বছরের শুরুতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ফলে যুক্তরাজ্য অবশেষে মন্দার কবল থেকে বেরিয়ে এসেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে অর্থনীতি দশমিক ৬০ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতির বৃদ্ধি। খবর বিবিসির।
ব্রিটিশ সম্প্রচার মাধ্যমটির খবরে বলা হয়, এর আগে টানা দুটি ত্রৈমাসিকে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হওয়ার পর, গত বছরের শেষের দিকে যুক্তরাজ্য মন্দার মধ্যে পড়েছিল।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ক্রান্তিকাল পার করে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু লেবার পার্টি বলেছে, আসলেই বিজয় উল্লাসের সময় এটি নয়।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি বিবিসিকে বলেছেন, যুক্তরাজ্য একটি পুনরুদ্ধার দেখছে, যদিও এটি খুব একটা শক্তিশালী ছিল না।
খবরে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের সুদের হার বর্তমানে ১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে, এর অর্থ হলো মানুষকে গৃহস্থালি ঋণ এবং অন্যান্য ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে, তবে সঞ্চয়কারীরাও ভালো রিটার্ন পেয়েছেন।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ড কখন ঋণ নেওয়ার খরচ কমিয়ে দেবে তার পূর্বাভাস দেওয়ার পরে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বন্ধকী ঋণের সুদহার বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি বলেছে, মূল্যবৃদ্ধির হার পরিমাপকারী মূল্যস্ফীতি, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে তার লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি নেমে আসবে। এটি জুনে হার কমানোর প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি শক্তিশালী জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সেই প্রত্যাশাকে ম্লান করে দিয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকস এর ডেপুটি চিফ রুথ গ্রেগরি বলেন, এটা (জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার) দেখিয়েছে যে, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সুদহার কমানোর জন্য তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।
রুথ গ্রেগরি বলেন, সুদহার কমানোর বিষয়টি আসন্ন কর্মসংস্থান এবং মুদ্রাস্ফীতির সর্বশেষ পরিসংখ্যান দ্বারা নির্ধারিত হবে।
জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (ওএনএস) জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম দিকে (জানুয়ারি-মার্চ) অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল সেবা খাত। এ খাতের মধ্যে রয়েছে হসপিটালিটি, শিল্পকলা ও বিনোদনের মতো ক্ষেত্রগুলো। এই প্রবৃদ্ধিতে সম্ভবত মার্চ মাসে খ্রিষ্টানদের প্রধান উৎসব ইস্টার সানডে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বছর ইস্টার সানডে উৎসব ছিল এপ্রিলে।
ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অনেক ক্রেতা পোশাক ও ঘরের সাজসজ্জার জিনিসপত্র কিনে নিজেদের আনন্দ দিচ্ছেন- এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ওএনএস বলেছে, গাড়ি প্রস্তুতকারকদের জন্যও (বছরের শুরুতে) একটি ভালো প্রান্তিক ছিল, যদিও নির্মাণখাত ‘দুর্বল’ ছিল।
যদিও সামগ্রিক অর্থনীতি আবার ক্রমবর্ধমান হচ্ছে, তবুও অনেক মানুষের অবস্থা আগের মতোই থাকতে পারে। কারণ মূল্যবৃদ্ধির হার (মুদ্রাস্ফীতি) ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব বাদ দিলে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় এখনো দশমিক ৭০ শতাংশ কম রয়েছে।
জিনিসপত্রের দাম আবার বাড়ছে
ব্রিস্টলে রোলকুইক সাইকেল দোকানের মালিক এড বিয়ার্ডওয়েল। গত ১১ মাস ধরে তিনি এখানে ব্যবসা করে আসছেন। এড বিয়ার্ডওয়েল বলেছেন, তার ব্যবসা এখন প্রায় বন্ধের পথে।
জীবনযাত্রার ব্যয়কে একটি সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে বিয়ার্ডওয়েল বলেন, ‘লোকেরা ব্রিস্টলে বেশ খরচ-সংবেদনশীল। প্রচুর বাইক চুরি হয়ে যায় এবং এর ফলে যারা বাইক কিনতে ইচ্ছুক তারা কম দাম দিতে চায়।
