদূষণের সঙ্গে বধিরতার সম্পর্ক রয়েছে। আকস্মিক তীব্র শব্দে অন্তকর্ণের ক্ষতির কারণে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে ১ জন জীবনের কোনো না কোনো সময় বধির হয়ে যেতে পারে। শব্দদূষণ থেকে বধিরতা ছাড়াও নানা জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ৩০টি কঠিন রোগের কারণ ১২ রকমের দূষণ, যার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ডে ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এ জন্য শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা সৃষ্টি করে।
বিভিন্ন তথ্য খুঁজে দেখা যায়, শব্দদূষণের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) গ্রহণযোগ্য শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মানমাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফলতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশেও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
২০১৭ সালে সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ শহরে শব্দদূষণের মাত্রা পরিমাপ করা হয়েছিল। তখন ঢাকায় ১১ লাখ ৩৪ হাজার বার, চট্টগ্রামে ৬ লাখ ৬৪ হাজার ২০০ বার, সিলেট শহরে ৩ লাখ ২৪ হাজার, খুলনায় ৩ লাখ ২৪ হাজার, বরিশাল শহরে এবং ২ লাখ ৪৩ হাজার, রংপুরে ২ লাখ ৪৩ হাজার, রাজশাহীতে ১ লাখ ৬২ হাজার এবং ময়মনসিংহ শহরে ২ লাখ ৪৩ হাজার বার পর্যবেক্ষণ করা হয় বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে। এর আওতায় জনমত জরিপও ছিল।
জরিপের জন্য নির্ধারিত প্রতিটি স্থানে ৯০ জন করে ব্যক্তির মতামত নেওয়া হয়। নির্ধারিত স্থানগুলোতে শব্দের উৎস পর্যবেক্ষণ ও গাড়ির হর্ন গণনাও করা হয়েছে।
জরিপের ফলাফল সম্পর্কে পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহের প্রতিটি শহরের নির্ধারিত স্থানগুলোতে বিধিমালা নির্দেশিত শব্দের মানমাত্রার চেয়ে শব্দের মাত্রা দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ ছিল। আটটি শহরের রেকর্ড করা আকস্মিক শব্দের মাত্রার (ডেসিবল) ভিত্তিতে প্রথম (বেশি শব্দ) ও শেষে (কম শব্দ) অবস্থানকারী স্থানগুলো যথাক্রমে ঢাকার ‘পল্টন মোড়’ ও মিরপুর-১ নম্বর সেকশন: চট্টগ্রামে ‘বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের সামনে’ ও ‘পোর্ট কলোনি মোড়’। সিলেটে ‘করিমউল্লাহ মার্কেট’ ও ‘কোর্ট পয়েন্ট’। খুলনায় ‘ডাক বাংলো মোড়’ ও ‘সরকারি মহিলা কলেজ মোড়’; বরিশালে ‘কাশিপুর বাজার’ উল্লেখযোগ্য ছিল। প্রতিটি শহরেই শব্দের উৎস হিসেবে যানবাহন এবং হর্ন শব্দদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী বলে উঠে আসে। এ ছাড়া নির্মাণকাজ, সামাজিক অনুষ্ঠান, মাইকিং, জেনারেটর এবং কলকারখানা ইত্যাদি শব্দদূষণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওই জরিপের সুপারিশে জানানো হয়, শহরগুলোতে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের বাস্তবায়ন, প্রতিপালন, পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহারে রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
ওই জরিপের ফলাফল অনুসারে শব্দের মাত্রা পরিমাপের মাধ্যমে ঢাকা শহরের ৭০টি স্থানের বর্তমান পরিস্থিতি উঠে আসে। ঢাকার প্রতিটি স্থানেই শব্দের মাত্রা শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ নির্দেশিত মানমাত্রা অতিক্রম করেছিল তখনই। প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী নির্ধারিত স্থানগুলোতে শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ। ঢাকা শহরের মধ্যে নির্বাচিত স্থানগুলোর মধ্যে ফার্মগেটের কেন্দ্রস্থলে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ ছিল। শব্দদূষণের দিক থেকে উত্তরা ১৪ নং সেক্টরের ১৮ নং সড়ক সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকলেও সেখানেও শব্দের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ ছিল।
অধ্যাপক ড. মো. এহসান বলেন, আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে। কারণ নির্মাণ কার্যক্রম বেড়েছে আবার প্রতিদিন পরিবহন চলাচলের পরিমাণও বেড়েই চলছে।
এদিকে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৫৫ এবং রাতে ৪৫ ডেসিবল। এর বিপরীতে মধ্যে আগের জরিপ অনুসারেই রাজধানীর শাজাহানপুরে সর্বোচ্চ শব্দমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল দিনের বেলায় সর্বোচ্চ ১২৮ দশমিক ৪ ডেসিবল আর সর্বনিম্ন ছিল ৫০ দশমিক ৭ ডেসিবল; রাতব্যাপী শব্দের মাত্রা ছিল ১৩৩ দশমিক ৬ ডেসিবল। অন্যদিকে সবচেয়ে কম শব্দদূষণ থাকা উত্তরা ১৪ নং সেক্টরেও শব্দের মাত্রা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৯৯ দশমিক ৬ ডেসিবল ছিল।
বিধিমালা অনুসারে মিশ্র এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৬০ এবং রাতে ৫০ ডেসিবল। এ ক্ষেত্রে ঢাকার ২০টি মিশ্র এলাকার মধ্যে ফার্মগেট শব্দদূষণের জন্য শীর্ষে ছিল। যেখানে শব্দের মাত্রা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ১৩০ দশমিক ২ ডেসিবল ছিল।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এ নীরব এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবল। নির্বাচিত ১০টি নীরব এলাকার মধ্যে আইসিসিডিডিআরবি-মহাখালী শব্দদূষণের মাত্রা দেখা যায় ১১০ দশমিক ৯ ডেসিবল।
বিধিমালায় শিল্প এলাকার জন্য শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা দিনে ৭৫ এবং রাতে ৭০ ডেসিবল। ঢাকায় ২০টি আবাসিক এলাকার মধ্যে ধোলাইপাড়-যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছিল ১২৬ দশমিক ৮ ডেসিবল থেকে ১৩১ দশমিক ৯ ডেসিবল।
এদিকে সর্বশেষ ওই সরকারি জরিপ অনুসারেই ৮০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, ঢাকা শহরে মোটরযানের হর্ন শব্দদূষণের প্রধান কারণ। এ ছাড়া যথাক্রমে ২৪ শতাংশের মতে কলকারখানা এবং নির্মাণকাজের কারণেও শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে আছে পটকা ও আতশবাজির শব্দদূষণ।
এদিকে ওই জরিপে উঠে আসা তথ্য অনুসারে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ সম্পর্কে প্রায় ৪৯ শতাংশই অবগত নন বলে জানা যায়। এ ছাড়া ৯৬ শতাংশ মানুষ জানান, বিধিমালা বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ তারা দেখেননি।
ওই জরিপের সময় হর্ন গণনা করা হয়েছিল। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় ১০ মিনিটে ৫৯৮টি হর্ন বাজানো হয়, যার মধ্যে ১৫৮টি হাইড্রোলিক হর্ন এবং ৪৪০টি সাধারণ হর্ন।