ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

দেড় হাজার একর সংরক্ষিত বন উজাড় করে কাসাভা চাষ

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪, ১২:৪৫ পিএম
আপডেট: ১৭ মে ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
দেড় হাজার একর সংরক্ষিত বন উজাড় করে কাসাভা চাষ
কাসাভার নতুন চারা উঠছে। মাঝে ক্ষতচিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে পুরোনো গাছের গুঁড়ি। ছবি : মোহাম্মদ হানিফ

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর ইউনিয়নের উত্তর কাঞ্চননগরের হাতিভাঙ্গা ছাইল্যের ছোর এলাকায় সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন জাতের গাছ লাগিয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য বাবুল। প্রায় এক যুগ আগে লাগানো এসব গাছ বেশ বড় হয়ে উঠেছিল। বছর দুয়েক আগে প্রকাশ্য দিবালোকে গাছগুলো কেটে লাগানো হয়েছে কাসাভা। বাবুল মেম্বার আক্ষেপ করে বললেন, তার ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যানের সহায়তায় বন বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করে সামাজিক বনায়নের আওতায় তিনিসহ ১৬ জন ২৫ একর টিলায় বাগান করেন। নিয়মিত পরিচর্যা করে ও সার দিয়ে গাছ বড় হওয়ার পর প্রকাশ্য দিবালোকে গাছগুলো কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। 

বিষয়টি স্থানীয় বিট কর্মকর্তাকে জানানোর পরও কোনো প্রতিকার পাননি তিনি। শুধু সামাজিক বনায়ন নয়, এই এলাকার প্রায় দেড় হাজার একর সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে কাসাভার চাষ করছেন স্থানীয় ও পাশের উপজেলা মানিকছড়ির কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদের কাছ থেকে পাইকারি দামে কাসাভা কিনে নিয়ে যায় প্রাণ গ্রুপ।

বন বিভাগ বন উজাড়ের দায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করলেও সরেজমিন পরিদর্শন এবং খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়ি, বাঙালি এবং বন বিভাগের লোকজন মিলেমিশে বন উজাড় করেছেন। 

উত্তর কাঞ্চননগরের মান রাজার রাস্তা পার হলেই সামনে পড়ে ধুরুং খাল। একসময়ের খরস্রোতা এই খাল ভরাট হয়ে এখন এর মধ্য দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল করে। খাল পরিণত হয়েছে গবাদিপশুর চারণভূমিতে। খাল পার হলেই চোখে পড়ে সংলগ্ন ফরেস্ট অফিস। ২০০৭ সালের দিকে অফিসটি গুটিয়ে নেওয়া হয়। এই অফিসের পর থেকে উত্তরকূল, ভিলেজার পাড়া, ভুতাইছড়ি, ধুইল্ল্যাছড়ি, হাতিভাঙ্গা, বটতলী, কাউয়াকাটা, ছাইল্যের ছোর, ঘিলাবনিয়া, চিকনছড়া ইত্যাদিসহ উত্তর কাঞ্চননগরে সংরক্ষিত বন প্রথম দিকে রাতের আঁধারে কাটলেও এখন দিনের বেলায়ই কাটা হচ্ছে। উঁচু-নিচু টিলার ওপর দিয়ে বনের কাঠ এবং কাসাভাবাহী চাঁদের গাড়ি ও মোটরসাইকেল চলাচল করে। টিলার পর টিলার বন জ্বালিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে লাগানো হচ্ছে কাসাভা। 

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের নারায়ণহাট রেঞ্জের আওতায় উত্তর কাঞ্চননগর মৌজায় বন বিভাগের ৩ হাজার ৭০৭ একর সংরক্ষিত বন রয়েছে। এর মধ্যে দেড় হাজার একরের বেশি টিলায় কাসাভা চাষ হয়েছে।

সংরক্ষিত বনে যেভাবে শুরু কাসাভা চাষ

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের দিকে ছাইল্যের ছোর এলাকায় প্রায় ১০০ একর সংরক্ষিত বন কেটে কাসাভা চাষ করেন আক্কাস নামের এক ব্যক্তি। ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বন উজাড় এবং কাসাভা চাষ শুরু হয়। ২০২২ ও ২০২৩ সালে প্রায় শতবছরের পুরোনো শত শত একর সেগুন, আকাশমনি, গামারি, বহেড়া বাগান উজাড় করে সেখানে ব্যাপকভাবে কাসাভা চাষ করা হয়। 

সরেজমিন পরিদর্শনের সময় বিস্তীর্ণ কাসাভা খেতের মাঝে ২৫ একর করে মোট ৫০ একর ভূমিতে বনায়নের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। সাইনবোর্ডের তথ্য থেকে জানা যায়, ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি রিফরেস্ট্রেশন অ্যান্ড এফরেস্ট্রেশন’ প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে ‘কোর প্ল্যান্টেশন’সহ প্রায় ৬০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছিল। একদম অপরিণত বয়সে শেষ করে দেওয়া হয়েছে বাগানটি।

স্থানীয় বাসিন্দা জামালউদ্দিন জানান, তিনি তিন দশক ধরে সেখানে বসবাস করছেন। আগে এই বন গাছে ভরপুর ছিল। এখন ঘরে খুঁটি দেওয়ার জন্যও একটি গাছ পাওয়া যায় না। সর্বশেষ তিনি নিজে চোখে দেখেছেন ২৫ একরের একটি জাম বাগান দিনদুপুরে কেটে ফটিকছড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। 

