ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে খুলনার উপকূলীয় কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার ৩৬টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে যায়। এ ছাড়া ৩৫টি পয়েন্টে বাঁধ উপচে লবণপানি লোকালয়ে ঢোকে। মোট ৭১টি পয়েন্টে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপরও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কোনো কর্মকাণ্ড না থাকায় স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত শুরু করেন। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে গত চার দিন ধরে তারা বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন।
কিন্তু হঠাৎ পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবি করছে, বাঁধের জরুরি মেরামত কাজ তাদের তত্ত্বাবধায়নেই করা হচ্ছে! বাঁধ মেরামতের প্রয়োজনীয় উপকরণ বাঁশ, সিনথেটিক বস্তা দিয়ে তারাই সহায়তা করছেন। এমনকি শ্রমিকদের মজুরি পর্যন্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বাঁধ মেরামতের এই টাকা কীভাবে, কোথায় ব্যয় করা হচ্ছে। এই টাকা কারা নেবেন? এর আগেও বিভিন্ন ঝড়ে বাঁধ ভেঙেছে। তখনো এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামত করেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তখনো কাউকে মজুরি দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দুজন জনপ্রতিনিধি নিশ্চিত করেছেন, বাঁধ মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো সহায়তা করেনি। একটি টাকাও তারা খরচ করেনি। খোদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ দাবি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
পাইকগাছার সোলাদানা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম এনামুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত চার দিন ধরে দক্ষিণ কাইনমুখি, হরিকাঠি, হাজতের ভিটা, সোলাদানা বাজার, বয়ারঝাপা আবাসন ও দেলুটি ইউনিয়নের কালিনগরে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। এর মধ্যে সোলাদানা মাধ্যমিক স্কুলের পাশে বাঁধ মেরামত কাজে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কিছু বস্তা দিয়েছিল। কিন্তু কোথাও পানি উন্নয়ন বোর্ড এক মুঠো চিড়া বা কোনো অর্থ সহায়তা দেয়নি। কোনো শ্রমিককে টাকা দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘খাতা-কলমে জরুরি বাঁধ মেরামতের নামে তারা (পাউবো) সরকারি টাকা নয়ছয় করছে। তারা কোনো জায়গায় এখন পর্যন্ত এক টাকা ব্যয় করেছে বলে আমি শুনিনি।’
কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বাঁধ না ভাঙা পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্ব দেয় না। বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে জোয়ার-ভাটার পানি আসা-যাওয়া করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড চরম উদাসীনতা দেখিয়েছে।’
তবে পাউবোর বিভাগীয় উপসহকারী প্রকৌশলী জসিম উদ্দিনের দাবি, ‘সার্বক্ষণিক বাঁধ তদারকি করা হচ্ছে। বাঁধ মেরামতের সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়েছে। শ্রমিকের মজুরিও পরিশোধ করা হবে।’
পাউবো কয়রার উপসহকারী (এসও) প্রকৌশলী সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘কয়রার বিভিন্ন জায়গায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বাঁধ মেরামতের কাজ হয়েছে। সব কাজে জরুরি ভিত্তিতে স্থানীয়দের সাপোর্ট নেওয়া হয়। সবক্ষেত্রেই লজিস্টিক সাপোর্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড দিয়েছে।’
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম তারিক-উজ-জামান বলেন, ‘বাঁধ রক্ষার দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। কোনো কোনো কর্মকর্তা বলছেন বাঁধ মেরামতে তাদের বাজেট নেই। এটা হতে পারে না। এখন পর্যন্ত স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে সব জায়গায় বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড কীভাবে এখানে সহায়তার দাবি করেছে তা জানি না।’
এবার ভেসে গেছে দশালিয়া বাঁধ
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে কয়রার দশহালিয়ায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতে স্থানীয়রা দুই দিন ধরে কাজ করছিলেন। ভেঙে যাওয়া বাঁধের দুটি জায়গাকে ঘিরে বাঁশ, মাটির বস্তা দিয়ে রিং বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে। কিন্তু পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ ও বালিভর্তি বড় টিউব না থাকায় ওই জায়গাগুলো তুলনামূলক দুর্বল থেকে যায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে জোয়ারে আবারও ওই বাঁধ ভেঙে লবণপানি ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের দাবি, তাদের কাছে বাঁধের ভাঙন ঢেকানোর মতো বড় টিউব ছিল। কিন্তু বালু সরবরাহ করার জন্য সময়মতো ভলগেট (জাহাজ) না পাওয়ায় সেখানে বালুভর্তি টিউব ফেলা যায়নি। তাই দুর্বল বাঁধ জোয়ারের পানিতে আবারও ভেঙে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যখন সব দোষ ভলগেটের ওপর চাপিয়েছে তখন সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি নিজ উদ্যোগে ১০০ জনকে স্বেচ্ছায় বাঁধ মেরামতের জন্য নিয়ে এসেছিলাম। পাউবোর পক্ষ থেকে তাদের কাউকে একটি পয়সাও দেওয়া হয়নি।’