ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দেড় হাজার একর সংরক্ষিত বন উজাড় করে কাসাভা চাষ

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
দেড় হাজার একর সংরক্ষিত বন উজাড় করে কাসাভা চাষ
কাসাভার নতুন চারা উঠছে। মাঝে ক্ষতচিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে পুরোনো গাছের গুঁড়ি। ছবি : মোহাম্মদ হানিফ

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নের উত্তর কাঞ্চননগরের হাতিভাঙ্গা ছাইল্যের ছোর এলাকায় সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন জাতের গাছ লাগিয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য বাবুল। প্রায় এক যুগ আগে লাগানো এসব গাছ বেশ বড় হয়ে উঠেছিল। বছর দুয়েক আগে প্রকাশ্য দিবালোকে গাছগুলো কেটে লাগানো হয়েছে কাসাভা। বাবুল মেম্বার আক্ষেপ করে বললেন, তার ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যানের সহায়তায় বন বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করে সামাজিক বনায়নের আওতায় তিনিসহ ১৬ জন ২৫ একর টিলায় বাগান করেন। নিয়মিত পরিচর্যা করে ও সার দিয়ে গাছ বড় হওয়ার পর প্রকাশ্য দিবালোকে গাছগুলো কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। 

বিষয়টি স্থানীয় বিট কর্মকর্তাকে জানানোর পরও কোনো প্রতিকার পাননি তিনি। শুধু সামাজিক বনায়ন নয়, এই এলাকার প্রায় দেড় হাজার একর সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে কাসাভার চাষ করছেন স্থানীয় ও পাশের উপজেলা মানিকছড়ির কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদের কাছ থেকে পাইকারি দামে কাসাভা কিনে নিয়ে যায় প্রাণ গ্রুপ।

বন বিভাগ বন উজাড়ের দায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করলেও সরেজমিন পরিদর্শন এবং খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়ি, বাঙালি এবং বন বিভাগের লোকজন মিলেমিশে বন উজাড় করেছেন। 

উত্তর কাঞ্চননগরের মান রাজার রাস্তা পার হলেই সামনে পড়ে ধুরুং খাল। একসময়ের খরস্রোতা এই খাল ভরাট হয়ে এখন এর মধ্য দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল করে। খাল পরিণত হয়েছে গবাদিপশুর চারণভূমিতে। খাল পার হলেই চোখে পড়ে সংলগ্ন ফরেস্ট অফিস। ২০০৭ সালের দিকে অফিসটি গুটিয়ে নেওয়া হয়। এই অফিসের পর থেকে উত্তরকূল, ভিলেজার পাড়া, ভুতাইছড়ি, ধুইল্ল্যাছড়ি, হাতিভাঙ্গা, বটতলী, কাউয়াকাটা, ছাইল্যের ছোর, ঘিলাবনিয়া, চিকনছড়া ইত্যাদিসহ উত্তর কাঞ্চননগরে সংরক্ষিত বন প্রথম দিকে রাতের আঁধারে কাটলেও এখন দিনের বেলায়ই কাটা হচ্ছে। উঁচু-নিচু টিলার ওপর দিয়ে বনের কাঠ এবং কাসাভাবাহী চাঁদের গাড়ি ও মোটরসাইকেল চলাচল করে। টিলার পর টিলার বন জ্বালিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে লাগানো হচ্ছে কাসাভা। 

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের নারায়ণহাট রেঞ্জের আওতায় উত্তর কাঞ্চননগর মৌজায় বন বিভাগের ৩ হাজার ৭০৭ একর সংরক্ষিত বন রয়েছে। এর মধ্যে দেড় হাজার একরের বেশি টিলায় কাসাভা চাষ হয়েছে।

সংরক্ষিত বনে যেভাবে শুরু কাসাভা চাষ

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের দিকে ছাইল্যের ছোর এলাকায় প্রায় ১০০ একর সংরক্ষিত বন কেটে কাসাভা চাষ করেন আক্কাস নামের এক ব্যক্তি। ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বন উজাড় এবং কাসাভা চাষ শুরু হয়। ২০২২ ও ২০২৩ সালে প্রায় শতবছরের পুরোনো শত শত একর সেগুন, আকাশমনি, গামারি, বহেড়া বাগান উজাড় করে সেখানে ব্যাপকভাবে কাসাভা চাষ করা হয়। 

সরেজমিন পরিদর্শনের সময় বিস্তীর্ণ কাসাভা খেতের মাঝে ২৫ একর করে মোট ৫০ একর ভূমিতে বনায়নের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। সাইনবোর্ডের তথ্য থেকে জানা যায়, ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি রিফরেস্ট্রেশন অ্যান্ড এফরেস্ট্রেশন’ প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে ‘কোর প্ল্যান্টেশন’সহ প্রায় ৬০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছিল। একদম অপরিণত বয়সে শেষ করে দেওয়া হয়েছে বাগানটি।