বার্ষিক ভাড়া নেয় বন বিভাগ

ঘিলাবনিয়া বুথাইছড়ির দক্ষিণ পাশের কাসাভা চাষি মো. আলম খবরের কাগজকে জানান, তারা বন বিভাগ থেকে একর হিসাবে ভাড়া নিয়ে কাসাভা চাষ করেছেন। প্রাণ গ্রুপ থেকে চাষের খরচ পান। ফসল তোলার পর কেজি ১০ টাকা করে প্রাণ গ্রুপ কিনে নিয়ে যায়। বন বিভাগকে একরপ্রতি কত টাকা দিতে হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, বন বিভাগের বিষয়টি তার বাবা দেখেন। আলমের বাবা নাছির সর্দার বলেন, তার প্রায় ১০ একর ভূমিতে কাসাভা চাষ রয়েছে। যেহেতু বিক্রির দুশ্চিন্তা নেই, তাই সবাই কাসাভা চাষের দিকে ঝুঁকছেন। বন বিভাগও কোনো ঝামেলা করে না। বন বিভাগকে প্রতিবছর কানিপ্রতি (৪০ শতক) ২ হাজার টাকা দিতে হয়। তবে বন বিভাগের লোকজন টাকা নিতে সেখানে যায় না। সবাই মিলে টাকা তুলে দিয়ে আসতে হয়। গাছ কাটার জন্য তিনি ওই এলাকার সাবেক হেডম্যান উলা প্রু মারমাকে দায়ী করেন। তার মৃত্যুর পর বর্তমানে তার ছোট ভাই থোয়াই সি প্রু মারমা হেডম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

থোয়াই সি মারমা খবরের কাগজকে বলেন, ‘কেউ বিনামূল্যে কাসাভা চাষ করছে না। বন বিভাগ একরপ্রতি হিসাব করে প্রতিবছর টাকা নিয়ে যায়।’ গাছ কাটার বিষয়ে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

কাসাভা চাষে সরকারি কর্মকর্তাও

কাসাভা চাষি নাছির সর্দার বলেন, তার পাশে টিএনও জাফরের (কক্সবাজারের সাবেক এডিসি জাফর আলম) প্রায় ৪০ একর টিলা রয়েছে। তিনি কাসাভা চাষের জন্য তা ভাড়া দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক এডিসি জাফর আলম খবরের কাগজকে বলেন, তার ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০ একরের মতো জমি সেখানে রয়েছে। তিনি তাতে কাসাভা চাষ করেননি। যেহেতু পাহাড়ি জায়গা, দখলে একটু বেশি থাকতে পারে। তিনি বন বিভাগের কোনো গাছ কর্তন বা জমি দখল করেননি বলে দাবি করেন। ভূমি রেকর্ড যাচাই করে দেখা গেছে, ওই এলাকায় বন বিভাগের ভূমি ব্যতীত ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো ভূমি সেখানে নেই। 

গাছ কাটায় যারা জড়িত

বন বিভাগের কর্মচারী, এলাকার সর্দার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, উলা প্রুর সহযোগী হিসেবে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মানিকছড়ির কামাল, তিন টহরির ইউনুচ মেম্বার, বর্তমান মেম্বার আব্দুল মতিন, কুমারী এলাকার হানিফ, শিরু, আবুল হোসেন, শালম, মফিজ, সেলিম, আমান, ওসমান। তারা সবাই পাশের মানিকছড়ি উপজেলার বাসিন্দা। মানিকছড়ি উপজেলার সাবেক এসি ল্যান্ড এবং ইউএনও জাফর আলমের (এডিসি জাফর নামেই বেশি পরিচিত) নামও স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া ফটিকছড়ির একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী বাবুলসহ আরও অনেকেই গাছ কাটেন বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিরু, আবুল হোসেন, শালম, নাছির সর্দার ও তার ছেলেরা, আমান, দেলোয়ার প্রকাশ ওরফে দেলোয়ার হুজুর, বাহাদুরসহ অনেকেই কাসাভা চাষ করেন।

ধ্বংস জীববৈচিত্র্য, মরছে গবাদিপশু

এই বন একসময় হরিণ, বন্য শূকর, গুইসাপ, বনরুই, অজগরসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ, বেজি, বাগডাস, মেছোবাঘ, ভালুক, লম্বালেজি বানর, উল্টো লেজি বানর, হনুমান, উল্লুক নানা জাতের পাখিসহ বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ছিল, যা এখন বিপন্ন হয়ে গেছে। এখন সেখানে আর পাখিরা উড়ে বেড়ায় না বললেই চলে। বানরের পাল খাবার না পেয়ে কৃষকের ধানসহ বিভিন্ন শাকসবজির খেতে হামলা চালায়। আবাস নষ্ট হওয়ায় বন্য প্রাণী খুবই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। প্রাণ-প্রকৃতি সবই বিলুপ্ত।

কাসাভা বাগানের ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেলযোগে এবং হেঁটে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা ঘুরে কোথাও কোনো গরু-ছাগল চোখে পড়েনি। একসময় এই এলাকায় গরু-ছাগলের পাল চরে বেড়াত। গরু-ছাগলের খাবার ঘাস, গুল্ম, লতা-পাতা এখন নেই বললেই চলে। একসময় আশপাশের মানুষ বন থেকে জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, পাহাড়ি বিভিন্ন শাকসবজি, কলা ইত্যাদি সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতেন। এখন চারদিকে শুধু কাসাভা আর কাসাভা।

