গণপরিবহন হিসেবে মেট্রোরেলের চাহিদা যখন ক্রমশ বাড়ছে, তখন মেট্রোরেলের নিরাপত্তা ও কারিগরি ইস্যুতে নতুন তথ্য দিল ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-(ডিটিসিএ)। দেড় বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকার উত্তরা-মিরপুরবাসীকে যাত্রীসেবা দিয়ে আসা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের নিরাপত্তা ইস্যুতে বিমা করেনি। শুধু তাই নয়, কারিগরি ও নিরাপত্তা সনদ ছাড়াই চলছে মেট্রোরেল।
তৃতীয় পক্ষ হিসেবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে নিরাপত্তা সনদ নেওয়ার বিধান থাকলেও ঢাকা ম্যাস ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) তা করেনি। এই প্রতিষ্ঠানটি মেট্রোরেল পরিচালনা করছে। এই ইস্যুতে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসিএ একাধিকবার চিঠি দিলেও ডিএমটিসিএল কোনো উত্তর দেয়নি।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট লিমিটেড কোম্পানি লিমিটেড ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে একাধিক সভার কার্যবিবরণী ও দুই কর্তৃপক্ষের মধ্যে চালাচালি হওয়া বেশ কয়েকটি চিঠি থেকে জানা গেছে এসব তথ্য।
২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে উত্তরা-উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যাত্রীসেবা শুরু করে মেট্রোরেল। এর এক বছর পর, ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশেও যাতায়াত শুরু করে মেট্রোরেল। ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এমআরটি-লাইন-৬-এ প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ মেট্রোরেলে যাতায়াত করেন।
ডিএমটিসিএল মেট্রোরেল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ হলেও মেট্রোরেল আইন-২০১৫ এবং মেট্রোরেল বিধিমালা-২০১৬ অনুসারে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেলের কর্তৃপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করার বিধান রয়েছে। কর্তৃপক্ষ হিসেবে ডিটিসিএর অন্যতম দায়িত্ব হলো মেট্রোরেলের সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ তদারকি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করা।
মেট্রোরেল লাইন-৬ একটি অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজড কন্ট্রোল ব্যবস্থা সংবলিত রেলওয়ে নেটওয়ার্ক। এর বিভিন্ন সাব-সিস্টেম বা কম্পোনেন্ট যেমন ভায়াডাক্ট, ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম, রোলিং স্টক, সিগন্যালিং সিস্টেম, টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম, অটোমেটিক ফেয়ার কালেকশন সিস্টেম, টিকিট ভেন্ডিং মেশিন, টিকিট অপারেটিং মেশিন, প্যাসেঞ্জার গেট, প্ল্যাটফর্ম স্কিন ডোর, ফায়ার সেফটি সিস্টেম, লিফট ও এসক্যালেটর, ইত্যাদির সমন্বয়ে কাজ করে। এসব দিক বিবেচনায় ডিএমটিসিএলকে একটি ‘সিস্টেম সেফটি সার্টিফিকেট’ নেওয়ার বিধান আইনেই বলা ছিল।
ডিটিসিএর একটি চিঠি থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ২১ আগস্ট বাণিজ্যিক অপারেশন চালুর আগে ডিএসটিসিএলকে চিঠি দিয়ে যাত্রীদের বিমা করার কথা বলা হয়। এ বিষয়ে ২০২৩ সাল থেকে একাধিক চিঠি পাঠানো হলেও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে এখনো ব্যবস্থা নেয়নি।
মেট্রোরেল বিধিমালা-২০১৬ এর বিধি-২৭ অনুসারে ডিএমটিসিএল-কে প্রতি তিন মাস অন্তর নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিবেদন মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু মেট্রোরেল কোম্পানি তা আজ অবধি করেনি।
মেট্রোরেল পরিচালনা ইস্যুতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এনকেডিএম নিরাপত্তা সনদ ইস্যু করতে ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তাদের বারবার তাগাদা দেয়। মেট্রোরেলের এই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি চূড়ান্ত করার আগে কার্যপরিধিতে সুকৌশলে ফাঁক রাখা হয়। ফলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নির্দেশনা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকলেও চূড়ান্ত সনদে তার উল্লেখ রাখা হয়নি।
