পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৫ সালে। এই প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ায় পর খরচ বেড়ে ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকায় ঠেকেছে। বেড়েছে ৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বা ২৮৭ শতাংশ। প্রকল্পের শুরুতে বাস্তবায়নের সময় ধরা হয় তিন বছর। পরে ছয়বার সংশোধন করে ৯ বছর বাড়িয়ে চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে সরকারি অর্থ সঠিকভাবে খরচ হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর।
অডিটে প্রকল্পের শুরু থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১৩টি আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। আপত্তিগুলোর অধিকাংশই গুরুতর আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এই অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, পায়রা বন্দর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পটি ‘ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত’।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন মনিরুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, অনেকে বলছেন, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ কাজের মধ্যে ৮০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। তবে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ নাও হতে পারে।
কারণ এখনো সুবিধাভোগীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। তারা খাস জমিতে বসবাস করায় কাজে সমস্যা হচ্ছে।
অডিট আপত্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, বিচারাধীন ব্যাপারে কথা বলা ঠিক না। কারণ, যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রথমে অনিয়ম হয়েছে বলে অডিটে আপত্তি দেওয়া হয়েছে, পরে খতিয়ে দেখা গেছে যে, সেই অনিয়মের অভিযোগ ঠিক নয়। আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলে আইএমইডি থেকে এ ধরনের রিপোর্ট করা হয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। আলোচ্য প্রকল্পে কোনো ধরনের আর্থিক অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
আইএমইডির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সীমিত আকারে বন্দরের কার্যক্রম চালুকরণ এবং একটি পূর্ণাঙ্গ বন্দর গড়ে তোলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণের জন্য একনেকে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর এই প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১২৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছিল ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত অর্থাৎ তিন বছর। কিন্তু তিন বছর কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধন প্রস্তাব করা হলে একনেকে দ্বিতীয় দফায় ২০১৮ সালের ২০ মার্চ অনুমোদন দেয়। তাতে খরচ ধরা হয় ৩ হাজার ৩৫০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এক লাফে খরচ বাড়ে ১৯৭ শতাংশ। তৃতীয় দফায় আবার সংশোধন করে সময় বাড়ানো হয় ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।
জানা যায়, সময় ও অর্থ খরচ বাড়লেও কাজের অগ্রগতি ভালো হয়নি। তাই আবারও ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর সংশোধন করা হয়। তখন খরচ ধরা হয় ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। খরচ বেড়েছে ২৮৭ শতাংশ। ফলে এই প্রকল্পে মোট ৯ বছর সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুনে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
প্রকল্পের প্রধান কাজ ধরা হয় ৬ হাজার ৫৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ। এই ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত আনুমানিক ৩ হাজার ৫০০ পরিবারের পুনর্বাসন ও ৪ হাজার ২০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। জাতীয় মহাসড়ক এন-৮-এর সঙ্গে পায়রা বন্দরের যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ এবং আউটার বার ও নদীপথে চিহ্নিত বারগুলোর প্রয়োজনীয় ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথে মালামাল ও কন্টেইনার পরিবহন নিশ্চিত করা।
ফাস্টট্র্যাক প্রকল্প হওয়ায় আইএমইডি থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পটি তদারকি করা হয়। গত ১৯ আগস্টও পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনে তখনো কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ৬ হাজার ৫৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ ধরা হলেও দখলপ্রাপ্ত হয়েছে ৫ হাজার ৩৯০ একর। এখনো ৯৪২ একর ভূমি অধিগ্রহণ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন। আর ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৪টি প্যাকেজের আওতায় ৩ হাজার ২০০টির মধ্যে নির্মিত ২ হাজার ৬২৬টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট বাড়ি নির্মাণের জটিলতা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং দ্রুত নির্মাণ শেষে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে বরাদ্দ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯২ শতাংশ। অবশিষ্ট কাজ শেষ হবে নির্ধারিত সময় ২০২৪ সালের জুনে।
প্রকল্পটির ওপর গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ডিপিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুনে আবশ্যিকভাবে সমাপ্ত করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রকল্প পরিচালককে বাস্তব কাজের অগ্রগতি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য তৎপরতা বৃদ্ধি এবং তদারকি আরও জোরদার করতে হবে। প্রকল্প সমাপ্তির তিন মাসের মধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সমাপ্ত প্রকল্প রিপোর্ট (পিসিআর) আইএমইডিতে জমা দিতে হবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে ১৩টি অডিট আপত্তি তুলেছে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর। উত্থাপিত আপত্তিগুলোর অধিকাংশই আর্থিক অনিয়মের পর্যায়ভুক্ত।