স্থানীয় বাসিন্দা জামালউদ্দিন জানান, তিনি তিন দশক ধরে সেখানে বসবাস করছেন। আগে এই বন গাছে ভরপুর ছিল। এখন ঘরে খুঁটি দেওয়ার জন্যও একটি গাছ পাওয়া যায় না। সর্বশেষ তিনি নিজে চোখে দেখেছেন ২৫ একরের একটি জাম বাগান দিনদুপুরে কেটে ফটিকছড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 

বার্ষিক ভাড়া নেয় বন বিভাগ

ঘিলাবনিয়া বুথাইছড়ির দক্ষিণ পাশের কাসাভা চাষি মো. আলম খবরের কাগজকে জানান, তারা বন বিভাগ থেকে একর হিসাবে ভাড়া নিয়ে কাসাভা চাষ করেছেন। প্রাণ গ্রুপ থেকে চাষের খরচ পান। ফসল তোলার পর কেজি ১০ টাকা করে প্রাণ গ্রুপ কিনে নিয়ে যায়। বন বিভাগকে একরপ্রতি কত টাকা দিতে হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, বন বিভাগের বিষয়টি তার বাবা দেখেন। আলমের বাবা নাছির সর্দার বলেন, তার প্রায় ১০ একর ভূমিতে কাসাভা চাষ রয়েছে। যেহেতু বিক্রির দুশ্চিন্তা নেই, তাই সবাই কাসাভা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। বন বিভাগও কোনো ঝামেলা করে না। বন বিভাগকে প্রতিবছর কানিপ্রতি (৪০ শতক) ২ হাজার টাকা দিতে হয়। তবে বন বিভাগের লোকজন টাকা নিতে সেখানে যায় না। সবাই মিলে টাকা তুলে দিয়ে আসতে হয়। গাছ কাটার জন্য তিনি ওই এলাকার সাবেক হেডম্যান উলা প্রু মারমাকে দায়ী করেন। তার মৃত্যুর পর বর্তমানে তার ছোট ভাই থোয়াই সি প্রু মারমা হেডম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

থোয়াই সি মারমা খবরের কাগজকে বলেন, ‘কেউ বিনামূল্যে কাসাভা চাষ করছে না। বন বিভাগ একরপ্রতি হিসাব করে প্রতিবছর টাকা নিয়ে যায়।’ গাছ কাটার বিষয়ে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

কাসাভা চাষে সরকারি কর্মকর্তাও

কাসাভা চাষি নাছির সর্দার বলেন, তার পাশে টিএনও জাফরের (কক্সবাজারের সাবেক এডিসি জাফর আলম) প্রায় ৪০ একর টিলা রয়েছে। তিনি কাসাভা চাষের জন্য তা ভাড়া দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক এডিসি জাফর আলম খবরের কাগজকে বলেন, তার ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০ একরের মতো জমি সেখানে রয়েছে। তিনি তাতে কাসাভা চাষ করেননি। যেহেতু পাহাড়ি জায়গা, দখলে একটু বেশি থাকতে পারে। তিনি বন বিভাগের কোনো গাছ কর্তন বা জমি দখল করেননি বলে দাবি করেন। ভূমি রেকর্ড যাচাই করে দেখা গেছে, ওই এলাকায় বন বিভাগের ভূমি ব্যতীত ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো ভূমি সেখানে নেই। 

গাছ কাটায় যারা জড়িত

বন বিভাগের কর্মচারী, এলাকার সর্দার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, উলা প্রুর সহযোগী হিসেবে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মানিকছড়ির কামাল, তিন টহরির ইউনুচ মেম্বার, বর্তমান মেম্বার আব্দুল মতিন, কুমারী এলাকার হানিফ, শিরু, আবুল হোসেন, শালম, মফিজ, সেলিম, আমান, ওসমান। তারা সবাই পাশের মানিকছড়ি উপজেলার বাসিন্দা। মানিকছড়ি উপজেলার সাবেক এসি ল্যান্ড এবং ইউএনও জাফর আলমের (এডিসি জাফর নামেই বেশি পরিচিত) নামও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া ফটিকছড়ির একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী বাবুলসহ আরও অনেকেই গাছ কাটেন বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিরু, আবুল হোসেন, শালম, নাছির সর্দার ও তার ছেলেরা, আমান, দেলোয়ার প্রকাশ ওরফে দেলোয়ার হুজুর, বাহাদুরসহ অনেকেই কাসাভা চাষ করেন।

ধ্বংস জীববৈচিত্র্য, মরছে গবাদিপশু

এই বন একসময় হরিণ, বন্য শূকর, গুইসাপ, বনরুই, অজগরসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ, বেজি, বাগডাস, মেছোবাঘ, ভালুক, লম্বালেজি বানর, উল্টো লেজি বানর, হনুমান, উল্লুক নানা জাতের পাখিসহ বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ছিল, যা এখন বিপন্ন হয়ে গেছে। এখন সেখানে আর পাখিরা উড়ে বেড়ায় না বললেই চলে। বানরের পাল খাবার না পেয়ে কৃষকের ধানসহ বিভিন্ন শাকসবজির খেতে হামলা চালায়। আবাস নষ্ট হওয়ায় বন্য প্রাণী খুবই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রাণ-প্রকৃতি সবই বিলুপ্ত।

