ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দ্বিতীয় ধাপে ভোটের বাকি আর মাত্র দুই দিন। এই ধাপে সবচেয়ে বেশি, ১৫৭ উপজেলায় একযোগে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ২১ মে ভোটের দিন কেন্দ্রের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ও নির্বিঘ্ন রাখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত ৮ মের উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার কম হওয়ায় এই ধাপের নির্বাচনে ভোটের দিন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি ভোটের হার বাড়ানোকে ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা।
গত তিনটি উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০০৯ সালে তৃতীয় উপজেলা পরিষদে ভোটের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ৬১ শতাংশ। তারপর ২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকের উপজেলা নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। তবে এবার ভোটের হার সবচেয়ে কম, ৩৬.১৮ শতাংশ।
সংকট উত্তরণে কমিশন বৈঠকে নেওয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন উপলক্ষে ইসির বিভাগীয় মতবিনিময় সভায় স্থানীয়দের ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করছেন, প্রার্থীদেরও তাগিদ দিচ্ছেন নির্বাচন কমিশনাররা। গত বৃহস্পতিবার যশোরে উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান।
তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে প্রার্থীদের আলাদাভাবে প্রচার চালাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা ভোটাদের বাধা দেবে, তাদের প্রতিহত করবে প্রশাসন। ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাধা দিলে আইনি ক্ষমতা প্রয়োগে প্রশাসনকেও আমরা নির্দেশনা দিয়েছি।’
নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের (ইসির) দায়িত্ব হলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে দেওয়া। সেটা বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভোটারের কাছে যাওয়া, তাকে ভোট দিতে আগ্রহী করা বা তার ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা দরকার প্রার্থীদের। আর আমাদের তরফ থেকে মাঠপ্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সভা সমাবেশে ভোটের পরিবেশ নিয়ে বার্তা দেওয়া, ভিডিওচিত্র প্রদর্শনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রার্থীদের জনপ্রিয়তাও কিন্তু ভোটের হারে প্রভাব ফেলে। সে জন্য ভোটারদের আস্থায় নিতে প্রার্থীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সুষ্ঠু ভোটের আবহ তৈরি করা হয়েছে। ভোটবিরোধী প্রাচারের ব্যাপারেও সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আশা করছি, এই ধাপের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে।’
কেন্দ্রে ভোটার আনতে প্রার্থীদের পরিকল্পনা
ভোটাররা কেন আপনাকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসবেন, তাদের আগ্রহী করতে কোনো পরিকল্পনা কী নিয়েছেন- এ প্রশ্নে জবাবে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. লোকমান হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের পাশে ছিলাম, আগামীতেও থাকব। ভোটের দিন কেন্দ্রে আসতে তাদের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য আমার কর্মীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছি, ভোটারদেরও উদ্বুদ্ধ করছি।’
কথা হয় নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী আসলাম উদ্দিন ও লালপুর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী শামীম আহমেদ সাগরের সঙ্গে। তারা জানান, জনসংযোগের সময় প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করছেন। যাদের বাড়ি ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে, তাদের তালিকা করে কেন্দ্রে নিয়ে আসা ও বাড়ি পৌঁছাতে গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এ ছাড়া প্রতিটি কেন্দ্রের আওতায় শতাধিক কর্মী নিয়োগ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। বিশেষ করে নারী ও নতুন ভোটারদের আগ্রহী করার চেষ্টা চলছে।
কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন যশোরের চৌগাছায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তানিছুর রহমান, ঝিকরগাছা উপজেলার প্রার্থী মনিরুল ইসলাম ও সেলিম রেজা। তারা জানান, কর্মীদের নিয়ে তারা বারবার ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি লক্ষ্য রাখতে এবং প্রয়োজনে ওই দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতেও পরিকল্পনা সাজিয়েছেন অনেক প্রার্থী।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
