দ্বিতীয় পর্ব...
দ্বিপক্ষীয় সিরিজে বাংলাদেশের বলার মতো সাফল্য হলো ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর ঘরের মাঠে পরপর তিনটি সিরিজে পাকিস্তান (৩-০), ভারত (২-১ ও দক্ষিণ আফ্রিকার (২-১) বিপক্ষে সিরিজ জয়। এর আগে ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে বাংলাওয়াশ (৪-০) করা। এ ছাড়াও আফগানিস্তান, নিউজিল্যান্ড, উইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একাধিকবার জিতেছে সিরিজ। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে দুবার। কিন্তু ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো সিরিজই জিততে পারেনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একাধিকবার ম্যাচ জিতলেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০০৫ সালে কার্ডিফে প্রথম জয়ের পর আর কোনো মাচ জিততে পারেনি। এই হলো ওয়ানডে ক্রিকেটের অবস্থা।
টেস্টের অবস্থা আরও বাজে। ২০০০ সালে টেস্ট পরিবারের সদস্য হওয়ার পর জিম্বাবুয়ে ও উইন্ডিজ ছাড়া আর কোনো দেশের বিপক্ষে সিরিজ জিততে পারেনি। আফগানিস্তানের মতো টেস্ট পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্যের কাছেও হারের নোনা স্বাদ নিতে হয়েছে। পরে আবার জিতেছিল। টেস্টে মাঝে মাঝে পাওয়া জয় থেকে একবার করে হারাতে পেরেছিল অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাকে। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে দুবার। জয় অধরাই থেকে গেছে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এই জয়গুলোর মাঝে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া জয়কে বেশ বড় করে দেখা হয়েছে। টেস্ট ক্রিকেটে পথ চলার দুই যুগে ম্যাচ খেলেছে ১৪২টি। সেখানে জয় মাত্র ১৯টি। যার ৮টিই অপেক্ষাকৃত দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। একসময়ের দুর্ধর্ষ উইন্ডিজের আগের সেই শক্তি আর নেই। এখন নখ-দন্তহীন বাঘ। তাদের বিপক্ষে জয় আছে ৪টি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একমাত্র জয় এসেছে নিজেদের শততম টেস্টে। হেরেছে ১০৯টিতে। ড্র করতে পেরেছে ১৮টিতে। টেস্ট ক্রিকেটে এখনো ধুঁকছে বাংলাদেশ।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে জয় দিয়ে শুরু করলেও সংক্ষিপ্ত এই ফরম্যাটে দলের অবস্থা সবচেয়ে বেশি কাহিল। ১৭৬ ম্যাচ খেলে জয় মাত্র ৬৮ ম্যাচে। এই ফরম্যাটের সেরা সাফল্য বলা যায় ইংল্যান্ডকে ৩ ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করা। এ ছাড়া ঘরের মাঠে উইকেটের সুবিধা নিয়ে অস্ট্রেলিয়া (৪-১) ও নিউজিল্যান্ডের (৩-২) বিপক্ষেও সিরিজ জয় আছে।
দল হিসেবে বাংলাদেশ যেমন এখন পর্যন্ত দেশবাসীকে বলার মতো কোনো শিরোপা এনে দিতে পারেনি, তেমনি সাকিব ছাড়া বাকি খেলোয়াড়রাও ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দিয়ে নিজেদের বিশ্ব দরবারে সেভাবে আলোচিত করতে পারেননি। সাকিব যদিও বেশ কয়েকবার আইসিসির অলরাউন্ডার র্যাঙ্কিয়ে সেরা ছিলেন, এমন কি তিন ফরম্যাটেও একসঙ্গে শীর্ষে ছিলেন, এই যা। ব্যাটিংয়ে যেমন আহামরি তেমন কিছু করতে পারেনি, তেমনি বোলিংয়েও। কিন্তু দুটি মিলিয়ে তিনি নিজেকে নাম্বার ওয়ানে নিয়ে যান। আর তা নিয়েই দেশবাসী হয়েছেন আনন্দে আত্মহারা। সাকিব ডুকে গেছেন তাদের অন্তরে। বেড়েছে সাকিবের ব্র্যান্ড ভেল্যু। যে কারণে তিনি বিভিন্ন দেশের ফ্রাঞ্চাইজি লিগ যেমন খেলেছেন, তেমনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরও হয়েছেন। ফুলেফেঁপে উঠেছে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টও।