সানজানা শিরিন। মাত্র ৩১ বছর বয়সেই তিনি প্রসূতি মায়েদের ভরসায় পরিণত হয়েছেন। সাত বছরে ৭৬১ জনের স্বাভাবিক প্রসব করিয়েছে। সেই সঙ্গে রক্তের জোগান দিয়েছেন ১০ হাজারের বেশি প্রসূতি মায়ের। এই কাজটি এখন সানজানা শিরিনের নেশায় পরিণত হয়েছে।
সানজানা শিরিন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলা গ্রামের বাসিন্দা। আট ভাইবোনের মধ্যে সানজানা তৃতীয়। বিয়ে হয়েছে খুলনায়। তবে এলাকাবাসীর সেবা করতে বাবার বাড়িতেই থাকেন।
বাবার আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষার পরই তিনি মেডিকেল অ্যাসিস্টেন্ট ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হন। চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে ২০১৬ সালের শেষের দিকে যোগ দেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) মা-মণির এইচএস প্রজেক্টে প্যারামেডিক পোস্টে। সেখানে ছয় মাসের মতো চাকরি শেষে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এফআইভিডিবিতে একই পদে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলায় দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তিনি মাত্র তিন মাসে ৩৩টি স্বাভাবিক প্রসব করিয়ে প্রশংসিত হন। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ এর অক্টোবর পর্যন্ত কমলগঞ্জের ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন হাসপাতালে সিনিয়র নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্তমানে সানজানা শিরিন নিজ এলাকাতে স্বাভাবিক প্রসব কেন্দ্র এবং বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলছেন। তার এই প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণাধীন রয়েছে। এই সঙ্গে শুরু করেছেন অনলাইনে পোশাকের ব্যবসা।
সানজানা শিরিন জানান, দেশে প্রতিনিয়ত সিজারিয়ান প্রসব বেড়ে চলেছে। এ কারণে ভিন্ন চিন্তা থেকে চাকরি চলাকালীন সময়ে তিনি স্বাভাবিক প্রসবের প্রতি জোর দিয়েছেন। তার নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে প্রসূতি মায়েদের সেবা ও স্বাভাবিক প্রসব করানো ছাড়াও ঠাঁই হবে অসহায় বৃদ্ধ মায়েদের। অনলাইনে পোশাক বিক্রি করে যে টাকা আয় করেন তা থেকেই প্রতিষ্ঠানটিকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন শিরিন। প্রতিষ্ঠানের জন্য ১২ লাখ টাকায় কিনেছেন ৫৩ শতক জায়গা। ভবন নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে খরচ হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯ লাখ ২০ হাজার টাকার জোগান দিয়েছেন ধার-দেনা করে। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য ১০ লাখ টাকা অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন।
শিরিন বলেন, ‘আমার বাবা মুদি ব্যবসায়ী ছিলেন। একসময় আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকলেও এখন বাবা ও সকল ভাইবোন মিলে আয় করায় দিন বদলেছে। প্রসূতি মায়েদের সেবা ও স্বাভাবিক প্রসব করানোতে যেহেতু আমি সফল, তাই আমার দায়িত্বও আছে। সেই দায়িত্ববোধ থেকে প্রতিষ্ঠানটি করছি। এখানে বিনামূল্যে প্রসূতি মায়েদের স্বাভাবিক প্রসব করানো হবে। এ ছাড়া অসহায় বৃদ্ধ মায়েদের জন্যও এখানে থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার জমানো কোনো টাকা নেই। অনলাইনে পোশাক বিক্রিতে আমি মোটামোটি সফল। প্রতি মাসে লাখ টাকার বেশি পোশাক বিক্রি করতে পারি। এই ব্যবসার লভ্যাংশ থেকে আমি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এ কারণে অর্থের অভাবে কাজ শেষ করা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
শিরিন আরও বলেন, ‘যে মায়েদের অবস্থা জটিল হবে তাদের তো সিজার লাগবে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত সিজার যেন না করা লাগে সেজন্য গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই আমাদের প্রতিষ্ঠানে মায়েদের কাউন্সিলিং করা হবে।’
সানজানা শিরিন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এসব কাজ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে। তবে আমি থেমে থাকব না। আমার কাজ আমি চালিয়ে যাব। প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রসহ যাবতীয় সকল বিষয়েই আমি প্রশাসনের সহযোগিতা চাই’