কাসাভা বাগানের ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে এবং হেঁটে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে কোথাও কোনো গরু-ছাগল চোখে পড়েনি। একসময় এই এলাকায় গরু-ছাগলের পাল চরে বেড়াত। গরু-ছাগলের খাবার ঘাস, গুল্ম, লতা-পাতা এখন নেই বললেই চলে। একসময় আশপাশের মানুষ বন থেকে জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, পাহাড়ি বিভিন্ন শাকসবজি, কলা ইত্যাদি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতেন। এখন চারদিকে শুধু কাসাভা আর কাসাভা।

কাসাভা চাষি আলম জানান, শুরুর দিকে তারা লাল রঙের দেশীয় জাতের কাসাভা চাষ করতেন। ওই জাতের কাসাভা মানুষ তুলে নিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলত। গবাদিপশু অনিষ্ট করত। এখন তারা হাইব্রিড কাসাভার চাষ করেন। সাদা রঙের এই কাসাভার স্বাদ তেতো। এমনকি গরু-ছাগলও এই জাতের কাসাভাগাছের পাতা খেলে মরে যায়। স্থানীয় জামালের চারটি গরু কাসাভার পাতা খেয়ে মরে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, সামশু নামে এক কৃষকেরও দুটি গরু মরে গেছে। স্থানীয়রা জানান, গত তিন বছরে অন্তত ২৫টি গরু এবং ১৫টি ছাগল কাসাভা পাতা খেয়ে মারা পড়েছে।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, কাসাভা একদিকে ওষুধ। আবার কিছু ক্ষেত্রে এর পাতা গবাদিপশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তীব্র গরমে অতিরিক্ত কাসাভা পাতা গরুর জন্য ক্ষতিকর। এমনকি বেশি খেলে পশুর মৃত্যুও হতে পারে। তবে আসল কারণ বের করার জন্য কাসাভা এবং ওই গাছের পাতা পরীক্ষা করা জরুরি।

শুকিয়ে যাচ্ছে হালদার পানির উৎস

কাসাভা আহরণের জন্য বছরে একবার টপ সয়েল খুঁড়তে হয়। এই মাটি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে খালে পড়েছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে খাল, ঝিরি, ছড়া এবং ঝরনা।

বন উজাড় করে মরুকরণের কারণে প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো শুকিয়ে গেছে। গত ২৭ এপ্রিল ঘুরে দেখা গেছে, ছোট পাহাড়ি ছড়াগুলোতে এখন আর পানি নেই। চাষাবাদেও বিঘ্ন ঘটছে। প্রাকৃতিক মাছ প্রজননক্ষেত্র হালদায় উজান থেকে কালাপানিয়া খাল ও ধুরুং খালের মাধ্যমে পানি নামে। যার শাখা খাল হলো কুমারী খাল। কুমারী ও ধুরুং খাল ইদানীং পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, বনের সঙ্গে পানির সম্পর্ক আছে। যে পাহাড়ে যত বেশি গাছ থাকে, পাহাড় তত বেশি পানি সংরক্ষণ বা ধারণ করবে। তা ছোট ঝরনার মাধ্যমে খালে এসে পড়ে। বন ধ্বংসের কারণে ঝিরি, ঝরনা, খাল শুকিয়ে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। দেশের রুইজাতীয় মাছের একমাত্র প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতেও পানি নেই। কারণ পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। 

কাঞ্চননগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, বন বিভাগ সরকারের সম্পত্তি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এই বনের ওপর নির্ভর করে অসংখ্য পরিবার সারা বছর আয়-রোজগার করত। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। 

নারায়ণহাট রেঞ্জের রেঞ্জার ইলিছুর রহমান খবরের কাগজকে প্রথমে বলেন, বন উজাড় করে কাসাভা চাষের বিষয়টি তার জানা নেই। চাষিদের কাছ থেকে বছরভিত্তিক টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, গত বছর সেখানে তদন্ত করতে গিয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা না পাওয়ায় বাইন্যাছোলা আর্মি ক্যাম্পের পর আর যেতে পারেননি। চলতি বছরে সেখানে প্রায় এক হাজার হেক্টর জায়গায় বাগান করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে সেখানে নতুন বাগান হবে। বন উজাড়ের জন্য তিনি পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের দায়ী করে বলেন, বন বিভাগের জায়গায় বন কর্মকর্তারা প্রবেশ করতে পারেন না। বিট কর্মকর্তা অবনী ভূষণ রায়ের দাবিও একই। তিনি দাবি করেন, এলাকাটি পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণ করে। বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। 

