মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি রোধে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে সম্প্রতি একটি নতুন আইন পাস করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ বা সিএসডিডিডি নামে এই আইনটি কার্যকর হলে ক্রেতা ও রপ্তানিকারক উভয়েরই আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে।
দেশীয় পোশাক রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইনটি কার্যকর হলে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে পরিবেশ ও শ্রমবান্ধব করতে হবে। নতুন করে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে শ্রমের মজুরি। এই আইন বাস্তবায়িত হলে বড় পোশাক কারখানাগুলো সক্ষমতা অর্জন করে টিকে থাকতে পারলেও চাপে পড়বে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। ফলে সংকট বাড়তে পারে এই খাতে। কারণ বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানা বেশি।
বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৭টি দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়। এ আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশসহ ইউরোপে রপ্তানি করা এমন দেশগুলোও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
জানা গেছে, ক্রেতা ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয়টি তাদের নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে আইনটি কার্যকর হবে।
তবে যেসব ইইউ কোম্পানি বা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের পাঁচ হাজারের বেশি কর্মী ও ১৫০ কোটি ইউরো বার্ষিক লেনদেন হয়, ২০২৭ সালে সেসব কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রথমবার আইনের বিধানগুলো কার্যকর হবে। পরের বছরগুলোতে তা কমে ১ হাজার কর্মী ও ৪৫ কোটি ইউরো বার্ষিক লেনদেনের কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস রপ্তানি খাত। রপ্তানি আয়ে ৮০ শতাংশ অবদান পোশাক খাত থেকে। আবার এই পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। চীনের পর ইউরোপে দ্বিতীয় পোশাক সরবরাহকারী বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, দেশের মোট পোশাকের ৫০ শতাংশ রপ্তানি হয় ইইউভুক্ত ২৭টি দেশে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তার মধ্যে ইইউতে রপ্তানি হয় ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই আইন বাস্তবায়ন হলে কেবল পোশাক খাতই নয়, বরং প্রভাব পড়বে অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতেও।
তবে এই আইনের নেতিবাচক-ইতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান।
তিনি খবরের কাগজকে বলেন, এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের একীভূত কোনো শর্ত নেই। ফলে কিছু দেশের ক্রেতারা এক রকম নিয়ম দেয়, অন্যরা আবার অতিরিক্ত শর্তসহ অন্য শর্ত দেয়, ফলে আমরা একটা অসম পরিস্থিতির মধ্যে আছি। এই আইন করার কারণে ইউরোপের সব দেশ যখন কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারে সিরিয়াস হবে, তখন এটা আমাদের জন্য উপকারী হবে। এটা এই আইনের একটা ভালো দিক। কারণ যখন বিদেশি ক্রেতারা ন্যূনতম একটা স্ট্যান্ডার্ড চাইবে, তখন আমাদের লেবার স্ট্যান্ডার্ডও ভালো হবে। তখন নন-কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি থেকে ক্রেতারা মাল কিনতে পারবে না। আমরা তখন একটা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ পাব।
আইনের কিছু খারাপ দিক উল্লেখ করে বিকেএমইএর এই নেতা বলেন, এই আইনের কারণে যেসব ছোট কারখানা রয়েছে, সেগুলো চাপে পড়বে।
যদিও প্রতিযোগী দেশের তুলনায় পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনে দেশের পোশাকশিল্প বেশ এগিয়েছে। এখন পর্যন্ত ২১৫টি কারখানা পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ পেয়েছে। এর বাইরে পাঁচ শতাধিক কারখানা পরিবেশবান্ধব হওয়ার পথে রয়েছে। এদিক থেকে বড় কোম্পানিগুলো সুবিধায় থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘এই আইনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানায় যে সংস্কার হয়েছে, সেটার নজির কোথাও নেই। কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ না নিলে তো আমরা যে একের পর এক গ্রিন কারখানা করছি সেটা হতো না। গ্রিন ফ্যাক্টরির দিক থেকে এশিয়ার শীর্ষ ১০টি কারখানার মধ্যে প্রায় ৭টি হচ্ছে বাংলাদেশে।
এদিকে বাংলাদেশ এখনো কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। দেশের রপ্তানিকারকদের প্রায় ৯৫ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। সিএসডিডিডি অনুযায়ী, তাদের উৎপাদন কার্যক্রমকে ক্রমান্বয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরিত করতে হবে। এতে করে বাড়বে উৎপাদন ও অবকাঠামোগত খরচও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘এটা অবশ্যই ব্যয়বহুল। তবে আমাদের মালিকদের, এই বাড়তি ব্যয় ক্রেতাদের কাছ থেকে নিতে হবে। আশা করি তারাও সেটা দেবে। কারণ তাদের স্বার্থে, তাদের আইন বাস্তবায়ন করতেই তো আমরা এই কাজটা করেছি।
এদিকে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর শ্রমিকদের অধিকারের ক্ষেত্র কিছুটা উন্নত হলেও ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন ও চর্চায় এখনো বাধা রয়ে গেছে। ইইউর নতুন বিধান বাস্তবায়িত হলে শ্রম অধিকারের উন্নতি ঘটাবে বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা। এর ফলে কাজের পরিবেশ, যৌথ দর-কষাকষি এবং শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহ আরও সহজ হবে বলেও মনে করেন তারা।
শ্রমিক সংগঠনের বৈশ্বিক জোটের বাংলাদেশ অংশ, ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘আইনটি শ্রমিকদের জন্য ভালো। আমাদের শিল্পকে আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আর এ জন্য যা যা করা দরকার তা করতে হবে। তবে এর খরচ যে শুধু আমাদের শিল্পই বহন করবে তা নয়, বরং ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের এটা বহন করতে হবে।’
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন বলেন, জার্মানির জন্য এমন বিধান অনেক আগে থেকেই আছে। এখন গোটা ইইউর জন্য এটা কার্যকর হতে যাচ্ছে। এই আইনে শ্রমিকদের সুবিধার দিক আছে। এই আইনটা বাস্তবায়নের দিকে গেলে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়া, বাধাহীনভাবে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম চালানো এবং যৌথ দর-কষাকষিসহ অন্য জায়গাগুলো সহজ হবে।
ইইউর এই আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে ক্রেতা ও সরবরাহকারী উভয়কেই উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘সিএসডিডিডি নিয়ে আমরা অনেক আগে থেকেই কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এর আগেও আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বসেছি, তাদের বলেছি, তোমাদের আইনটি কখনোই কার্যকর হবে না, যদি না তোমাদের ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা আমাদের সাপ্লাই চেইনকে সঠিক দাম না দেয়। এ জন্য তারা সাপ্লাই চেইনগুলোকে সঠিক দাম দিচ্ছে কি না, সেটা যদি তোমরা তদারকি না করো, তাহলে এই আইন বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন হবে।’
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, ‘সাপ্লাই চেইনকে আইনে বাস্তবায়ন করতে হলে এটি তাদের জন্য ব্যয়বহুল হবে। এই অতিরিক্ত ব্যয়টা আসলে কে বহন করবে। ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা যদি আমার সাপ্লাই চেইনকে সঠিক দাম না দেয়, তাহলে এটা বাস্তবায়ন করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। শ্রমিকরাও এ থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ দেশীয় কোম্পানিগুলো ন্যায্যমূল্য না পেলে শ্রমের সঠিক মূল্য দেওয়া সম্ভব হবে না। আর সেটা না হলে আইনটিও কার্যকর হবে না।’