বছরের পর বছর অযত্ন আর অবহেলায় পচন ধরেছে রেলওয়ের স্লিপারে। কোথাও কোথাও নাট-বোল্টের অস্তিত্ব নেই। বেহাল অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতুগুলোতেও। কোনো রকমে ক্লিপ দিয়ে স্লিপারের সঙ্গে রেললাইন আটকে রাখা হয়েছে।
চলমান তীব্র দাবদাহে এসব রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ময়মনসিংহ রেলওয়ে জোনের বেশির ভাগ অংশের এখন এ অবস্থা। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, রেললাইন বেঁকে যাওয়া রোধে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহের মধ্যে ময়মনসিংহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ছাড়াও প্রকৃতি ও জড়বস্তুতেও এর প্রভাব পড়ছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ থেকে শ্রীপুর, বিদ্যাগঞ্জ, মোহনগঞ্জ, আঠারোবাড়ী, জারিয়া জাঞ্জাইল ও ভৈরব রেলপথের ব্যাপ্তি মোট ২০২ কিলোমিটার। এর পুরো অংশ ময়মনসিংহের রেলওয়ে জোনের আওতায়। সাধারণত তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। কিন্তু অন্যান্য বস্তুর চেয়ে লোহা অনেক বেশি তাপ পরিবহন করে। যেমন তাপমাত্রা যদি ৩০-৩৫ ডিগ্রি থাকে, রেললাইনের পাতে সেটা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। এ জন্য প্রচণ্ড তাপে রেললাইন বেঁকে গিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য লাইনে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে।
সরেজমিনে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর নির্মিত শতবর্ষী প্রাচীন রেলসেতু, শম্ভুগঞ্জ স্টেশনের কাছে কোরেরপাড় সেতুসহ শম্ভুগঞ্জ স্টেশন এলাকার রেললাইন ঘুরে দেখা যায়, অনেক কাঠের স্লিপারে হুক বোল্ট নেই। পুরোনো কাঠের স্লিপারগুলো পচে নষ্ট হয়ে গেছে। লাইনের নিরাপত্তায় দেওয়া পাথর অনেকাংশেই কম। এর মধ্যে তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়েছে। এমন সময় রেললাইন বেঁকে গেলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
জয়নাল আবেদীন নামে স্থানীয় এক প্রবীণ খবরের কাগজকে বলেন, দীর্ঘ বছরেও কাঠের স্লিপার পাল্টানো হয় না। রেলসেতু ছাড়া মাটির ওপর দিয়ে চলা রেললাইনগুলোর অনেক জায়গায় পর্যাপ্ত পাথর নেই। ফলে ট্রেন এলে লাইন কাঁপতে থাকে। এ অবস্থায় অসহনীয় তাপমাত্রায় রেললাইন বেঁকে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
রবিউল ইসলাম নামে আরেকজন বলেন, ময়মনসিংহ নগরীর রেললাইনে কংক্রিটের পাশাপাশি কাঠের স্লিপার রয়েছে। মাদকসেবীরা টাকার জন্য কাঠের স্লিপার থেকে মাঝেমধ্যেই হুক বোল্ট খুলে নেয়। এগুলো তদারকি করা দরকার।
জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঝেমধ্যেই রেললাইন বেঁকে যায়। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। আমি মনে করি, এই গরমে ময়মনসিংহের রেললাইন দিয়ে চলাচল করা যাত্রীদের ঝুঁকি বেড়েছে। ব্রিটিশ আমলে এই রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে। এরপর থেকে সামান্য মেরামত ছাড়া বড় ধরনের কোনো মেরামতের উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েনি।’
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি স্লিপারের দুই পাশে কমপক্ষে আটটি করে ক্লিপ থাকার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অনেক স্লিপারেই ক্লিপের অস্তিত্ব নেই। বড় ধরনের দুর্ঘটনার আগে কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান এস এম আনোয়ারুল হক বলেন, ‘তাপমাত্রা বেশি হলে রেললাইন বেঁকে যায়। অনেক দেশ এই সমস্যা সমাধানে রেললাইনে সাদা রং ব্যবহার করছে। কারণ সাদা রং সবচেয়ে কম তাপ শোষণ করে। তাতে ৫-১০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা কম হয়। রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঝুঁকি কমাতে হলে দুই পাশে গাছপালা লাগানো যেতে পারে।
এ বিষয়ে রেলওয়ে ময়মনসিংহ বিভাগের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী আকরাম আলী বলেন, তাপপ্রবাহের কারণে পুরোনো রেললাইন সংস্কারের পাশাপাশি নতুন লাইন ত্রুটিমুক্ত রাখতে কাজ করা হচ্ছে। গরমে টহল টিমের সদস্য বাড়ানো হয়েছে। সমস্যার কোনো নমুনা পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।