এসিএফ (নারায়ণহাট) হারুন অর রশীদ বলেন, এখানে তিনি যোগদান করেছেন বেশি দিন হয়নি। গাছ কাটা ও কাসাভা চাষে প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় বন বিভাগের পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না। কাসাভা চাষিদের কাছ থেকে প্রতিবছর একরপ্রতি টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে টাকা কার পকেটে যায়। তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিভাগীয় কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম উত্তর) এস এম কায়চার প্রতিবেদককে প্রথমে বিট কর্মকর্তা, রেঞ্জার এবং এসিএফের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি জানালে তিনি জানান, বন উজাড় কিংবা সেখানে কাসাভা চাষের বিষয়টি তার জানা নেই। দায়িত্বশীলরা সন্ত্রাসী এবং প্রভাবশালীদের যে দোহাই দিয়েছেন, সে বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি মোবাইল ফোন কেটে দেন।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস খবরের কাগজকে বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে কেউ যদি বন এবং মাটি ধ্বংস করে, তার কোনো ছাড় নেই।

 

বাজেটে দুদকের বরাদ্দ বাড়ছে না

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম
আপডেট: ০৩ জুন ২০২৫, ০১:০৫ পিএম
বাজেটে দুদকের বরাদ্দ বাড়ছে না
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি অর্থবছরের তুলনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে না। বরং বরাদ্দ কিছুটা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বাজেট পরিকল্পনায় এবার দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেটে দুদকের জন্য মোট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১৯১ কোটি টাকা।

এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ১২ কোটি ৭১ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জন্য গত বছরের ৬ জুন ঘোষিত বাজেট ঘোষণায় দুদকের জন্য মোট বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৯১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭৯ কোটি ৩০ লাখ এবং উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয় ১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বাজেটের তুলনায় এবার পরিচালন ব্যয় কমিয়ে উন্নয়ন ব্যয় সামান্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে মঞ্জুরি ও বরাদ্দে দুদকের উল্লেখযোগ্য কার্যাবলি, কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে সব জেলায় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট ‘মহানগর বা জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, সব উপজেলায় ৯ সদস্যবিশিষ্ট উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি পুনর্গঠন ও পরিচালনা এবং ইউনিয়ন দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও পরিচালনা করা হবে। এর মধ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির কার্যক্রম আগে থেকেই চলমান, তবে এবারই প্রথম ইউনিয়ন পর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সততা এ নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টি করা এবং গণসচেতনতা গড়ে তোলার কাজে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে স্ব স্ব কর্ম এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেমন- স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রাবাস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহযোগী হিসেবে সততা সংঘ প্রতিষ্ঠা করা হবে। শিক্ষার্থীদের সততা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সততা স্টোর’ নামে বিক্রেতাবিহীন স্টোর চালু করা হবে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সেবা নিশ্চিত করতে গণশুনানি কার্যক্রম চালু রাখা হবে। তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো হবে। দুদকের খুলনা, রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে।

দুদকের জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত ১৯১ কোটি টাকার বরাদ্দে ১৬৫ কোটি টাকার আবর্তক ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে নগদ মজুরি ও বেতন ৯৯ কোটি ২৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, প্রশাসনিক ব্যয় ২১ কোটি ২৭ লাখ ১৫ হাজার, ফি ও কমিশন ৫ লাখ ৫০ হাজার, প্রশিক্ষণ ৪ কোটি ২০ লাখ, পেট্রল ও ফুয়েল ৩ কোটি ৩ লাখ, ভ্রমণ ও বদলি ৬ কোটি ২১ লাখ ৩৬ হাজার, খাদ্য সরবরাহ ১০ কোটি, মুদ্রণ ও মনিহারি ১৩ কোটি ৫৩ লাখ ৭৯ হাজার, সাধারণ ও কাঁচামাল সরবরাহ ৩১ লাখ ৬৫ হাজার, পেশাগত সম্মানী ও সংরক্ষণ ৪ কোটি ৭ লাখ ৫ হাজার, মেরামত ও সংরক্ষণ ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৮৮ হাজার এবং স্থানান্তর ও শ্রেণিবদ্ধহীন ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।     

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) জন্য গত বছরের ৬ জুন ঘোষিত বাজেটে দুদকের জন্য ১৯১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হলেও সংশোধিত বাজেটে ১৬৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৫৪ কোটি ৩০ হাজার টাকা এবং উন্নয়নে ৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাজেটে ১৮৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। তবে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫৩ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৪৭ কোটি ৫৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা।   

ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পথনকশা নেই

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ১১:৩৪ এএম
ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পথনকশা নেই
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়ে ব্যাংকিং খাতে ক্ষয় ঠেকানো গিয়েছে বলে দাবি করছে বর্তমান সরকার। তবে এখনো স্থিতিশীলতা ফেরেনি। এবারের বাজেটে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বাজেট বক্তৃতায় তেমন কোনো পথনকশা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আস্থাহীনতার কারণে ব্যাংকে আমানত খুব বেশি বাড়ছে না। অন্যদিকে, সুদহার বাজারভিত্তিক করায় বেড়েছে ঋণের সুদহার। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। সব মিলিয়ে খাদের কিনারে ব্যাংক খাত।

এমন বাস্তবতায় ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংকিং খাতের সংস্কার বিষয়ে তেমন কোনো কিছু উল্লেখ নেই। যা হতাশাজনক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেই। যা মোটেও ঠিক হয়নি। এটি খুবই হতাশাজনক।’

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলোই বাজেট বক্তৃতায় তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে নতুন কোনো পথনকশা নেই। বাজেট বক্তৃতায় বলা উচিত ছিল, তারা চলে যাওয়ার আগে কোন কোন সংস্কার শেষ হবে। কয়টা ব্যাংককে নিষ্পত্তি করে দিয়ে যাবে।

বাজেট বক্তৃতায় আর্থিক খাতের সংস্কার বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিগত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এ খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট, দেউলিয়াত্ব বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি এমন সব ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে।

সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো: (ক) ব্যাংকিং খাত সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তি তৈরি করতে ব্যাংকগুলোর সম্পদের ব্যাপক গুণগত পর্যালোচনা করা, (খ) নীতি ও প্রবিধানসমূহের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুশাসন বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং (গ) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চুরি/পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।

চাপ সামলানোর বাজেট

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম
চাপ সামলানোর বাজেট

অর্থনীতিতে এখন চলছে নানা সংকট। সবচেড়ে বড় সংকট মূল্যস্ফীতির চাপ। নতুন বাজেট নিয়ে দেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। জীবনযাপনে ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা ছিল ব্যক্তিশ্রেণি আয়করে ছাড় দেবেন তিনি। ব্যবসায়ীদের আশা ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে থাকবে প্রণোদনা। কমানো হবে করপোরেট কর। কর্মসংস্থান বাড়াতে থাকবে পদক্ষেপ। প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়াতে রপ্তানিতে কমবে কর। সঞ্চয়কারীদের জন্য থাকবে সুখবর। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে ঘোষণা আসবে সংস্কারমূলক পদক্ষেপের। 

অর্থ উপদেষ্টা সোমবার (২ জুন) যে বাজেট দিলেন তাতে নতুন অর্থবছরে এসব প্রত্যাশার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। অনেক আশার কথা শোনালেও সংকট মোকাবিলার দিকনির্দেশনা নেই। বরং নানা ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়েছেন। কয়েক শতাধিক পণ্য আমদানিতে অগ্রিম কর বসানোর প্রস্তাব করেন। বাড়তি রাজস্ব আহরণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর আমদানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্কহার বৃদ্ধির কথা বলেন। এসব কর প্রস্তাব কার্যকর হলে আরও চাপে পড়বেন জনগণ। কঠিন হবে জীবনযাপন। অর্থনীতিবিদরা বলেন, অর্থ উপদেষ্টার প্রত্যাশা বড়। পরিকল্পনা দুর্বল। যদিও অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, একটি যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া হয়েছে। 

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে বিএনপি বলেছে, এই বাজেটে মৌলিক জায়গায় গলদ রয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল খবরের কাগজকে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, নতুন বাজেট ব্যয়ের দিক থেকে গতানুগতিক। আয়ের দিক থেকে সাহসী। 

অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’। ৬৪ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তব্যে তিনি গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। অর্থনীতিতে ঝুঁকির কথা স্বীকার করেন। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এবারের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে নজর না দিয়ে অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করার ওপর গুরুত্ব দেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বলেন, এই শক্তিশালী ভিত্তিই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য গতকাল বেলা ৩টায় বিটিভিতে বাজেট ঘোষণা করেন তিনি। একই সঙ্গে কোথা থেকে এই ব্যয় মেটানো হবে, ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে সে কথাও তুলে ধরেন। এর আগে দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আগামী বাজেট অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অধ্যাদেশ জারি করার পর ঘোষণা করা হয় বাজেট।

যে অর্থবছরটি (২০২৪-২৫) শেষ হতে যাচ্ছে তাতে মূল বাজেটের আকার ধরা হয় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটের আকার আগের বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম, শতকরা হারে যা ১ শতাংশ।

অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। 

প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। এ জন্য প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। তাই এবারের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।’
 
