![জন্ম যাদের মৃত্যু দিয়ে, ভাগ্যে জোটে না কবর](uploads/2024/04/19/1713513373.DU_Child_deadbody.jpg)
চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাংলোর সীমানা প্রাচীরসংলগ্ন এলাকা থেকে এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়। রাস্তা থেকে কেউ একজন লাশটি সেখানে ছুড়ে ফেলে চলে যায়। ওই দিন দুপুরে হঠাৎ দেয়ালের অপর পাশের রাস্তা থেকে টুপ করে কিছু পড়ার শব্দ পান পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তারা এগিয়ে দেখেন একটি ব্যাগ পড়ে আছে। প্রথমে তারা ভয় পান এ ভেবে যে, বোমা বা অন্য কিছু। পরে লাঠিজাতীয় কিছু দিয়ে একটু খুললে নবজাতকের মাথা বেরিয়ে আসে। প্রথমে তারা বিষয়টি উপাচার্যকে জানান। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দেন। এ ছাড়া একই দিনে টিএসসির ফুটপাত থেকে আরেকটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই নবজাতকের বয়স ছিল আনুমানিক এক দিন।
ডাস্টবিন ও রাস্তার পাশে ময়লা জায়গায় ফেলে দেওয়া এসব নবজাতকের বেশির ভাগই মায়ের পেটে বা জন্ম হওয়ার সময় মারা যায়। পরিচয় গোপন করতেই তাদের ফেলে দেওয়া হয়। যেসব নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয় তাদের কবর জুটলেও বাকিরা যায় শেয়াল-কুকুর ডাস্টবিনের পেটে।
ভিসির বাংলো এলাকা থেকে নবজাতকের লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। এ ঘটনায় ওই নবজাতকের বাবা সুলতান মিয়াকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। সুলতান দায় স্বীকার করে জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার স্ত্রী খাদিজা একটি মৃত কন্যাশিশুর জন্ম দেন। সুলতান শিশুর লাশ হাসপাতাল থেকে বুঝে নিয়ে গোপনে একটি বাজারের ব্যাগে ভরে উপাচার্যের বাসভবনের সীমানা দেয়ালের পাশে বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণে ফেলে যান। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে এবং সুলতানের শ্যালক মুত্তাকীর স্বীকারোক্তির মাধ্যমে পুলিশ অভিযুক্ত সুলতানকে শনাক্ত করে। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ১৬টি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করেছে শাহবাগ থানা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিম।
২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর কার্জন হলের বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ সালের ২৭ জুন শহীদুল্লা হল এলাকা থেকে একটি, পরের বছর ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পিছন থেকে একটি, একই বছর ৯ ডিসেম্বর শহীদুল্লা হলের পেছনে পানির পাম্পসংলগ্ন কেচিগেটের পাশ থেকে একটি এবং ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর জগন্নাথ হলের পাশ থেকে একটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর গণিত ভবনের পাশ থেকে একটি, ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি রাসেল টাওয়ারের ফুটপাত থেকে একটি, একই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছবির গেট এলাকা থেকে দুটি, ওই বছর ১৭ মার্চ অমর একুশে হলের পাশের ফুটপাত থেকে একটি এবং একই বছর ২০ সেপ্টেম্বর শহিদ মিনার এলাকা থেকে একটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০২৩ সালের ১২ আগস্ট অমর একুশে হলের ফুটপাত থেকে দুটি এবং সর্বশেষ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের বাংলো এলাকা ও টিএসসির ফুটপাত থেকে একটি করে মোট দুটি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাবির নির্দিষ্ট সীমানাপ্রাচীর না থাকা, বহিরাগতদের অতিরিক্ত যানবাহনের চলাফেরা করার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসব অপরাধ বেড়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সিটি করপোরেশন, সড়ক বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা জোরদার করতে কাজ করছে প্রশাসন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর এম মাকসুদুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ঢাকা মেডিকেল ও বেশ কয়েকটি ক্লিনিক রয়েছে। এটা তারই একটি প্রতিফল। নবজাতকের লাশ হাসপাতাল থেকে বুঝে পাওয়ার পর অনেকে আশেপাশের (বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা) খালি জায়গায় ফেলে যায়। তবে অধিকাংশ লাশ ডাস্টবিনে পাওয়া যায়। ঘটনাগুলো ভোরের দিকে বেশি হয়। কারণ এ সময়ে ক্যাম্পাস ফাঁকা থাকে। এটা তো ক্যাম্পাসের সমস্যা না। কিন্তু এখানে এনে ফেলার কারণে আমরা সমস্যায় পড়ে যাই।’
তিনি বলেন, ‘এটা ভয়াবহ অপরাধ। মৃত বাচ্চা হলেও দাফন করতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে এ ধরনের ঘটনায় আমরা মামলা করেছি। সুলতান নামে একজন গ্রেপ্তারও রয়েছে। সে এখন কারাগারে আছে। তবে ঢাকা মেডিকেল এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’
প্রক্টর আরও জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সতর্ক রয়েছে। ক্যাম্পাসে ওই ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ক্যাম্পাসে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাবি ক্যাম্পাসে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ক্যাম্পাসসহ আশপাশের এলাকায় পুলিশের বিশেষ টিম কাজ করছে। পাহারা ও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়াও মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’