কাসাভা চাষি আলম জানান, শুরুর দিকে তারা লাল রঙের দেশীয় জাতের কাসাভা চাষ করতেন। ওই জাতের কাসাভা মানুষ তুলে নিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলত। গবাদিপশু অনিষ্ট করত। এখন তারা হাইব্রিড কাসাভার চাষ করেন। সাদা রঙের এই কাসাভার স্বাদ তেতো। এমনকি গরু-ছাগলও এই জাতের কাসাভাগাছের পাতা খেলে মরে যায়। স্থানীয় জামালের চারটি গরু কাসাভার পাতা খেয়ে মরে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, সামশু নামে এক কৃষকেরও দুটি গরু মরে গেছে। স্থানীয়রা জানান, গত তিন বছরে অন্তত ২৫টি গরু এবং ১৫টি ছাগল কাসাভা পাতা খেয়ে মারা পড়েছে।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, কাসাভা একদিকে ওষুধ। আবার কিছু ক্ষেত্রে এর পাতা গবাদিপশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তীব্র গরমে অতিরিক্ত কাসাভা পাতা গরুর জন্য ক্ষতিকর। এমনকি বেশি খেলে পশুর মৃত্যুও হতে পারে। তবে আসল কারণ বের করার জন্য কাসাভা এবং ওই গাছের পাতা পরীক্ষা করা জরুরি।

শুকিয়ে যাচ্ছে হালদার পানির উৎস

কাসাভা আহরণের জন্য বছরে একবার টপ সয়েল খুঁড়তে হয়। এই মাটি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে খালে পড়েছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে খাল, ঝিরি, ছড়া এবং ঝরনা।

বন উজাড় করে মরুকরণের কারণে প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো শুকিয়ে গেছে। গত ২৭ এপ্রিল ঘুরে দেখা গেছে, ছোট পাহাড়ি ছড়াগুলোতে এখন আর পানি নেই। চাষাবাদেও বিঘ্ন ঘটছে। প্রাকৃতিক মাছ প্রজননক্ষেত্র হালদায় উজান থেকে কালাপানিয়া খাল ও ধুরুং খালের মাধ্যমে পানি নামে। যার শাখা খাল হলো কুমারী খাল। কুমারী ও ধুরুং খাল ইদানীং পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে।

হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, বনের সঙ্গে পানির সম্পর্ক আছে। যে পাহাড়ে যত বেশি গাছ থাকে, পাহাড় তত বেশি পানি সংরক্ষণ বা ধারণ করবে। তা ছোট ঝরনার মাধ্যমে খালে এসে পড়ে। বন ধ্বংসের কারণে ঝিরি, ঝরনা, খাল শুকিয়ে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। দেশের রুইজাতীয় মাছের একমাত্র প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতেও পানি নেই। কারণ পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। 

কাঞ্চননগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিদারুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, বন বিভাগ সরকারের সম্পত্তি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এই বনের ওপর নির্ভর করে অসংখ্য পরিবার সারা বছর আয়-রোজগার করত। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। 

নারায়ণহাট রেঞ্জের রেঞ্জার ইলিছুর রহমান খবরের কাগজকে প্রথমে বলেন, বন উজাড় করে কাসাভা চাষের বিষয়টি তার জানা নেই। চাষিদের কাছ থেকে বছরভিত্তিক টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, গত বছর সেখানে তদন্ত করতে গিয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা না পাওয়ায় বাইন্যাছোলা আর্মি ক্যাম্পের পর আর যেতে পারেননি। চলতি বছরে সেখানে প্রায় এক হাজার হেক্টর জায়গায় বাগান করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে সেখানে নতুন বাগান হবে। বন উজাড়ের জন্য তিনি পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের দায়ী করে বলেন, বন বিভাগের জায়গায় বন কর্মকর্তারা প্রবেশ করতে পারেন না। বিট কর্মকর্তা অবনী ভূষণ রায়ের দাবিও একই। তিনি দাবি করেন, এলাকাটি পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণ করে। বিষয়টি তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। 

এসিএফ (নারায়ণহাট) হারুন অর রশীদ বলেন, এখানে তিনি যোগদান করেছেন বেশি দিন হয়নি। গাছ কাটা ও কাসাভা চাষে প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় বন বিভাগের পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না। কাসাভা চাষিদের কাছ থেকে প্রতিবছর একরপ্রতি টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে টাকা কার পকেটে যায়। তখনই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিভাগীয় কর্মকর্তা (চট্টগ্রাম উত্তর) এস এম কায়চার প্রতিবেদককে প্রথমে বিট কর্মকর্তা, রেঞ্জার এবং এসিএফের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি জানালে তিনি জানান, বন উজাড় কিংবা সেখানে কাসাভা চাষের বিষয়টি তার জানা নেই। দায়িত্বশীলরা সন্ত্রাসী এবং প্রভাবশালীদের যে দোহাই দিয়েছেন, সে বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি মোবাইল ফোন কেটে দেন।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস খবরের কাগজকে বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে কেউ যদি বন এবং মাটি ধ্বংস করে, তার কোনো ছাড় নেই।

 

যৌথ বাহিনীর চিরুনি অভিযান ১০ দিনে গ্রেপ্তার সাড়ে ৫ হাজার

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১:৩৬ এএম
আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১:৪৯ এএম
১০ দিনে গ্রেপ্তার সাড়ে ৫ হাজার
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