তারুণ্যকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। এ লক্ষ্যে ‘তারুণ্যের উৎসব’ নামে একটি নতুন উদ্যোগ চালু করা হবে। এ জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের যুবসমাজের শক্তি ও সম্ভাবনাকে জাতি গঠন এবং আত্মকর্মসংস্থানের দিকে পরিচালিত করার জন্য তাদের সম্পৃক্ততাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পদক্ষেপ হিসেবে সরকার আসন্ন অর্থবছরে দেশব্যাপী এই উৎসব আয়োজনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলেন ড. সালেহউদ্দিন। কিন্তু কী সুবিধা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়টি পরিষ্কার করেননি তিনি। খাদ্যনিরাপত্তায় নজর দেন অর্থ উপদেষ্টা। এ জন্য সারের মজুত বৃদ্ধির প্রস্তাব করেন। বিদেশ থেকে টাকা আনার বিষয়ে নজর দেন অর্থ উপদেষ্টা। বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনতে দুদক কাজ করছে। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রচলিত আইনের পুনর্গঠন ও সংশোধনের প্রস্তাব করেন। 

সামাজিক সুরক্ষায় নজর দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। বয়স্ক, বিধবাসহ ভাতাভোগীদের মাসিক টাকার অঙ্ক ও আওতা বাড়িয়েছেন তিনি। দুস্থদের সহায়তায় চলমান খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের মাসিক ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সম্পদের সুষম বণ্টন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া এবারের বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া রাজস্ব আয় ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে একটি যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া হয়েছে।

কর প্রস্তাব
কর আহরণ বাড়াতে দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদে কৌশল নির্ধারণের প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা। একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে করারোপ ও করছাড় দিয়ে বাড়তি রাজস্ব আহরণের কথা বলেন। আয় থাকুক আর না থাকুক, নতুন করদাতাদের জন্য ১ হাজার টাকা ধার্য করেন তিনি। কৃষিতে নজর দেন। এ খাতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে বছরে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখার ঘোষণা দেন। সর্বজনীন পেনশন থেকে উদ্ভূত আয়ে করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ১২টি সেবা নিতে শুধু টিআইএন জমা দিলে হবে- নতুন বাজেটে এমন বিধান করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবায় উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে এই সেবা আরও সহজ হবে। 

যারা বাণিজ্যিকভাবে পণ্য আমদানি করেন, নতুন বাজেটে তাদের কর বাড়ানো হয়েছে। নির্মাণসেবার বিপরীতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে এ খাতের খরচ বাড়বে। অনলাইন ব্যবসায় কমিশনের ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। এর ফলে এই খাতের খরচ বাড়বে। এসব কর প্রস্তাবের মাধ্যমে বাড়তি ১৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের প্রস্তাব করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। 

বাজেটের আকার
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের ঘোষণা দেন। এটি জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নতুন বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি বা আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত প্রাপ্তি থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৯ হাজার কোটি টাকা আসবে এনবিআরবহির্ভূত কর থেকে। 

অর্থায়ন
প্রস্তাবিত বাজেটে সামগ্রিকভাবে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক- এ দুই উৎস থেকে ঘাটতি পূরণ করা হবে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে। 

জিডিপির প্রবৃদ্ধি
আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ।

নিমতলী ট্র্যাজেডির ১৫ বছর: এখনো আছে স্বজন হারানোর ব্যথা

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৫, ০৮:১৪ এএম
নিমতলী ট্র্যাজেডির ১৫ বছর: এখনো আছে স্বজন হারানোর ব্যথা
ছবি: সংগৃহীত

২০১০ সালের ৩ জুন। পুরান ঢাকার নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটরার পাঁচতলা ভবনটি বিয়ের আয়োজনে ঝলমল করছিল। চারদিকে ছিল আনন্দ আর হই-হুল্লোড়। কিন্তু হঠাৎ এক বিস্ফোরণ, তারপরেই ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে আর্তনাদ আর কান্নার রোল শোনা যেতে থাকে। কারণ মুহূর্তে কেমিক্যালের সংস্পর্শে দ্রুতই ছড়িয়ে যায় আগুন। আগুন যখন নিভল, ততক্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। যার মধ্যে ছিলেন ভবনটির মালিক গোলজার এলাহীর পরিবারেরই ১১ জন।

সেই ১১ স্বজন হারানোর ব্যথা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন গোলজারসহ বেঁচে থাকা স্বজনরা। কেবল এই পরিবারটি নয়, সেই রাতের ভয়াবহতায় যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের স্বজনরা এখনো বুকে কষ্ট নিয়ে সময় পার করেন। আজ সেই নিমতলী ট্র্যাজেডির ১৫ বছর পূর্ণ হলো।