ডিএমটিসিএলকে নিরাপত্তা সনদ প্রদানে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও তা আর করা হয়নি।
একটি কার্যনির্বাহী বৈঠকের পরিপত্রে জানা যায়, বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা শুরুর আগে ২০২২ সালের ৬ মার্চ ডিএমটিসিএল একটি নিরাপত্তা সনদ ইস্যু করতে ডিটিসিএ বরাবর আবেদন করেছিল। কিন্তু ডিটিসিএ জানায়, মেট্রোরেল আইন-২০১৫ এবং মেট্রোরেল বিধিমালা-২০১৬ অনুযায়ী তারা এ ধরনের সনদ প্রদান করতে পারে না। এ ধরনের কারিগরি সক্ষমতাও নেই ডিটিসিএর।
পরে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটির সুপারিশে এমআরটি লাইন-৬-এ উত্তরা-উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের বিভিন্ন সাব-সিস্টেম পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছিল ডিটিসিএ। কিন্তু তখন ডিএমটিসিলকে কোনো ‘সিস্টেম সেফটি সার্টিফিকেট’ দেয়নি বলে জানান ডিটিসিএ কর্মকর্তারা।
মেট্রোরেল বিধিমালা-২০১৬-এর ২৪ বিধি অনুযায়ী, ডিএমটিসিএলকে মেট্রোরেল নির্মাণ পরিকল্পনা অনুমোদনের জন্য ডিটিসিএতে আবেদন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু উত্তরা-উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬-এর নির্মাণ পরিকল্পনা ডিএমটিসিএল ডিটিসিএ থেকে অনুমোদন করিয়ে নেয়নি। উপরন্তু এ-সংক্রান্ত চিঠিরও কোনো জবাব দেয়নি। মেট্রোরেল আইন অনুযায়ী, এমআরটি লাইন নির্মাণের সার্বিক পরিকল্পনা ও নকশা ডিটিসিএতে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ডিটিসিএ জানিয়েছে, এমআরটি লাইন নির্মাণের আবেদনে পরিকল্পনার কপি পাওয়া যায়নি।
নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এমআরটি লাইন-৬-এর উত্তরা সেন্টার, উত্তরা সাউথ, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশ সচিবালয় স্টেশনগুলোর লে-আউট ড্রয়িং জমা দেয়নি ডিএমটিসিএল।
ডিএমটিসিএলের এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) শিগগির একটি কমিটি গঠন করবে বলে জানান ‘ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) নীলিমা আখতার। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের যে বিষয়গুলো এখন সামনে এসেছে, আমরা সবকিছু ধাপে ধাপে খতিয়ে দেখব।’
ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ যা বলছে
মেট্রোরেলের এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে খবরের কাগজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিকের সঙ্গে। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় তাকে মেট্রোরেলসংক্রান্ত প্রশ্নগুলো পাঠানো হয়। ৯ দিন পর খবরের কাগজের প্রশ্নের উত্তর পাঠায় ডিএমটিসিএলের সিগন্যালিং অ্যান্ড টেলিকম শাখা।
বিমা ছাড়া মেট্রোরেল পরিচালনার বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে ডিএমটিসিএল বলছে, তৃতীয় পক্ষের যাত্রী বিমা করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষাধীন রয়েছে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ‘সিস্টেম সেফটি সার্টিফিকেট’ গ্রহণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা মেট্রোরেল আইন-২০১৫ এর অন্তর্ভুক্ত নয়। ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর ও ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ডিটিসিএ থেকে ‘সিস্টেম সেফটি সার্টিফিকেট’ নিয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমটিসিএল। ডিটিসিএ জানিয়েছে, তারা এমন কিছু দেয়নি।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদিত শর্তসাপেক্ষে ‘ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড’ এখনো বলবৎ আছে বলে দাবি ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষের। তবে ‘ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড’ সহজবোধ্য বাংলা ভাষায় প্রণয়নের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। সেটি এখন ডিটিসিএতে পাঠানো হয়েছে। ডিটিসিএ বলছে, ‘ইমপ্লিমেন্টেশন স্ট্যান্ডার্ড’ ৬ মাস পরপর নবায়ন করতে হয়, সেটি ডিএমটিসিএল করেনি।