দেশব্যাপী সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। এরই ধারাবাহিকতায় যৌথ বাহিনী সারা দেশে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশ জানায়, গত ১০ দিনে সারা দেশে ৫ হাজারের বেশি দুষ্কৃতকারীকে আটক করা হয়েছে।

এর মধ্যে শুক্রবার (২৬ জুলাই) পর্যন্ত ২ হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। 

এদিকে শুক্রবার রাতে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি, কড়াইল বস্তি, আরজতপাড়া, শাহিনবাগ, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, গোপীবাগ, বাড্ডা, শাহবাগ, কুড়িল, ধানমন্ডিসহ বেশ কিছু জায়গায় ব্লক রেড অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ।

এসব এলাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে সার্চ করেও আসামিদের শনাক্ত করা হয়। এ ছাড়া ঢাকার প্রবেশপথে তল্লাশি করা হয় এবং কাউকে সন্দেহ হলেই পুলিশ আটক করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে রাজধানী ও প্রবেশপথ থেকে চার শতাধিক দুষ্কৃতকারীকে আটক করা হয়েছে। 

শুক্রবার ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কে এন রায় নিয়তি জানান রাজধানীতে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় ২০৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গতকাল পর্যন্ত ২ হাজার ৩৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় দুষ্কৃতকারীরা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের ধরা হচ্ছে এবং এই অভিযান চলমান থাকবে। বাংলাদেশ পুলিশের অকুতোভয় সদস্যদের মনোবল অটুট রয়েছে। তারা দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা প্রদানে বদ্ধপরিকর। 

পুলিশের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘একটি গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রকে অকার্যকর করা ও সরকারকে উচ্ছেদ করা। অর্থাৎ সেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজটাই তারা করেছে। এর সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্ররা এসব জ্বালাও-পোড়াও করেনি। কোটাবিরোধী যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, প্রকৃত পক্ষে সেই আন্দোলন হাইজ্যাক করা হয়েছে। যারা নাশকতাকারী, রাষ্ট্রবিরোধী, সরকার এবং রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, রাষ্ট্রকে অচল করে দিতে চায় তারাই মূলত ছাত্র আন্দোলন হাইজ্যাক করেছিল। এই নৈরাজ্য পরিস্থিতি যারা সৃষ্টি করেছে তারা রেহাই পাবে না। তা ছাড়া আমাদের কাছে তথ্য আছে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা জেলা পুলিশের উদ্যোগে মহাসড়কে মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে হকারদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। সেই হকাররাও এই নৈরাজ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য জ্বালাও-পোড়াও করেছে।’

ঢাকার সহিংসতায় অংশ নেয় দেড় শতাধিক জেএমবি সদস্য
রাজধানীতে চালানো নাশকতা ও তাণ্ডবে অংশ নেন রাজশাহী বিভাগের জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া রয়েছে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির দেড় শতাধিক সদস্য। তাণ্ডব চালিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফেরার পথে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা এসব স্বীকার করেছেন। পুলিশ বলছে, তারা স্বীকার করেছেন, শীর্ষ নেতাদের নির্দেশেই সরকার পতনের জন্য এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও জেএমবির জঙ্গিরা।

এ বিষয়ে র‌্যাব-৫-এর অধিনায়ক ফিরোজ কবির খবরের কাগজকে জানান, জেএমবির সদস্যরা ঢাকা, গাজীপুর ও নরসিংদী এলাকায় সংঘটিত নাশকতায় অংশ নিয়েছে। বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে এবং এ বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এদের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে র‌্যাব অধিকতর তদন্ত চালাচ্ছে এবং অন্যান্য জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

৭৮ পুলিশ বক্সে আগুন-লুটপাট, নথিপত্রসহ মূল্যবান জিনিস গায়েব, ‘আশ্রয়হীন’ ট্রাফিক পুলিশ
এদিকে গত কয়েক দিনের নাশকতায় রেহাই পায়নি ট্রাফিক পুলিশও। রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশের ৭৮টি বক্সে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়েছে। চালানো হয়েছে নজিরবিহীন লুটপাট। এতে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক সদস্যরা। 
মিরপুর-১০-এর মোড়ে ডিউটিরত মো. তছিমুর নামের একজন ট্রাফিক সদস্য খবরের কাগজকে জানান, ঘটনার দিন তারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন। ট্রাফিকের প্রতিটি সদস্য মাঠে ওই দিন আন্দোলনকারীদের সামাল দিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর ফাঁকে তাদের ট্রাফিক বক্সে আগুন দেওয়া হয়। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ওভারব্রিজে। আন্দোলনকারীদের ভিড় এতটাই ছিল যে, দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসাটাও ছিল দুরূহ ব্যাপার। এতে চোখের সামনেই পুড়ে যায় সব। তিনি আরও জানান, হামলাকারীরা শুধু ট্রাফিক বক্সে আগুন দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি। তারা ট্রাফিক বক্সের জানালা, দরজা, এসিসহ মূল্যবান জিনিসপত্র, চুরি লুটপাট করেছে। 