মন্দার সময় খারাপ বিক্রির কারণে বাইক সার্ভিসিংয়ের ওপর ফোকাস দেওয়া হয়েছে, যা এখন তার টার্নওভারের ৭০ শতাংশ।
বিয়ার্ডওয়েল বিবিসিকে বলেছেন, শীতকালটা বেশ হতাশাজনক ছিল, তখন মনে হচ্ছিল ব্যবসা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি দেখে এখন এটা মনে হচ্ছে যে, জিনিসপত্রের দাম আবার বাড়তে চলেছে। আপনি বিক্রয় পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, আমরা গত বছর এই পয়েন্টে নেমে এসেছি। তবে গত বছরের শেষের তুলনায় এখন ভালো উন্নতি করছি। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনীতি হলেও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, এখন মন্দা সবচেয়ে কম।
খবরে বলা হয়, মন্দার আংশিক কারণ লোকদের কম খরচ করা। কারণ তারা দোকানে (পণ্য কিনতে গিয়ে) উচ্চমূল্যের মুখোমুখি হয়েছিল এবং উচ্চ সুদের হার বন্ধকী ঋণের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
পরামর্শক সংস্থা কেপিএমজি ইউকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়ায়েল সেলফিন বলেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিকে পেছনে ফেলেছে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি।
ইয়ায়েল সেলফিন বলেন, আমরা এই বছরের বাকি অংশে অব্যাহত প্রবৃদ্ধি দেখা প্রত্যাশা করছি। পতনশীল মুদ্রাস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান মজুরি পারিবারিক আয়ের কিছু ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং পরিবারের ভোগে সহায়তা করতে সাহায্য করে।
অর্থনীতি যখন নির্বাচনি ইস্যু
অর্থনীতির আকার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দ্বারা পরিমাপ করা হয়, যা একটি দেশের কোম্পানি, সরকার ও জনগণের সব অর্থনৈতিক কার্যকলাপের দিকে নজর দেয়।
বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী চান জিডিপি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাক। কারণ এর মানে হলো, সাধারণত মানুষ বেশি খরচ করছে, অতিরিক্ত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, সরকারকে আরও বেশি কর দেওয়া হয়েছে এবং শ্রমিকদের বেতন ভালোভাবে বাড়ছে।
খবরে বলা হয়, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের শক্তি সম্পর্কে বিতর্ক সাধারণ নির্বাচনের প্রচারে একটি কেন্দ্রীয় যুদ্ধক্ষেত্র হতে চলেছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধান অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেছেন, গত কয়েক বছর যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির জন্য একটি কঠিন সময় ছিল। ‘আজকের বৃদ্ধির পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, মহামারির পরে অর্থনীতি প্রথমবারের মতো পূর্ণ স্বাস্থ্যে ফিরে আসছে।’
বিবিসির টুডে প্রোগ্রামে দেওয়া বক্তব্যে জেরেমি হান্ট বলেন, ‘পরিবারগুলো সত্যিই কঠিন সময় পার করছে। আমি মনে করি, তারা এখন দেখতে পাচ্ছে যে মহামারির পরে অর্থনীতিকে তাদের অনুকূলে ফিরিয়ে আনতে আমরা খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই সঙ্গে জ্বালানি সংকটের পর আমরা অর্থনীতি স্বাভাবিক করতে যেসব কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই ইতিবাচক পরিবর্তন ধরে রাখতে আমাদের আরও কিছুদিন এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
লেবার পার্টির ছায়া অর্থমন্ত্রী র্যাচেল রিভস, চলতি সপ্তাহের শুরুতে অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে সরকারের পরিসংখ্যানকে বিভ্রান্তিকর বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। তিনি বলেছেন, এটি কনজারভেটিভ পার্টির মন্ত্রীদের জন্য বিজয় উদযাপনের সময় নয়।
রিভস আরও বলেছেন, ‘১৪ বছরের অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার পরে, শ্রমজীবী মানুষ এখন আরও খারাপ অবস্থায় আছে।’
লিবারেল ডেমোক্র্যাট ট্রেজারি মুখপাত্র সারাহ ওলনি বলেছেন, পরিসংখ্যানটি উদযাপনের জন্য একটি যতসামান্য কারণ ছিল।
অর্থাৎ উদযাপন করার মতো কোনো বিষয় এখানে নেই।