শিক্ষাবিদ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এই পরিস্থিতি কী হঠাৎ করে হয়েছে? না তা হয়নি। শুধু স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন না, বহুদিন ধরেই সংসদ নির্বাচনসহ বিগত অনেক নির্বাচনেই ভোটের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট চলছে। এটা হলো দীর্ঘদিন ধরে চলা রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির প্রতি তাদের আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। ভোটের মূল্যায়ন যেহেতু হচ্ছে না, তাই মানুষ ভোট দেওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আগ্রহ কেনই বা হবে, ভোট হচ্ছে একদলীয় প্রার্থীদের মধ্যে। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয় না। যেসব দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, কেন অংশ নিচ্ছে না- সেই অচলাবস্থার কোনো সমাধান তো হচ্ছে না। চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচনের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ফেরানো সম্ভব নয়।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক রায়ের স্বীকৃতি আদায়ে যে দেশ (বাংলাদেশ) স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশের মানুষ এখন ভোট দিতে চায় না। কেন এই পরিস্থিতি, তা সত্যি উদ্বেগের বিষয়। রাজনীতিবিদরা নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতার অপব্যহার করে ব্যক্তিগত অগাধ সম্পদ অর্জন ও পেশিশক্তির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। ক্ষমতার রাজনীতির দুষ্ট সংস্কৃতি ডালপালা ছড়িয়ে নির্বাচন এখন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচনে সব দল না আসায় ভোটকে ঘিরে নেই উৎসবমুখর পরিবেশ। যেকোনো উপায়ে জয়ী হওয়াই সবার লক্ষ্য। পরাজিত হলে জনগণের ভোটের রায় মেনে নেওয়ার মানসিকতা কারও নেই। এসব কারণে ভোটের প্রতি ভোটারদের আস্থাহীনতা চরম আকার ধারণ করছে।
পরিস্থিতির উত্তরণে নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি ও জনগণের ভোটের রায় মেনে নেওয়ার মানসিক সংস্কৃতিতে ফিরে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধান অনুঘটক হতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। যেকোনো উপায়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার অসুস্থ মানসিকতা থেকে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা করতে হবে।
বিনা ভোটে জয়ী ২১ প্রার্থী
একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় দ্বিতীয় ধাপে এরই মধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন ২১ প্রার্থী। চেয়ারম্যান পদে- কুমিল্লা আদর্শ সদরে আমিনুল ইসলাম, জামালপুরের ইসলামপুরে মো. আ. ছালাম, ফরিদপুরের নগরকান্দায় মো. ওয়াহিদুজ্জামান, চট্টগ্রামের রাউজানে এ কে এম এহছানুল হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আবুল কাশেম চিশতী, সাভারে মঞ্জুরুল আলম রাজীব ও মৌলভীবাজার সদরে উপজেলার কামাল হোসেন।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে- রাজশাহীর বাগমারায় শহীদুল ইসলাম, রাঙামাটির রাজস্থলীতে হারাধন কর্মকার, কুমিল্লা আদর্শ সদরে আহাম্মেদ নিয়াজ, চট্টগ্রামের রাউজানে নুর মোহাম্মদ, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে রফিকুল ইসলাম, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সুমন ও রূপগঞ্জে মিজানুর রহমান।
এ ছাড়া মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে- রাঙামাটির রাজস্থলীতে গৌতমী খিয়াং, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সাঈদা সুলতানা, কুমিল্লা আদর্শ সদরে হোসনে আরা বেগম, চট্টগ্রামের রাউজানে রুবিনা ইয়াছমিন রুজি, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় হোসনে আরা বেগম, নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে শাহিদা মোশারফ ও রূপগঞ্জে ফেরদৌসী আক্তার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৬৩ জেলার ১৫৭ উপজেলায় প্রথমে মনোনয়নপত্র জমা দেন ২ হাজার ৫৫ জন প্রার্থী। তাদের মধ্য থেকে ১৭৭ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ১ হাজার ৮২৮ জন। তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬০৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬৯৪ জন, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৫২৯ জন প্রার্থী রয়েছেন। এ ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের প্রচার শেষ হবে আগামীকাল রবিবার মধ্যরাতে।
এরপর তৃতীয় ধাপে ২৯ মে ১১২ উপজেলায় (২১টিতে ইভিএম) এবং সবশেষ চতুর্থ ধাপে ৫৫ উপজেলায় (২টিতে ইভিএম) ভোটের আনুষ্ঠানিকতা চলছে। দেশের ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে এ পর্যায়ে ৪৭৬টি উপজেলায় চার ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে নির্বাচন কমিশন। আর ১৯টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের এখনো সময় হয়নি। পরে চার ধাপে যেসব উপজেলার ভোট নানা কারণে স্থগিত হবে সেসব উপজেলায় নির্বাচন করা হবে বলে জানিয়েছে ইসি।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন খবরের কাগজের নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর এবং টাঙ্গাইল ও হবিগঞ্জের জেলা প্রতিনিধি)