জানা গেছে, শুধু মিরপুর ও মোহাম্মদপুরেই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মহাখালী পুলিশ বক্স, গুলশান ট্রাফিকের ডিসি অফিসও। গুলশান ট্রাফিকের ডিসি অফিসে ভাঙচুরের পাশাপাশি লুটপাট চালানো হয়েছে। অফিসের সামনে পার্ক করা ৯টি মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, কম্পিউটার, এলইডি মনিটরসহ প্রায় ৬২ লাখ টাকার জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে। এমনকি ট্রাফিক সদস্যদের ব্যবহার করা লেগুনাটি নিয়ে গেছে লুটকারীরা।

গুলশান ট্রাফিকের এডিসি হাফিজুর রহমান বলেছেন, কেসের রেকর্ডসংক্রান্ত কাগজপত্রসহ মূল্যবান জিনিস খোয়া গেছে। এতে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে এটা বলে বোঝানো যাবে না। এরা সুযোগসন্ধানী ও তৃতীয় পক্ষের কেউ বলে মনে করছেন তারা। ট্রাফিকের সদস্যরা বলছেন, তারা চাকরিজীবনে এমন তাণ্ডব দেখেননি। এই অবস্থা থেকে তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। আপাতত তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডিউটি করছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মনিবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের পুরো ঢাকায় ৭৮টি ট্রাফিক বক্সে আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ট্রাফিক বক্সে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। খুব শিগগির আমরা ট্রাফিক বক্সগুলো নতুন করে মেরামত করব। আপাতত ট্রাফিক সদস্যরা বক্স ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের এখন বসার জায়গাটুকুও নেই।’

সূত্র জানায়, পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও আনসারের ৩১৩ স্থাপনায় হামলা করে চার বাহিনীর প্রায় ৩০০টি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নথি চুরি ও লুটপাট করা হয়। ভাঙচুর করা হয়েছে তাদের সাঁজোয়া যানসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিক্ষোভ ও সংঘাত ঘিরে চার বাহিনীর প্রায় ৩০০টি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ভাঙচুর হয়েছে পুলিশের সাঁজোয়া যান আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ারেও (এপিসি)। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের কার্যালয়ের পাশাপাশি থানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানার মূল্যবান নথি পুড়ে গেছে এবং চুরি হয়েছে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর খবরের কাগজকে বলেন, এবার নাশকতার চিত্র ছিল ভিন্ন। সবার আগের পুলিশকে লক্ষ্যবস্তু করে হামলা করা হয় এবং আগুন ও নথিপত্রসহ অনেক কিছু গায়েব করা হয়েছে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান খবরের কাগজকে জানান, নতুন করে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করলে শক্তভাবে দমন করা হবে।

‘কিছু বোঝার আগেই গুলি লাগে কোমরে’

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৪:২০ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৩:৫৪ পিএম
‘কিছু বোঝার আগেই গুলি লাগে কোমরে’
গুলিতে আহত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসারত কয়েকজন। ছবি : খবরের কাগজ

২০ জুলাই শনিবার, তখন কারফিউ জারি হয়েছে, অবস্থা শান্ত দেখে মিলন বেগম তার চৌদ্দ বছরের ছেলে মিরাজকে ঘরের পাশের সবজির দোকানে পাঠান কাঁচা মরিচ আর ধনেপাতা কিনতে। ঘর থেকে বের হয় মিরাজ। কিন্তু কিছুদূর যেতেই গুলি লাগে তার শরীরে। ঠিক বুঝতে পারে না মিরাজ কী হলো, অচেতন হয়ে পড়ে যায় রাস্তায়। পরে রাতে তাকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। দ্রুত রক্ত বন্ধ করে ভর্তি করা হয়। রবিবার অস্ত্রোপচারের পর এখন সার্জারি ওয়ার্ডে আছে সে। তবে আন্দোলনে না গিয়েও এমন আঘাতে এখনো আতঙ্কিত মিরাজ। তাই স্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের বেডে।

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সকালে সরেজমিনে ঢামেক হাসপাতালে গিয়ে দেখা পাই মিরাজের। হাসপাতালের বেডে ছেলের শিহরে উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিলেন মা মিলন বেগম। তার কাছ থেকেই জানতে পারি মিরাজের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি।

মিরাজের মতো কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গুলিতে আহত আরও অনেকেই এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢামেক হাসপাতালে। এদের একজন জিহাদ। গত শুক্রবার সে জুমার নামাজ পড়ে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বন্ধুদের সঙ্গে। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে তার কোমরে। এরপর বেরিয়ে যায় পেট দিয়ে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে জিহাদ। তার বড় ভাই জাহিদ জানান, জিহাদের অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। তবে চিকিৎসকরা আশা করছেন আর কয়েক দিন পরে পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত হবে জিহাদ।

সার্জারি বিভাগের একই ওয়ার্ডে মিরাজের পাশের বেডে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন নার্গিস। তার পিকআপচালক স্বামী কাজল গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। নার্গিস বলেন, পিঠ দিয়ে ঢুকে গুলি পেট দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অবস্থা অনেক খারাপ ছিল। এখন একটু ভালো, আল্লাহই বাঁচাইছে...।

তিনি জানান, ফকিরাপুল থেকে যাত্রাবাড়ী দিয়ে যাচ্ছিলেন কাজল। রাস্তায় গোলমাল দেখে গাড়ি থামিয়ে একটু এগিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন যে সামনে আর যাওয়া ঠিক হবে কি না। কিন্তু সামনে এগোনোর আগেই গুলি লাগে কাজলের শরীরে। কে বা কারা গুলি করেছে তা বলতে পারেননি কাজল।

