চীনা নতুন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বেটাভোল্ট সর্ব সাধারণের ব্যবহার উপযোগী পারমাণবিক শক্তির ব্যাটারি উদ্ভাবন করেছে। পারমাণবিক শক্তির এই ব্যাটারি মডেল ‘বিভি১০০’। বেইজিংভিত্তিক কোম্পানিটি দাবি করেছে, পারমাণবিক শক্তির এই ব্যাটারি কোনো পরিবর্তন ছাড়া একইভাবে নিজেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। এতে ৫০ বছর কোনো ধরনের চার্জিং বা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন লাগবে না। অর্থাৎ এই ব্যাটারি চার্জিং বা রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া একটানা ৫০ বছর ব্যবহার করা যাবে। এই যুগান্তকারী উদ্ভাবন এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে আছে। তবে বাজারজাত করা জন্য এটি ব্যাপক উৎপাদন করা হবে।
এই ব্যাটারিগুলো মহাকাশ, এআই ডিভাইস, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এমইএমএস সিস্টেম, উন্নত সেন্সর, ছোট ড্রোন ও মাইক্রো রোবটের মতো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের চাহিদা মেটাতে পারবে। আশা করা যাচ্ছে, এই নতুন শক্তির উদ্ভাবন চীনকে এআই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করবে।
বেটাভোল্ট নিউ এনার্জি টেকনোলজি
কোম্পানিটি গত 8 জানুয়ারি সফলভাবে এই ক্ষুদ্রাকৃতির পারমাণবিক শক্তির ব্যাটারি তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। যাতে ব্যবহার করা হয়েছে, নিকেল-৬৩ আইসোটোপ এবং চতুর্থ প্রজন্মের হিরার সেমিকন্ডাক্টর উপাদান। কোম্পানিটি এই ব্যাটারির মডুলারাইজেশন ও কম খরচে সবার ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে। চীন একই সঙ্গে পারমাণবিক শক্তির ব্যাটারি ও চতুর্থ প্রজন্মের হিরার সেমিকন্ডাক্টরের মতো দুটি উচ্চ প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে। যা ইউরোপীয় ও আমেরিকান বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রম থেকে রেখেছে।
এ ধরনের ব্যাটারি পারমাণবিক শক্তির ব্যাটারি, পারমাণবিক ব্যাটারি বা রেডিও আইসোটোপ ব্যাটারি নামেও পরিচিত। যা পারমাণবিক আইসোটোপের ক্ষয় থেকে উৎপন্ন শক্তিকে ব্যবহার ও অর্ধ পরিবাহীর রূপান্তরকারীর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তর করার নীতিতে কাজ করে।
১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) এই উচ্চ প্রযুক্তির পারমাণবিক ব্যাটারি বানিয়েছিল। তা বেটাভোল্টের থেকে বেশ ভিন্ন ধাঁচের ছিল। বর্তমানে মহাকাশে শুধু থার্মোনিউক্লিয়ার ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের ব্যাটারি ব্যয়বহুল, আকারে বড় ও বেশি ওজনের হয়। এর অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাও উচ্চ হয়ে থাকে। যা সাধারণ কোনো কাজে ব্যবহার করা যায় না। সাম্প্রতিক সময়ে পারমাণবিক ব্যাটারির ক্ষুদ্রকরণ, মডুলারাইজেশন এবং সাধারণ কাজের ব্যবহারে ইউরোপীয় ও আমেরিকান দেশগুলো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিটাভোল্ট পারমাণবিক ব্যাটারির সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রযুক্তিগত পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছে। তেজস্ক্রিয় উৎস নিকেল-৬৩ থেকে নির্গত বিটা কণা (ইলেকট্রন) অর্ধ পরিবাহিতে প্রবাহের মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি করে। এটির জন্য বেটাভোল্টের বিজ্ঞানীরা একটি অনন্য একক-ক্রিস্টাল প্রযুক্তিতে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করেছে। এই সেমিকন্ডাক্টর মাত্র ১০ মাইক্রন পুরু। যাতে দুটি হীরার সেমিকন্ডাক্টরের মাঝে একটি দুই মাইক্রন পুরু নিকেল– ৬৩ পাতলা শিট রাখা হয়েছে।
