![বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফি-দরবেশদের ভূমিকা](uploads/2023/10/20/1697772939.sufibad.jpg)
এই বঙ্গজমিন ও উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসারে পীর-দরবেশ, সুফি-সাধক, আলেম-ওয়ায়েজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, খানকা-দরবারের পৃষ্ঠপোষকতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপালনে রাজা-বাদশাহদের অবদানের কথাও অস্বীকার করা যাবে না। তবে ইসলামের একচ্ছত্র প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োজিত ছিলেন পীর-দরবেশ, সুফি-সাধক-আলেমরাই।
এ অঞ্চলে যেসব সুফি-দরবেশ ইসলাম প্রচার করেছেন তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন সোনার মানুষ। ৩৬০ অলি-আউলিয়ার ভূমিখ্যাত এ বাংলাদেশে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.), খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.), খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (রহ.), হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি (রহ.), হজরত খান জাহান আলী (রহ.), হজরত শাহ্ পরান (রহ.), হজরত শাহ কারামত আলী জৌনপুরী (রহ.), হজরত শাহ আলী (রহ.), হজরত মখদুম শাহদৌলা (রহ.), হজরত সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক (রহ.), হজরত শাহ সুফি নেছারুদ্দীন (রহ.), হজরত খাজা ইউনুস আলী এনায়েতপুরী (রহ.)-সহ বহু পীর-দরবেশ, সুফি-সাধকের আগমন ঘটেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শে গড়া ছিল তাদের বহুমাত্রিক জীবন। তাদের কথা, কাজ, আচার-আচরণ ছিল শতভাগ সচ্চরিত্রের আভরণে মোড়া। রাতে তারা তাহাজ্জুদে নিমগ্ন হতেন, জিকিরে লীন হতেন এবং দিনেরবেলায় দাওয়াতের আহ্বান নিয়ে ছুটে যেতেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। নিপীড়িত মানুষ আর ধর্মের প্রয়োজনে তারাই প্রতিহত করতেন ধেয়ে আসা সব আঘাতকে। সমাজে যখন কোনও দুর্যোগ বা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, এই ইসলাম প্রচারক সুফিরাই এগিয়ে এসেছেন সবার আগে। ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি সমস্যা ও সংস্কৃতিতে মানুষের সঙ্গে ঐকতানে কাজ করেছেন তারা। এভাবেই বিজয় এসেছে এ বঙ্গজমিনে; প্রচার ঘটেছে ইসলামের।
হাজার বছর আগে দরবেশদের হাত ধরে এ বঙ্গদেশে ইসলামের প্রচার ঘটেছে। ইসলামের সৌন্দর্য আর দরবেশদের ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে অসংখ্য মানুষ দীক্ষিত হয়েছেন ইসলামে। এ অঞ্চলে ধর্ম গ্রহণ ও পরিপালনে মানুষের চাহিদা বুঝে কাজ করেছেন পূর্ববর্তী ধর্মপ্রচারক দরবেশরা। শত-সহস্র বছর ধরে মানুষের ধর্মবিশ্বাস, তাদের সামাজিক প্রবণতা, কীভাবে তারা ধর্মপালন করছে, কীভাবে তারা ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়, কাদের তারা ধর্মীয়ভাবে মহামান্য হিসেবে গ্রহণ করে—এসব বিষয় মাথায় রেখে দাওয়াতি মেজাজ নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে গিয়েছিলেন শাহ জালাল, শাহ মখদুম, আবু তাওয়ামা এবং মানুষ তাদের গ্রহণও করেছে আপন ভেবে। দলে দলে অনুসারী তৈরি হয়েছে অল্প সময়ে। এজন্য এ বঙ্গদেশের মুসলিমদের জন্য কন্সটান্টিনোপল বিজয়ের ইতিহাসের জানার চেয়ে দরবেশ শাহ জালালের সিলেট বিজয়ের ইতিহাস জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুলতান আরতুগরুল আর সুলতান নুরুদ্দিন জানকির চেয়ে ঈসা খাঁ, নিসার আলী তিতুমীরের সংগ্রাম বেশি প্রভাবক। ইবনে তাইমিয়ার চেয়ে হাজী শরীয়তুল্লাহ আর মুনশী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহর সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস জানা বেশি প্রয়োজন।
আজ বাংলাদেশ ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশ, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। লাখো মসজিদ থেকে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান প্রচারিত হয়। প্রতি ওয়াক্তে কোটি মানুষ সেজদায় অবনত হচ্ছে আল্লাহর কুদরতি পায়ে। এ কাদের অবদান? এ সেই দরবেশদের অবদান। সুফি-সাধকদের শেষ রাতের কান্নার ফলাফল। জীবনের সোনালি অধ্যায় দিয়ে এ দেশে ইসলামের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে গেছেন তারা। আজ জান্নাতে তারা সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাচ্ছেন। প্রতিজন দরবেশ-ধর্মপ্রচারক তাদের আত্মত্যাগের নজরানা দিয়ে আমাদের জন্য এই সুজলা-সুফলা ভূমিকে আবাদ করে দিয়ে গেছেন।
কখনও চিন্তা করেছেন, মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি ভূখণ্ড, সেখানে ইসলাম টেকসই ধর্ম হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নিল। এ কাদের অবদান? এ হিসাব যখন সামনের রাখবেন তখন বুঝে আসবে, সহস্র বছর ধরে সুফি-দরবেশরা এ অঞ্চলে কালেমার দাওয়াত দিয়েছেন, মানুষের মধ্যে সাম্য আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন, তাদের সেসব আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। হাজার বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা তাদের প্রতিটি উদ্যোগ এই দেশে ইসলামকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে। এ কোনো সাধারণ অর্জন নয়। আমাদের ধর্মীয় জীবনে এ এক অমর অধ্যায়।
লেখক : চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