ঢামেক হাসপাতালের কেবল সার্জারি বিভাগের ৬টি ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায় প্রতি ওয়ার্ডে গড়ে ৫ থেকে ৭ জন রোগী ভর্তি আছে গুলিবিদ্ধ হয়ে।

বৃহস্পতিবারের প্রতি ওয়ার্ডের হিসাব বলছে, বেলা ১১টা পর্যন্ত ২১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ২৭টি সিটের বিপরীতে আছে ৫৬ জন রোগী, ২১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ২৮টি সিটের বিপরীতে রোগী আছেন ৫০ জন, ২১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ সিটে রোগী আছেন ৪১ জন, ২১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৩০ সিটে রোগী আছেন ৩৪ জন, ২১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৫টি সিটের বিপরীতে রোগী ৪৬ জন, ২২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৩১টি সিটের বিপরীতে রোগী আছেন ৪৩ জন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন নার্স খবরের কাগজকে বলেন, আমরা প্রতি সিটের বিপরীতে ৪ জন করে রোগীকে সেবা দিচ্ছি। পরিস্থিতির কারণে রোগী বেশি। সুতরাং সবাইকে সেবা তো দিতেই হবে। এখন আমাদের নতুন রোগী ভর্তি নেওয়ার সময় তাই কিছুক্ষণ পর রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে।

সব নথি পুড়ে ছাই, লুণ্ঠিত ৪৬ অস্ত্র নিয়ে উৎকণ্ঠা

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:১০ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:১০ পিএম
সব নথি পুড়ে ছাই, লুণ্ঠিত ৪৬ অস্ত্র নিয়ে উৎকণ্ঠা
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা, ভাঙচুর, ফটক ভেঙে বন্দি পালানো ও লুটপাটের ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছাই কারাগারের সব নথি। গত চার দিনে পলাতক ৮২৬ বন্দির মধ্যে ৪৬৮ জন আত্মসমর্পন করেছেন বা থানাপুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন। লুট হওয়া ৮৫ অস্ত্রের মধ্যে ৩৯টি, ১ হাজার গুলি ও অনেক হাতকড়া উদ্ধার করা হয়েছে। নাশকতার ঘটনায় কারাগারের ১১ কোটি ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারা অধিদপ্তর সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। 

সূত্র অনুসারে, দেশের ইতিহাসে এর আগে এমনভাবে কোনো কারাগার থেকে সব আসামি পালানো ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি।

এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে দেশের সব কারাগারে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি কারাগারগুলোতে সেনা টহল  অব্যাহত রয়েছে। 

কারা সূত্র জানায়, এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে বিচার বিভাগীয় দুটি তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্ম সচিব ফারুখ আহম্মেদকে প্রধান করে ৬ সদস্যের কমিটি ও কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমানকে প্রধান করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া নরসিংদী কারাগারের জেল সুপার, জেলারসহ সেখানে দায়িত্বরত সবাইকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ওই কারাগারে এখন দায়িত্ব পালন করছেন নতুন একজন জেল সুপার ও দুজন ডেপুটি জেলার। অগ্নিকাণ্ডের ফলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে নরসিংদীর কারাগারটি। সেখানে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। 

সূত্র আরও জানায়, ১৫ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালায় কারাগারে। পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ জন কয়েদির মধ্যে ছিল ৯ জন জঙ্গি ও হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এদের অনেকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। কারাগারে হামলার প্রাথমিক কারণ হিসেবে জানা গেছে, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে যে নাশকতা চলছিল তাতে অস্ত্র ও বন্দিদের ব্যবহার করা।

এ ঘটনায় ২৩ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়া দেশকে বিপর্যস্ত করতে এ আক্রমণ হয়েছে। নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের ধরে আইনের আওতায় আনতে যা যা করা দরকার সরকার সবই করবে। নরসিংদী কারাগারের যে জায়গাকে আমরা সেফ জোন মনে করি, সেখানে তারা ভাঙচুর তো করেছেই, অগ্নিসংযোগও করেছে। অস্ত্রাগার লুট করেছে। যেসব জঙ্গি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, আমাদের পুলিশ বাহিনী যাদেরকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আটক করেছিল, এখান থেকে তাদেরকে সন্ত্রাসীরা মুক্ত করে নিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তাদের উদ্দেশ্য দেশকে একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়া। তাদেরকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কেন এই ঘটনা ঘটল, কারও গাফিলতি আছে কি না, কেউ এখানে সহযোগিতা করেছে কি না, এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তিন সদস্যের কমিটি করেছেন আইজি প্রিজন। আর ৬ সদস্যের কমিটি করেছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ। যদি কারও গাফিলতি থাকে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

এ বিষয়ে গতকাল দুপুরে কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘কারাগারের ফটক ভেঙে বন্দি ও অস্ত্র লুটের ঘটনা দেশের ইতিহাসে নেই। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত। এখনো উদ্ধার হয়নি ৪৬টি অস্ত্র। এ নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠায় রয়েছি। এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে সে জন্য দেশের কারাগারগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি সেনা টহল অব্যাহত রয়েছে।’

নথি পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি বলেন, ‘আগুন দেওয়ায় কারাগারের সব নথি পুড়ে গেছে। এখন আসামিদের ডিজিটাল যে ডেটাবেজ তৈরি করা হয়েছে সেই তথ্যের ভিত্তিতে মামলা ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ 

তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় মামলা হয়েছে ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চলছে, এই সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে তাদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া হবে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।’ 

কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় কারাগারে অগ্নিসংযোগ ও সেলের তালা ভেঙে ৯ জঙ্গিসহ ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে যান। পাশাপাশি অস্ত্র-গোলাবারুদ ও খাদ্যপণ্য লুট এবং ব্যাপক ভাঙচুর করেন হামলাকারীরা। এতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় নরসিংদী জেলা কারাগার। 

‘বাবা তুই বেঁচে আছিস এটাই বড় পাওয়া’

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১১:৫০ এএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৫:২৬ পিএম
‘বাবা তুই বেঁচে আছিস এটাই বড় পাওয়া’
বাড্ডা এলাকায় সহিংসতায় পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থী রিফাতের একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। ছবি: খবরের কাগজ

গুলি লাগায় মো. রিফাত হাওলাদারের ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে। হঠাৎ এক পা হারিয়ে এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাকে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কথা বলতে বলতেই গলা জড়িয়ে আসে তার। দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে পানি।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার আলাতুন্নেছা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির এই ছাত্র বলছিল, ‘এখন আমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলার মাঠে থাকার কথা। কিন্তু এক গুলিতেই আমার সব স্বপ্ন শেষ।’

ক্ষোভ ঝেড়ে বলে, ‘একদিন আমার এই পা সাক্ষী দেবে কত বড় অন্যায় হয়েছে আমার সঙ্গে। বড় হয়ে অফিসার কি আর হতে পারব?’ পাশে থাকা এই কিশোরের বাবা ট্রাভেলস ব্যবসায়ী মো. রিয়াজ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারপরনাই দুর্ভাবনায় পড়েছেন। তবু সন্তানকে সাহস দিয়েছেন এই বলে যে, ‘কতজনের তো প্রাণ-ই চলে গেছে। তুই বেঁচে আছিস এটাই বড় পাওয়া।’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা রোডে সংঘর্ষের সময় গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রিফাতের পায়ে গুলি লাগে। পরে রিকশায় করে তাকে মেরুল বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে এক হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে নিয়ে যাওয়া হয় এএমজেড হাসপাতালে। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে ভর্তি করা হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে। 

বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সরেজমিন এই হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগে গুলিবিদ্ধ ৩৬ জন ভর্তি রয়েছেন। এখানেই বেশির ভাগ আহতের চিকিৎসা চলছে। তাদের সবার শরীরের কোনো না কোনো অংশে গুলি লেগেছে। কমপক্ষে চারজনের পা অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া আরও কয়েকজনের পা-হাত কেটে ফেলতে হতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। বাকিরা অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। ক্যাজুয়ালটি-১, ক্যাজুয়ালটি-৩ বিভাগ ও নতুন ভবনেও কয়েকজন আহত ভর্তি আছেন বলে একজন নার্স জানান। 

ক্যাজুয়ালটি-২ বিভাগের ১৯ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন ১৬ বছরের মো. নাদিমও এক পা হারিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে একটি এমব্রয়ডারি কারখানায় কাজ করা নাদিম কাজ শেষ করে শনিবার বিকেলে বাসায় ফেরার পথে চিটাগাং রোডে তার পায়ে গুলি লাগে। পরে তিনটি হাসপাতাল ঘুরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। তার মা মরিয়ম জানান, একটা গুলি ছেলের হাঁটুর মধ্য দিয়ে ঢুকে যায়। পুরো পায়ের মাংস কালো হয়ে পচন ধরায় সোমবার চিকিৎসকরা তার পা কেটে ফেলেন। এই কিশোরের মা আরও জানান, তার স্বামী অটোরিকশাচালক। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে নাদিম সবার বড়। মাসে ৭ হাজার টাকা আয় করত। দরিদ্র এই পরিবারের এখন চিকিৎসার খরচ চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।

কাঁদতে কাঁদতে মরিয়ম বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেটা এখন বেঁচে থেকেও মরার মতো। ওর জীবনের কোনো দাম আর নেই।’ 

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে এই হাসপাতালে এসেছে গুরুতর আহতরা। বিশেষ করে চিটাগাং রোড, কুড়িল, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে আহতদের নিয়ে আসা হয়। আহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী ছাড়াও সিএনজিচালক, গাড়িচালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন।

চিটাগাং রোড এলাকায় গত শনিবার (২০ জুলাই) সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হন সেলুনে কাজ করা রাকিব। এই কিশোরেরও বাম পা কাটতে বাধ্য হয়েছেন চিকিৎসকরা। অন্যদিকে পঙ্গুতে চিকিৎসাধীন ডেমরার দনিয়া এলাকার সিএনজিচালক মো. আমিরুল ইসলামের ডান পায়ে গত শনিবার গুলি লাগে। কোথা থেকে কীভাবে গুলি লাগল বুঝতেই পারেননি তিনি। ইয়াসিন নামের ১১ বছরের এক শিশু কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়। বাড্ডা-নতুনবাজার এলাকা থেকে ডান হাতে গুলি লেগে পঙ্গুতে ভর্তি আছেন মো. সজিব খান।

তিনি দাবি করেন, ‘পুলিশ আমাদের বলল এখন রাস্তা পার হতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই। এমন অবস্থায় কোথা থেকে গুলি এসে আমার হাতে লাগল, জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, এমন এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়েছে যে রাস্তার পাগল, এমনকি কুকুরের মতো অবুঝ প্রাণীরাও এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেছে। আমি হাসপাতালে থাকায় আমার সাত বছরের সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে।’

ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ক্যাজুয়ালটি বিভাগ-১-এ ভর্তি টঙ্গীর মো. রাজুর মা জানান, ব্যথায় দিনরাত চিৎকার করছে তার ছেলে। এই প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে প্রশ্ন রাখেন, ওর স্ত্রী, দুই বাচ্চার কী হবে এখন?

