জ্যৈষ্ঠমাস আসতে আর বেশি দেরি নেই। ফলে রাজশাহীতে গাছের ডালে থোকায় থোকায় ঝুলছে মৌসুমি ফল লিচু। তবে মৌসুম আসার আগেই আগাম জাতের লিচু বাজারে দেখা যাচ্ছে। অনেকে আবার বেশি লাভের আশায় অপরিপক্ব লিচু বাজারে নিয়ে আসছেন। নতুন ওঠায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে লিচু। এর ফলে দাম সাধ্যের বাইরে হওয়ায় আগাম জাতের এসব লিচু কিনতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।
তবে, তীব্র তাপপ্রবাহ ও প্রচণ্ড খরায় বেশির ভাগ গাছের লিচু ঝরে পড়ায় ও ফেটে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চলতি মৌসুমে দাম বেশিই থাকবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, চলতি মৌসুমে গাছে গাছে লিচুর প্রচুর মুকুল এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ মার্চ মাসের ২০ ও ২১ তারিখে বৃষ্টি হয়ে অধিকাংশ মুকুল ঝরে যায়। অবশিষ্ট মুকুল থেকে গুটি ও লিচু হয়ে গেলেও বৃষ্টির কোনো দেখা মেলেনি। বরং প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ ও খরায় ৬০ শতাংশ লিচু ফেটে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে ব্যাপক লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে ৫৩০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৮ হেক্টর বেশি। এ বছর লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮০০ টন। তবে, তীব্র তাপপ্রবাহ, প্রচণ্ড খরায় বেশির ভাগ গাছের লিচু ঝরে পড়ছে। যেগুলোতে লিচু ছিল, সেগুলোতেও অনেক লিচু শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
রাজশাহী মহানগরীর ছোটবনগ্রাম, রায়পাড়া, পুঠিয়া, মোহনপুর উপজেলার কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের এ বছর বোম্বাই, মাদ্রাজি, কাদমি, মোজাফফরপুরী, বেদানা, কালীবাড়ি, মঙ্গলবাড়ী, চায়না-৩, বারি-১, বারি-২ ও বারি-৩ জাতের লিচু বেশি চাষ হয়েছে। তবে ঝরে পড়ায় ফলন খুব কম রয়েছে। যেগুলো রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ লিচু রোদের খরতাপে ফেটে নষ্ট হয়ে গেছে। জ্যৈষ্ঠমাস শুরু হলে জমে উঠবে লিচুর বাজার। তবুও আগামজাতের লিচু ইতোমধ্যে গাছ থেকে নামানো শুরু করেছেন বাগান মালিকরা। আবার, কেউ কেউ অধিক লাভের আশায় অপরিপক্ব লিচুও নামাচ্ছেন।
নগরীর ছোটবনগ্রাম এলাকায় লিচুর বাগান কিনেছেন ব্যবসায়ী হাসমত আলী। তিনি বলেন, ‘আগামজাতের কিছু লিচু ইতোমধ্যে গাছ থেকে নামানো শুরু হয়েছে। তবে বৈরী আবহাওয়ায় শুরু থেকেই ফলন কম ছিল। পরে প্রচণ্ড দাবদাহ ও অনাবৃষ্টিতে লিচু ফেটে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে একদিকে লিচুর সংখ্যা কমে গেছে, অন্যদিকে লিচু বাছাই করতে করতেই দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শ্রমিকও বেশি লাগায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যে টাকায় বাগান কিনেছিলাম ১০০ লিচু ৩০০ টাকা করে বিক্রি করলেও লাভ হবে না। কিন্তু আমরা ১ হাজার লিচু খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ২ হাজার ৫০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। তারা বেশি দামে বিক্রি করবে।’
নগরীর সাহেববাজার, উপশহর নিউমার্কেট, লক্ষ্মীপুর, রেল স্টেশন, শালবাগান, বিন্দুরমোড়সহ বিভিন্ন এলাকার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব জায়গায় বাহারি এ ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন মৌসুমি ফল ব্যবসায়ীরা। ঝুড়ির মধ্যে চটের ভেজা বস্তা। তার ওপর সবুজ পাতায় মোড়ানো লাল লিচুগুলো এখন থোকায়-থোকায় শোভা ছড়াচ্ছে। এ ছাড়াও নগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল-সংলগ্ন বিভিন্ন সড়কের দুই পাশেও লিচু বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে দাম চড়া। ১০০ লিচুর দাম রাখা হচ্ছে ৩০০ টাকা। দাম বেশি হলেও বছরের প্রথম ফল হিসেবে শখ করে কিনছেন অনেকেই।
ব্যবসায়ীরা জানান, এখন দেশি ছাড়া অন্য জাতের লিচু বাজারে আসেনি। বোম্বাইসহ অন্য জাতের লিচুগুলো আরও কয়েকদিন পর বাজারে আসবে। এবার লিচুর উৎপাদন কম। তাই মৌসুমজুড়েই লিচুর দাম বেশি থাকতে পারে।
রাজশাহীর পবা উপজেলার লিচুচাষি শাহরিয়ার হোসেন জানান, তার ৭০টি লিচুগাছ রয়েছে। সব গাছে মুকুল এলে বৈরী আবহাওয়ার কারণে লিচু ঝরে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলো এখনো পরিপক্ব হয়নি। তবে কয়েকটি গাছে আগাম লিচু পাকতে শুরু করায় তিনি বিক্রির জন্য বাজারে লিচু নিয়ে এসেছেন। এতে ভালো দাম পাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আজ ৫০০ লিচু নিয়ে এসেছি। বাজারে নতুন ফল দেখে অনেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব বিক্রি হয়ে গেছে।’
নগরীর সাহেব বাজারে লিচু কিনতে এসেছেন আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চলতি মৌসুমে প্রথম বাজারে লিচু এসেছে। বাচ্চাদের জন্য কিনতে চাইলাম। কিন্তু ১০০ লিচু ৩০০ টাকার নিচে দেবে না। তাই ৫০টি লিচু কিনলাম।’
রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জ্যৈষ্ঠমাস শুরুর আগে দেশি জাতের কিছু লিচু পাওয়া যায়। তবে মূল লিচু আসতে এখনো অনেক সময় লাগবে। সাধারণত এসব লিচু পেতে আমাদের মে মাসের শেষ দিকে বা জুনের শুরু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।’
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোছা. উম্মে ছালমা বলেন, ‘চলতি মৌসুমে গাছে গাছে প্রচুর লিচুর মুকুল এলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে অনেক ঝরে গেছে। তবে কৃষি অধিদপ্তরের পরামর্শে গাছের ও মুকুলের যত্ন নেওয়ায় এখনো পর্যাপ্ত লিচু আছে। ফলে বাজারে লিচুর কোনো সংকট হবে না। এ ছাড়া, লিচুর পুরো মৌসুম শুরু হলে দামও কমে আসবে।’