দিন যায়, মাস যায়, দেখতে দেখতে বছরও চলে যায়, কিন্তু স্বজনহারাদের কষ্ট যায় না। গত রবিবার নিমতলী গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতলা এই ভবনসহ আশপাশের যে বাড়িগুলো পুড়েছিল, তা এখনো দেখে চেনার উপায় নেই। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলো মেরামতের পর রং করা হয়েছে। ওই দিন যারা দগ্ধ হয়েছিলেন, তাদের পোড়া ক্ষত শুকিয়ে গেলেও কিছুতেই সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না । এখনো তারা দুচোখের পানিতে বুক ভাসান। ওই ভবন ঘেঁষে পশ্চিম পাশে নিহত ব্যক্তিদের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে নিমতলী এলাকায় কর্মচঞ্চল মানুষের এখনো অনেক ব্যস্ততা। দোকানপাট ও অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মানুষের জটলা রয়েছে যথারীতি আগের মতোই।  

এলাকাবাসী জানান, সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এখানে ৫টি বাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। এখন দেখে বোঝার উপায় নেই। বাড়িগুলো মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু সেই ভয়াবহ ঘটনা এখনো তারা ভুলতে পারেননি। 

তাদের দাবি, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ঘটনার পর সরকার ও প্রশাসনের লোক তৎপর হলেও এখন আর কেউ দেখতে আসে না তাদের সমস্যা।

নবাব কাটরার ‘দিনসাবেরা’ নামে ওই পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল বা রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৪ জন। খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলার সময় সেই ভয়ংকার দিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন ভবনমালিক গোলজার। পরিবারের ১১ সদস্য হারানোর ব্যথা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। 

গোলজার বলেন, ‘আমার স্ত্রী, দুই সন্তান, মেজো ও ছোট ভাইয়ের পরিবারের ৬ জন এবং আমার মা ও চাচি আগুনে পুড়ে মারা যান। ১৫ বছর আগের সেই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিন আমাদের বাসার এক ভাড়াটের একটি বিয়ের আয়োজন ছিল। বিয়ের রান্না হচ্ছিল বাসার নিচে। ওই দিন আমি ও আমার মেজো ভাই মোহাম্মদ দিদার বাসার বাইরে ছিলাম। দুই ছেলের কিছু কাগজপত্র ফটোকপি করতে বাজারে গিয়েছিলাম। হঠাৎ খবর পাই বাড়িতে আগুন লেগেছে। দৌড়ে বাড়ির সামনে এসে দেখি পুরো বাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ভেতরে যারা আটকা পড়েছিলেন, তাদের আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছিল। সেই কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে, অসুস্থ বোধ করি। সেদিন যেন ছিল লাশের মিছিল, চারদিকে পোড়া  লাশের গন্ধ। ভেতরে ধোঁয়ায় আটকা পড়ে আমার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ১১ জন মারা যায়।’ বলতেই দুচোখ ভিজে আসে হাজি গোলজার এলাহীর।  

গোলজার বলেন, ‘আমার যমজ দুই সন্তান ইমতিয়াজ গোলজার ও ইসতিয়াক গোলজার এবং স্ত্রী ইয়াসমিনের অনেক স্মৃতি। ১৯৯২ সালে দুই সন্তান একসঙ্গে জন্মেছিল। ওরা দুই ভাই মায়ের রান্না খুব পছন্দ করত। মায়ের হাতের তৈরি কাচ্চি ও পায়েস তাদের খুব পছন্দের ছিল। এ ছাড়া বাইরে ফাস্টফুড খেতে তারা খুব পছন্দ করত। বাইরে খেতে খুব এনজয় করত।’ বলতে বলতে চোখ মোছেন গোলজার। 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘স্ত্রী-সন্তাদের কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না। প্রতিবছরই ওই দিনটি এলে কষ্ট আরও বাড়ে। বেঁচে থাকলে ছেলে দুটি আজ কত বড় হতো। বাবা হয়ে কাঁধে সন্তানের লাশ বহন করতে হয়েছে, এর চেয়ে বড় কষ্ট পৃথিবীতে আর কী হতে পারে?’

গোলজার জানান, পোড়া বাড়ি মেরামতের জন্য সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। প্রতিবছরই এই দিনে মিলাদ মাহফিল, কবর জিয়ারত ও তবারকের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় তিনি পরিবারের নিহত সদস্যদের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেন।

গোলজারের পাঁচতলা ভবনের বিপরীত পাশেই রয়েছে একটি ইলেকট্রিক দোকান। এখানকার ব্যবসায়ী আহসান উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাড়িগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। বিদ্যুতের তার এত ঘনভাবে লাগানো যে অনেক জায়গায় জটলা বেধে থাকে। যেকোনো সময় শর্টসার্কিট হতে পারে। এ ছাড়া একটু বৃষ্টিতেই এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়। এসব দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।’  

প্রতিবছর আজকের এই দিনে নিমতলীবাসী কাঁদেন। স্বজন হারানোর কথা স্মরণ করে তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল আয়োজন করা হয়।