এদিকে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আহতদের তথ্য নিতে গতকাল দুপুরে হাসপাতালে যান পুলিশ সদস্যরা। তারা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, হাতের ছাপ নেওয়ায় আতঙ্ক দেখা দেয় আহত ব্যক্তি ও তাদের স্বজনদের মাঝে। 

নিটোরের অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এ পর্যন্ত আড়াই শর বেশি রোগী এসেছেন সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়ে। এর মধ্যে বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে সবাই এখন শঙ্কামুক্ত। ছয়জনের পা কেটে ফেলতে হয়েছে।’

তিনি জানান, গুলিবিদ্ধ যারা এসেছেন তাদের মধ্যে ১৮ জুলাই আসা ১৭ জন শিক্ষার্থী। পরে যারা এসেছেন তাদের মধ্যে কোনো শিক্ষার্থী নেই।

কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে ইসির ৩০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০১:৩৩ পিএম
আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৬:১৭ পিএম
কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে ইসির ৩০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প
নির্বাচন কমিশন (ইসি)

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বাড়াতে ২৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকার নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইসি। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের নাম এনহেন্সিং ইফিসিয়েন্সি অব এপ্লয়িজ অব ইলেকশন কমিশন সেক্রেটারিয়েট (ইইইইসিএস)। এর মূল লক্ষ্য- প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ইসির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো। প্রকল্পের মেয়াদকাল নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মাধ্যমে যেসব প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব হয় না, সে ধরনের প্রশিক্ষণ আয়োজন করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য। বিশেষ করে তাদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বাড়ানো, যাতে বিদেশে গিয়ে কমিউনিকেশন ও নেগোসিয়েশনের দক্ষতা বাড়ে। এ ছাড়া বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর নানা উদ্যোগ রয়েছে প্রকল্পে। ইসির প্রস্তাবিত নতুন প্রকল্পটি বর্তমানে অনুমোদনের অপেক্ষায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। চলতি মাসে এটি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাস হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রকল্পের জনশক্তি কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই প্রকল্প পরিচালনায় ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে না। মোট জনবল থাকবে মাত্র ছয়জন। তার মধ্যে নতুন করে একজন হিসাবরক্ষক, একজন গাড়িচালক ও একজন অফিস সহকারী নিয়োগ দেওয়া হবে। বাকি পদগুলোতে কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারাই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন এবং এই কাজের জন্য তাদের বাড়তি সম্মানীও থাকবে না। 

এর আগে গত ৩০ জুন শেষ হয় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও শক্তিশালীকরণ (এসসিডিইসিএস) প্রকল্পের কার্যক্রম। ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ওই প্রকল্পেরও মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। লক্ষ্য ছিল- প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেবার মান বাড়াতে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানো এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা পেতে সাধারণ নাগরিকদের ভোগান্তি কমানো। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওই প্রকল্পের আওতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশে প্রশিক্ষণের ৫০ শতাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। 

ওই প্রকল্পের অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘প্রকল্পের ৯৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা আমরা পূরণ করতে পেরেছি। তবে প্রকল্প চলাকালে বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতিসহ নানা কারণে ১০০ জন কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানোর কথা থাকলেও সেখানে ৫০ জনকে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। আর নির্ধারিত বাজেটের তুলনায় ব্যয় সাশ্রয় হওয়ায় ১০ শতাংশ অর্থ উদ্ধৃত হয়েছে, যা ফেরত দেওয়া হয়েছে।’ ওই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারের নতুন প্রকল্প আরও বেশি কার্যকর ও সফল হবে, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন অতিরিক্ত সচিব। 

এ ছাড়া ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে ‘নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় আইসিটি ব্যবহারে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় ইসি। গত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া প্রকল্পটির পরিচালক করা হয়েছে সংস্থার প্রশাসন ও অর্থ শাখার যুগ্ম সচিব মো. মনিরুজ্জামান তালুকদারকে। এ ছাড়া পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও প্রকাশনা শাখার উপপ্রধান মুহাম্মদ মোস্তফা হাসানকে উপপ্রকল্প পরিচালক এবং সিনিয়র সহকারী প্রধান মো. রাজীব আহসানকে সহকারী প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি ৩৭ কোটি ৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকার এই প্রকল্পের ব্যয়ের ৪০টি খাত নির্ধারণ করা হয়। খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে প্রশিক্ষণে- ১৯ কোটি ৮৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এরপর রয়েছে সেমিনার, আউটসোর্সিং এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাতের ব্যয়। প্রকল্পের অধীনে বর্তমানে নির্বাচন কমিশন কার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ফলাফল ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, স্মার্ট নির্বাচনি ব্যবস্থাপনা অ্যাপ, অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সিস্টেম, ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম, এনআইডি সার্ভার প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে সেবা ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের চেষ্টা করছে।