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে পঞ্চপাণ্ডবের চার পাণ্ডব তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ কাছাকাছি সময়ে ২০০৫ সাল থেকে ২০০৭ সালের মাঝে জাতীয় দলের হয়ে খেলা শুরু করেন। সবার আগে শুরু করেন মাশরাফি ২০০১ সালে। কিন্তু এরা কেউই লিজেন্ডারি হতে পারেননি। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকায় প্রথম ৮০ জনেও নেই বাংলাদেশের কোনো ব্যাটার। বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান ৮৮ ম্যাচ খেলে মুশফিকুর রহিমের ৫৬৭৬। সেঞ্চুরি ১০টি। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান শচীন টেন্ডুলকারের। ২০০ টেস্ট খেলে রান করেছেন ১৫৯২১। সেঞ্চুরি ৫১টি। কিন্তু মুশফিকের চেয়ে ২/৩টা টেস্ট কম-বেশি খেলা ব্যাটারদের রানও তার চেয়ে অনেক বেশি। ৯০ টেস্ট খেলে পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফের রান ৭৫৩০, সেঞ্চুরি ২৬টি। আবার মুশফিকের চেয়ে ৩ টেস্ট কম খেলে ২২ সেঞ্চুরিতে ইংল্যান্ডের ওয়ালি হ্যামন্ডের রান ৭২৪৯। অস্ট্রেলিয়ার গ্রেগ চ্যাপেল ৮৭ টেস্ট খেলে ২৪টি সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ৭১১০। এরা সবাই মুশফিকের অনেক আগের ক্রিকেটারের এবং লিজেন্ডারি। কিন্তু মুশফিকের এক বছর পর ইংল্যান্ডের অ্যালিস্টার কুক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরু করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনেক উপরে। ২০১৮ সালে অবসর নেওয়ার আগে তিনি ১৬১ টেস্ট খেলে ১২৪৭২ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকায় পাঁচে নিয়ে গেছেন তার নাম। নামের পাশে সেঞ্চুরি ৩৩টি। ভারতের বিরাট কোহলির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথ চলা শুরু হয় ২০১১ সালে। তিনি এখন বিশ্বের সেরা ব্যাটারদের একজন। ১১৩ টেস্ট খেলে রান করেছেন ৮৮৪৮। সেঞ্চুরি করেছেন ২৯টি।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান তামিম ইকবালের। ২৪৩ ম্যাচ খেলে তিনি রান করেছেন ৮৩৫৭, সেঞ্চুরি ১৪টি। টেস্ট ক্রিকেটের মতো এই ফরম্যাটেও সর্বোচ্চ রান শচীন টেন্ডুলকারের। ৪৬৩ ম্যাচ খেলে রান করেছেন ১৮৪২৩। সেঞ্চুরি ৪৯টি। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো বিরাট কোহলির অবস্থান। তামিম ইকবালের ৪ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া বিরাট কোহলি ২৯২ ম্যাচ খেলে ১৩৮৪৮ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকার তিনে অবস্থান করছেন। রানের দিকে না হলেও সেঞ্চুরিতে ছাড়িয়ে গেছেন টেন্ডুলকারকে। কোহলির সেঞ্চুরি ৫০টি। শচীনের ৪৯টি। তামিমের অভিষেকের বছরই যাত্রা শুরু হয়েছিল ভারতের রোহিত শর্মার। তিনিও ছাড়িয়ে গেছেন তামিম ইকবালকে। ২৬২ ম্যাচ খেলে ৩১ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ১০৭০৯। ছক্কা হাঁকিয়েছেন ৩২৩টি। উইন্ডিজের ক্রিস গেইলের সর্বোচ্চ ৩৩১টির পরই রোহিতের অবস্থান। সেখানে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ছক্কা তামিম ইকবালের ১০৩টি।
টি-টোয়েন্টিতে রোহিত শর্মা ১৫৯ ম্যাচ খেলে ৪২৩১ রান করে সবার উপরে আছেন। দুইয়ে থাকা বিরাট কোহলির রান ১২৫ ম্যাচ খেলে ৪১৮৮ রান। বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান সাকিব আল হাসানের। ১২৯ ম্যাচ খেলে রান করেছেন ২৫৫১। কিন্তু সম্মিলিতভাবে তার অবস্থান ৩৫তম। তার নামের পাশে নেই কোনো সেঞ্চুরি। বিরাট কোহলির আছে একটি। তবে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি সেঞ্চুরি রোহিত শর্মার।