প্রকাশ্যে বিচার: নুরেমবার্গ থেকে বাংলাদেশ

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ১০:৪০ এএম
আপডেট: ০২ জুন ২০২৫, ১০:৫২ এএম
প্রকাশ্যে বিচার: নুরেমবার্গ থেকে বাংলাদেশ
ছবি: সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম কোনো মামলার বিচার প্রক্রিয়া রবিবার (১ জুন) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। এই বিচারকাজ দেশে এবং সারা বিশ্বকে দেখাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালের শুনানি সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। এইভাবে কোনো দেশের কোনো সাবেক সরকারপ্রধানের বিচার প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে সম্প্রচারের দৃষ্টান্ত আগে বিশ্বের কোথাও দেখা যায়নি। তবে ইতিহাসখ্যাত জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে একটি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে প্রায় ২০০ জন জার্মান যুদ্ধাপরাধীর বিচার অনেকটা প্রকাশ্যে হয়েছিল। আধুনিক কালে পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশে টেলিভিশনে সরাসরি বিচার সম্প্রচারের তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এই প্রথম বলে টেলিভিশনে শেখ হাসিনার বিচারিক কার্যক্রমের সম্প্রচারও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে যেসব সাবেক সরকারপ্রধানের বিচার হয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন উত্তর-মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদের প্রেসিডেন্ট হিসেন হাবরে, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির, মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক, চিলির প্রেসিডেন্ট অগুস্তো পিনোশে, ক্যাম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী পলপট প্রমুখ। 

এদের মধ্যে ওমর আল-বশিরের বিচার হয়েছিল জাতিসংঘের অধীন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টে (আইসিসি)। আন্তর্জাতিক আদালত প্রথমে তার বিরুদ্ধে পশ্চিম সুদানের দারফুরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পরে গণহত্যার অভিযোগে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু জাতিসংঘ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় আন্তর্জাতিক আদালত তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা বন্ধ করে দেয়। 

আফ্রিকার শাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেন হাবরের বিচার হয় সেনেগালে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান যিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে অন্য দেশে গঠিত আদালতে সাজা পান। পরে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। 

আরব বসন্তের ঝোড়ো আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের হত্যার অভিযোগে মিসরের একটা নিম্ন আদালতে তার আজীবন কারাবাসের সাজা হয়। পরে পুনর্বিচারে তিনি মুক্তি পান। 

চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট অগুস্তো পিনোশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের। বিচার চলাকালে তার মৃত্যু হয়। ক্যাম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পল পটের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের। 

এসব সাবেক সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের বিচার জনসমক্ষে হয়নি। তাদের বিচার হয়েছে মূলত লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে মানবতার বিরুদ্ধে বা গণহত্যার বিরুদ্ধে সমকালীন পৃথিবীতে যে বিচারটি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে সেটি হচ্ছে জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে সিরিজ বিচার। এই বিচারটি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের ছিল না, তবু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হিসেবে সুপরিচিত। 

আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে ২০০ জার্মান যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সময় প্রতিদিন প্রায় ৪০০ দর্শক উপস্থিত থাকতেন। সাংবাদিকদের রেকর্ডসংখ্যক উপস্থিতি ছিল, ২৩টি দেশের ৩২৫ জন সাংবাদিক এই বিচারের সময় উপস্থিত থেকেছেন। পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি ইংরেজি, ফরাসি ও রুশ ভাষায় অনুবাদ করে সাংবাদিকদের হাতে দেওয়া হতো। প্রকাশ্য বিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এই নুরেনবার্গ বিচার প্রক্রিয়াটি। 

যুক্তরাষ্ট্রে যথাক্রমে ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৫ সালে টেড বান্ডি, উইলিয়াম কেনেডি স্মিথ এবং ও. জে. সিম্পসনের বিচার প্রক্রিয়াও টেলিভিশনে দেখেছেন বিশ্ববাসী। যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে বেন অলিভারের বিচারও সম্প্রচারিত হয়েছে টেলিভিশনে। ইসরায়েলে ১৯৬১ সালে নাৎসি যুদ্ধাপরাধী আইখম্যানের বিচারও টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। ব্রাজিলের সুপ্রিম ফেডারেল কোর্ট ও সুপিরিয়র ইলেকটোরাল আদালতে অনুষ্ঠিত সব বিচার ২০০২ সালে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছিল। ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর থেকে প্রায় ৭ হাজার মামলার বিচার প্রক্রিয়া ভিডিও টেপ করে সম্প্রচার করা হয়েছিল। আধুনিক কালে টেলিভিশনে সরাসরি বিচার প্রক্রিয়া সম্প্রচারের ইতিহাস তাই নতুন নয়, তবে বাংলাদেশে নতুন।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার কার্যক্রম সেই নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এই প্রথম এই ধরনের বিচার প্রক্রিয়াটি কোর্ট থেকে সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এর আগে এরকম কখনও ঘটেনি। বিচারের স্বচ্ছতার জন্য এই সম্প্রচার বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এতে দেশবাসী আদালতে কীভাবে বিচারটি হচ্ছে সেটা দেখার সুযোগ পাচ্ছে।