কৃষি নিরাপত্তা ও সুরক্ষা আইন উপেক্ষা করে ভেজাল ও অকার্যকর বালাইনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে একদিকে, আশানুরূপ কীটপতঙ্গ মরছে না। অন্যদিকে মাটির ঊর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক।
অভিযোগ উঠেছে, সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে দেশে কৃষি খাতের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বালাইনাশক আমদানি ও সরবরাহে মনোপলি করা হচ্ছে। একইভাবে স্বল্পমূল্যের বালাইনাশক আমদানি করে চালানে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং মিমপেক্স অ্যাগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানির মালিক এম সাইদুজ্জামানের নেতৃত্বেই এ ধরনের অপকর্ম হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি সাবেক কৃষিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনুমোদনহীন বালাইনাশক আমদানি ও সরবরাহ করেছেন। ৯৯০ টাকা দামে ক্ষতিকর ওয়ান্ডার ৫ ডব্লিউডিজি আমদানি করে প্রতি কেজি বিক্রি করেছেন ৫ হাজার ৪০০ টাকায়। এভাবে বাজার থেকে লুটে নিয়েছেন বিপুল অর্থ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবৈধ এই কাজের জন্য জরিমানা আদায়ের নির্দেশ দিলেও তিনি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ অক্টোবর উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন ও মাননিয়ন্ত্রণ) এস এম সোহরাব উদ্দীনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, এ কে এম হাসিবুল হাসান, উপপরিচালক (লিসাসা) প্রশাসন ও অর্থ এবং এস এম আলমগীর শফিউল্লাহ, পেস্টিসাইড রেগুলেশন অফিসার।
কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আজও তদন্তের অগ্রগতি জানা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক এস এম সোহরাব উদ্দীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায় থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করেছি। সম্ভবত ইতোমধ্যে স্যাম্পলের ল্যাবরেটরি টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, গত রবিবার তার বক্তব্য নিয়েছি। বুধবার (১৩ নভেম্বর) তার কারখানা পরিদর্শনে যাবে কমিটি। তদন্ত শেষ করে আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব বলে আশা করছি।
এর আগে সাইদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতিকে লিগাল নোটিশ দিয়েছে আইনি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ‘লিগ্যাল ইরা’।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মিমপেক্স অ্যাগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানির মালিক এম সাইদুজ্জামান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা সবই মিথ্যা। ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং ব্যবসায়ী হিসেবে আমার সুনাম নষ্ট করতেই এসব অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে একটি গোষ্ঠী। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির কাছে গত রবিবার প্রয়োজনীয় বক্তব্য ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পেশ করেছি। মূলত বালাইনাশক উৎপাদনের একই ধরনের সহযোগী উপাদান যা আমার জন্য অননুমোদিত। কিন্তু কারও কারও জন্য তা অনুমোদিত। যে পণ্যটি নিয়ে কথা উঠেছে তা আমদানির জন্য ২০৪টি কোম্পানির অনুমোদন নেই। এই কোম্পানিগুলো ভিন্ন সোর্স থেকে আমদানি করায় ৩৭৬টি কন্টেইনারে আনা পণ্য কাস্টম্স কর্তৃপক্ষ আটকে দেয়। তখন আমরা সবাই সরকার নির্ধারিত জরিমানা পরিশোধ করে পণ্যগুলো বুঝে নিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে জরিমানা পরিশোধ না করার যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তা ছাড়া আমার বিরুদ্ধে নিম্নমানের স্বল্পমূল্যের বালাইনাশক আমদানি ও বাজারে সরবরাহের অভিযোগও ঠিক নয়। যে বালাইনাশক পণ্যকে অকার্যকর ও ক্ষতিকর বলা হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে তা কোনো ক্ষতিকর নয় বরং ফসলের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। ওই সময়ে পণ্যটি আমদানি না করলে দেশের কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতো।’
ভুক্তভোগীরা জানান, রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া ছিলেন মিমপেক্স অ্যাগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানির মালিক এম সাইদুজ্জামান। বিগত সরকারের সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকসহ প্রভাবশালী নেতাদের ঘনিষ্ঠ তিনি।
সাধারণ কর্মচারী থেকে ‘বাংলাদেশ ক্রপস প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হয়েই নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন সাইদুজ্জামান। কৃষিকাজে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য বালাইনাশক আমদানি ও সরবরাহে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তৈরি করেন বাংলাদেশ বালাইনাশক সিন্ডিকেট। প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে বালাইনাশক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করার কথা থাকলেও, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তা অবরুদ্ধ করে রেখেছেন মিমপেক্স অ্যাগ্রোকেমিক্যাল কোম্পানির মালিক।
এ বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতা ও সমস্যা সমাধানে অ্যাগ্রোকেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে দেশীয় বালাইনাশক উৎপাদনকারীদের জন্য কাঁচামাল ও সহযোগী উপাদান আমদানি সহজ করতে সোর্স উন্মুক্ত করার আবেদন জানান। এই সংগঠনের দাবি, সোর্স উন্মুক্ত হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে সুলভে কাঁচামাল ও সহযোগী উপাদান সংগ্রহ করতে পারলে কৃষক উপকৃত হবেন। পাশাপাশি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এর আগে মতামত চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়কে আইন মন্ত্রণালয় জানায়, বালাইনাশক রেজিস্ট্রেশন সনদে রেজিস্টার্ড বালাইনাশকের উৎপাদনকারী সোর্স উন্মুক্ত অথবা প্রতিটি উৎপাদনকারী দেশের ন্যূনতম পাঁচটি সোর্স কোম্পানির নাম উল্লেখ থাকবে। এভাবে বিধিমালা সংশোধন করে চূড়ান্ত করা যেতে পারে। তবে এখনো বালাইনাশক উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে জটিলতা নিরসন না হওয়ায় এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে গত মাসে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে ২২টি বালাইনাশক কোম্পানি দেশেই তাদের কারখানায় কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য উৎপাদন করছে। এখানেও পণ্য সংগ্রহের উন্মুক্ত সোর্সগুলো অবরুদ্ধ করে দেওয়ায় উৎপাদনকারীরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। অথচ বিদ্যমান আইনে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে বিদেশ থেকে পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে।
এদিকে অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান কীটনাশক আমদানি করায় হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। ইতোমধ্যে রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে কৃষি, পরিবেশ, বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তদন্ত শেষে আগামী বছর ৪ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।