![দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমিরের খামারে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য](uploads/2024/02/13/1707812408.kumir.jpg)
ময়মনসিংহের ভালুকায় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমির খামার রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডে আবারও ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য।
সংকট কাটিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়ায় বাড়তি আয় হচ্ছে খামারটিতে। সবমিলিয়ে আবারও সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছে কর্তৃপক্ষ।
২০০৩ সালে ১৩ দশমিক ৮ একর জমির ওপর দেশের প্রথম কুমির খামার চালু করেছিলেন লেখক ও উদ্যোক্তা মুশতাক আহমেদ। ২০০৪ সালে রেপটাইলস ফার্মটি বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পায়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত সমমূলধন সহায়তা তহবিল বা ইইএফ থেকে ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ পায় খামারটি। এ বিনিয়োগের বিপরীতে খামারটির ৪৯ শতাংশ মালিকানা পায় ইইএফ। আর বাকি ৫১ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ৩৬ শতাংশ শেয়ার ছিল মেজবাহুল হকের ও ১৫ শতাংশ মুশতাক আহমেদের। তবে কুমিরের খাবার, বাচ্চা প্রজনন ও পরিচর্যার কাজে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়ায় ধীরে ধীরে খামারটি সংকটে পড়ে।
২০১৩ সালে মুশতাক আহমেদের কাছ থেকে খামারটি কিনে নেন আর্থিক খাতের আলোচিত ঋণখেলাপি পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা। এরপর খামার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নেন পি কে হালদার। জামানত হিসেবে খামারের জমি বন্ধক রাখা হয়। ২০১৯ সালে পি কে হালদার পালিয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। মুখ থুবড়ে পড়ে খামারটির কার্যক্রম।
২০২০ সালের অক্টোবরে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট জব্দ হলে কুমিরের খাবারের স্বাভাবিক জোগান বন্ধ হয়ে যায়। স্বাভাবিক খাবার না পেয়ে মরার উপক্রম হয় এসব প্রাণীর। কোম্পানির ঋণ সংক্রান্ত আইনি জটিলতায় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। শুধু খরচ হলেও কোনো আয় ছিল না। এমতাবস্থায় আশপাশের বিভিন্ন খামার থেকে মরা মুরগি সংগ্রহ করে কুমিরগুলোকে দেওয়া হতো। পি কে হালদার ভারতে আটকের পর হাইকোর্ট রেপটাইলস ফার্ম পরিচালনার জন্য ছয় সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করে দেন।
গত বছরের জানুয়ারিতে নানা প্রক্রিয়া শেষে ঋণের টাকা আদায়ে খামারটি নিলামে তোলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। নিলামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উদ্দীপন ৩৮ কোটি ২০ লাখ টাকায় খামারটি কিনে নেয়। পরবর্তী সময়ে খামারটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১৫০ টাকা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কর্মচারীরা কুমির ও বাচ্চাগুলোকে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এক সময় পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে ঝিমিয়ে থাকা কুমিরগুলো কখনো লাফিয়ে পানিতে পড়ছে, আবার কখনো কিনারায় উঠছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা টিকিট কেটে খামারের ভেতরে এসে কুমির দেখে আনন্দ করছেন।
কুমির দেখতে আসা সাবিনা খাতুন বলেন, ‘গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে সপরিবারে কুমির দেখতে এসেছি। একসঙ্গে বড়-ছোট অনেক কুমির দেখতে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। কুমিরের লাফালাফি দেখে সবচেয়ে আনন্দ পাচ্ছে শিশুরা।’
কুমির দেখতে আসা ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের শিক্ষার্থী আনিছুর রহমান বলেন, ‘বন্ধুরা মিলে এই খামারে ঘুরতে এসে ভালো লাগছে। দুই বছর আগে একবার বন্ধুরা মিলে এসেছিলাম। তখন ভালো লাগেনি, কারণ তখন কুমিরগুলোকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল খাবারের অভাবে ঝিমিয়ে পড়েছে। খামারটি ভালোভাবে পরিচালনা করে সচল রাখলে দিন দিন দর্শনার্থী বাড়বে।’
খামারটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনাম হক বলেন, ‘নতুন মালিকানায় সংকট কাটিয়ে পুরোদমে চলছে খামারের কাজ। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন-ভাতা বুঝে পাচ্ছেন। খামারটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে এবং আয়ের উৎস বাড়াতে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এতে দিন দিন দর্শনার্থী বাড়ছে। গবেষক ও শিক্ষার্থীদেরও খামারটি আকৃষ্ট করেছে।’
এ বিষয়ে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের পরিচালক ড. নাঈম আহম্মেদ বলেন, ‘বিশ্ব বাজারে কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত চড়া দামে বিক্রি হয়। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ২০১০ সালে জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৬৭টি হিমায়িত কুমির রপ্তানির মধ্য দিয়ে এর বাণিজ্যিক রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই খামার থেকে কুমির রপ্তানি হয়েছে। পাঁচবারে জাপানে কুমিরের ১ হাজার ৫০৭টি চামড়া রপ্তানি করা হয়েছে। প্রতিটি কুমিরের চামড়ার আন্তর্জাতিক বিক্রয়মূল্য ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার। ২০০৪ সালে মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা ৭৫টি কুমির নিয়ে যাত্রা শুরু হয় খামারটির। খামারটিতে বর্তমানে ৩ হাজার ৭০০টি কুমির রয়েছে।