বেটাভোল্টের চেয়ারম্যান ও সিইও ঝাং ওয়েই বলেছেন, কোম্পানিটি প্রথমে বিভি১০০ মডেলের পণ্য চালু করবে। যা বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক ব্যাটারি ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হবে। ৩ ভোল্টের এ ব্যাটারি ১০০ মাইক্রোওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে। ঘন আকারে এটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ১৫ মিলিমিটার এবং পুরুত্ব পাঁচ মিলিমিটার, যা একটি মুদ্রার চেয়ে ছোট।
এই ব্যাটারি প্রতি মিনিটে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। এটি প্রতিদিন মোট ৮.৬৪ জুল ও বছরে ৩ হাজার ১৫৩ জুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। বেশি শক্তির জন্য এই ধরনের একাধিক ব্যাটারি সিরিজ এবং সমান্তরালভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কোম্পানিটি ২০২৫ সাল নাগাদ ১ ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাটারি তৈরির করার পরিকল্পনা করেছে। যদি এটি বাজারে আসে তাহলে ফোনে আর চার্জ দিতে হবে না এমনকি ড্রোনগুলো অবিরাম আকাশে উড়তে পারবে।
প্রতিষ্ঠানটি তথ্য মতে, এটি ইলেকট্রোকেমিক্যাল ব্যাটারি নয়। এর শক্তির ঘনত্ব টারনারি লিথিয়াম ব্যাটারির চেয়ে ১০ গুণ বেশি হবে। এটির একটি এক গ্রামের ব্যাটারি ৩ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ সঞ্চয় করতে পারে। যেকোনো ধরনের আঘাতে বা বন্দুকের গুলিতেও ব্যাটারিতে বিস্ফোরণ বা আগুন ধরবে না। এটির বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থিতিশীল, জটিল পরিবেশ বা লোডের কারণে তা পরিবর্তন হবে না। এটি সাধারণত মাইনাস ৬০ ডিগ্রি থেকে ১২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সচল থাকবে।
বেটাভোল্টের দাবি, তাদের তৈরি পারমাণবিক শক্তির ব্যাটারি সম্পূর্ণ নিরাপদ। এতে কোনো বাহ্যিক বিকিরণ নেই। এটি মানবদেহে পেসমেকার, কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড ও কক্লিয়াসের মতো চিকিৎসার ডিভাইসে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত। এটি পরিবেশের জন্য ঝুঁকিমুক্ত। এর আয়ুষ্কাল শেষ হলে, তেজস্ক্রিয় উৎস হিসেবে নিকেল-৬৩ আইসোটোপ একটি স্থিতিশীল তামার আইসোটোপে পরিণত হয়। যা তেজস্ক্রিয় নয় এবং পরিবেশের জন্য কোনো হুমকি বা দূষণ সৃষ্টি করবে না।
বর্তমানে বেটাভোল্ট বেইজিংয়ে একটি পেটেন্ট নিবন্ধন করেছে। খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বব্যাপী পিটিসি পেটেন্ট নিবন্ধন করতে শুরু করবে। ২০২৩ সালে চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার করপোরেশন আয়োজিত উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতায় বেটাভোল্ট তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিল।
বেটাভোল্ট চীনের পেশাদার পারমাণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। যেন ২ থেকে ৩০ বছর ব্যবহারযোগ্য ও উচ্চ শক্তির পারমাণবিক ব্যাটারির বিকাশ করা যায়। এর জন্য স্ট্রন্টিয়াম-৯০, প্রোমিথিয়াম-১৪৭ এবং ডিউটেরিয়ামের মতো আইসোটোপ ব্যবহার করার বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
ঝাং ওয়েই বলেছেন, বিটাভোল্ট বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র কোম্পানি যেটি বড় আকারের হীরার সেমিকন্ডাক্টর উপকরণ তৈরি করতে পারে। এটি শুধু একটি নতুন শক্তি কোম্পানি নয়, এটি একটি চতুর্থ প্রজন্মের সেমিকন্ডাক্টর ও অতি দীর্ঘ কার্বন ন্যানোটিউব উপাদান তৈরির কোম্পানি।
কোম্পানিটি পারমাণবিক ব্যাটারি, ডায়মন্ড সেমিকন্ডাক্টর এবং সুপার ক্যাপাসিটরের মতো তিনটি প্রধান প্রযুক্তি ও উপকরণ সংযুক্ত এবং একীভূত করেছে। এর মাধ্যমে বিটাভোল্টের মূল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে।
জাহ্নবী