বিশ্ব ক্রিকেট দলগত কিংবা ব্যক্তিগত কোনো রেকর্ডেও নেই বাংলাদেশের নাম। টেস্ট ক্রিকেটে দলগত সর্বোচ্চ রান শ্রীলঙ্কার ৬ উইকেটে ৯৫২ (ডি.)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ইংল্যান্ডের ৯০৩ (ডি.)। সেখানে বাংলাদেশের দলগত সর্বোচ্চ রান ৬৩৮। সর্বোচ্চ ৫০টির মধ্যেও নেই এই রান। ওয়ানডেতে দলগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ইংল্যান্ডের ৪ উইকেটে ৪৯৮। এ রকম চার শতাধিক রানের ইনিংস আছে আরও ২৭টি। সেখানে বাংলাদেশের দলগত সর্বোচ্চ ৬ উইকেটে ৩৪৯ রান। প্রথম ১০০টির মাঝেও নেই বাংলাদেশের সংগ্রহ। টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ রান নেপালের ৩ উইকেটে ৩১৪ রান। সেখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান ৫ উইকেটে ২১৫। বাংলাদেশের এই সংগ্রহও প্রথম ১০০টির মাঝে নেই।
টেস্ট ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস উইন্ডিজের ব্রায়ান লারার অপরাজিত ৪০০। শুধু তিন শতাধিক রানের ইনিংসই আছে ৩১টি। সেখানে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস মুশফিকুর রহিমের অপরাজিত ২১৯। বাংলাদেশের হয়ে মোট ডাবল সেঞ্চুরি মাত্র ৫টি, সেখানে সর্বকালের সেরা ব্যাটার স্যার ডন ব্রাডম্যান একাই করেছেন ১২টি। ব্রাডম্যানের সঙ্গে কারও তুলনা করা চলে না। তার কথা বাদ দিলেও শ্রীলঙ্কার কুমার সাঙ্গাকারারই ডাবল সেঞ্চুরি আছে ১১টি। এ ছাড়া ব্রায়ান লারার ৯টি, ওয়ালি হ্যামন্ড, বিরাট কোহলি, মাহেলা জয়াবর্ধনে ৭টি করে ডাবল সেঞ্চুরি আছে। সেখানে বাংলাদেশের মুশফিকুর রহিমের ডাবল সেঞ্চুরি ৩টি।
ওয়ানডে ক্রিকেট বাংলাদেশের হয়ে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস লিটন কুমার দাসের ১৭৬। সেখানে বিশ্ব ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ভারতের রোহিত শর্মার ২৬৪। এই দুই শতাধিক রানের ইনিংস আছে ১২টি। যার ৩টি আবার এসেছে রোহিত শর্মার ব্যাট থেকে। আর কারও একাধিক নেই। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে সেঞ্চুরি হয়েছে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি। সেটি এসেছে তামিম ইকবালের ব্যাট থেকে। ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে ওমানের বিপক্ষে অপরাজিত ১০৩ রান। তার উপরে আছেন ৯৮ জন। ১৭২ রানের ইনিংস খেলে সর্বোচ্চ রানের মালিক অস্ট্রেলিয়ার অ্যারন ফিঞ্চ।
বোলিংয়ে টেস্ট ও ওয়ানডেতে একই অবস্থা বিরাজমান। ১৩৩ টেস্ট খেলে ৮০০ উইকেট নিয়ে মুরালিধরন নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছেন। মুরালিধরনের চেয়ে অনেক পেছনে থেকে বাংলাদেশের হয়ে সেরা বোলার সাকিব আল হাসানের উইকেট ৬৭ টেস্টে ২৩৭টি। অবস্থান ৫৯তম। ওয়ানডে ক্রিকেটেও শ্রীলঙ্কার মুরালিধরন ৩৫০ ম্যাচে ৫৩৪ উইকেট নিয়ে যেখানে চূড়ায় অবস্থান করছেন, সেখানে বাংলাদেশের সেরা বোলার সাকিব আল হাসানের ২৪৭ ম্যাচে উইকেট ৩১৭টি। তার অবস্থান দ্বাদশ। টি-টোয়েন্টিতে অবশ্য বাংলাদেশের বোলারদের অবস্থান বেশ ভালো। ১২৯ ম্যাচ খেলে ১৪৯ উইকেট নিয়ে সাকিব আল হাসান অবস্থান করছেন তিনে। সবার উপরে থাকা নিউজিল্যান্ডের টিম সাউদির উইকেট ১৬৪টি। তিনি ম্যাচ খেলেছেন ১২৬টি দুইয়ে আছেন আফগানিস্তানের রশিদ খান। ৯৩ ম্যাচে তার উইকেট ১৫২টি।
ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যত আবেগ তা কিন্তু মূল জাতীয় দল নিয়েই। বয়সভিত্তিক দল বা নারী দল নিয়ে তাদের আবেগের মাত্রা কম। যে কারণে এই সব দলের সাফল্য তাদের হৃদয়ে খুব একটা দোলা দেয় না। কিন্তু মূল জাতীয় দল দেশবাসীকে এখন পর্যন্ত আইসিসি বা এসিসির কোনো শিরোপা উপহার দিতে না পারলেও এই দলগুলোই কিন্তু দেশবাসীকে আইসিসির সর্বোচ্চ শিরোপা যেমন এনে দিয়েছে, তেমনি এশিয়া কাপও জিতেছে। ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছিল আকবর আলীর নেতৃত্বে। আবার ২০২৩ সালে এসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপও জিতেছিল বাংলাদেশের যুবারা। এদিকে মেয়েরা ২০১৮ সালে জিতেছিল টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপ।
এভাবেই বাংলাদেশের আবেগের ক্রিকেট হতাশার গল্প লিখে চলেছে!
প্রথম পর্ব