‘২০০ কার্টনের দাম দিলেও দুই দিন পর তেল পাওয়া গেছে ৩০ কার্টন। সঙ্গে পোলাওয়ের চাল, সরিষার তেল ধরিয়ে দেয়। পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও এক ও দুই লিটারের তেল পাই না। দাম বাড়িয়েও কোম্পানি সয়াবিন তেল সরবরাহ করে না। এ জন্য আমরাও ভোক্তাদের দিতে পারি না। বিক্রি কমে গেছে। খুবই প্যারায় (যন্ত্রণা) আছি।’ এভাবেই রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ইউসুফ জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী ইউসুফ আলী তেলের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শুধু এই ব্যবসায়ী নন, অন্য বাজারের খুচরা বিক্রেতাদেরও একই ক্ষোভ দেখা গেছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) আগের মতো চড়া দামে চাল বিক্রি হতে দেখা গেছে। মুরগির দামও কমেনি। মাঘের শীত বিদায় নেওয়ায় সবজির দাম একটু বেড়েছে। বিভিন্ন বাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
দুই মাস আগেও বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যায়। এরপর ৯ ডিসেম্বর সরকার লিটারে দাম ৮ টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত তেলের দর ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করে। ওই দিন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেছিলেন, ‘তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি বাজারে আর তেলের ঘাটতি হবে না।’ কিন্তু দুই মাস চলে গেলেও সংকট কাটেনি।
বিভিন্ন ভোজ্যতেল কোম্পানি বাজারে তেল সরবরাহ কমিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে খুচরা বিক্রেতারা সহজে তেল পাচ্ছেন না। রমজান মাস ঘনিয়ে আসায় সরবরাহ কমিয়ে মিলমালিকরা আবারও তেলের দাম বাড়ানোর ফন্দি আঁটছেন। কোনো কোনো খুচরা বিক্রেতা তেল পেলেও কোম্পানির প্রতিনিধিরা সঙ্গে ডাল, চালও ধরিয়ে দিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের অনন্ত স্টোরের স্বত্বাধিকারী নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘দোকানে তেল নেই। রাখি না। কারণ তেলের সঙ্গে পোলাওয়ের চাল, সরিষার তেল, আটা ধরিয়ে দিচ্ছে। এসব তেমন চলে না। এভাবে ব্যবসা করা যায় না।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘কোম্পানি থেকে শর্ত দিয়ে পণ্য বিক্রি করবে- এ ব্যবস্থা কোন আইনে আছে? সরকারের উচিত এ বিষয়ে নজর দেওয়া।’ এই বাজারের মনির স্টোরের আনোয়ার হোসেনেরও একই বক্তব্য। এভাবে ব্যবসা হয় না। সামনে রমজান। এ জন্য কোম্পানি লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে। কয়দিন পরপর দুই-এক কার্টন দিলেও তারপর আর খবর নেই।
এদিকে কারওয়ান বাজারেও দেখা গেছে একই চিত্র। এই বাজারের কিচেন মার্কেটের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় অসংখ্য মুদির দোকান। ইয়াছিন স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. ইয়াসিন আলী বলেন, ‘তেল আছে। আবার নেই। এক কার্টন (২০ লিটার) এক দিন পাওয়া গেলেও সপ্তাহজুড়ে কোনো খবর থাকে না। তীর, ফ্রেশ, পুষ্টি কোনো তেলই নেই। টাকা দিয়েও পাই না। সামনে রমজান। তাই দাম বাড়ানোর খেলা চলছে।’
একই বাজারের ফরিদগঞ্জ স্টোরের মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সিটি গ্রুপের তীর ব্র্যান্ডের তেল নেই। এডিবল অয়েল কোম্পানির রূপচাঁদা ও টিকে গ্রুপের পুষ্টির ডিলাররা তেলের সঙ্গে চাল, ডাল ও সুজি ধরিয়ে দিচ্ছেন।’
একই বাজারের জব্বার স্টোরের বিক্রয়কর্মী গনি মিয়া, আল আমিন স্টোরের অন্তর বিশ্বাসসহ অসংখ্য খুচরা বিক্রেতা অভিযোগ করে জানান, দুই মাসও হয়নি দাম বাড়ানো হয়েছে। তার পরও কোম্পানির ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতারা ঠিকমতো তেল দেন না। পাঁচ লিটারের গায়ের যে মূল্য (৮৫০ টাকা), সেই দামেই কিনতে হচ্ছে। কেউ কারও কথা শোনে না। সরকারও দেখে না। সাংবাদিকরা লিখলেও কোনো কাজ হয় না।’
রাজধানীর হাতিরপুল বাজারের মাসুদ স্টোরের মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর আগে বিভিন্ন কোম্পানি সরবরাহ কমিয়ে দেয়। কিছুদিন আগেই দাম বেড়েছে। সামনে রমজান। আবার সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
নিউ মার্কেটসহ অন্য বাজারের খুচরা বিক্রেতাদেরও একই অভিযোগ, এভাবে ব্যবসা করা যায় না। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি করা দরকার।
খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের ডিলার মেসার্স মিনু ট্রেডার্সের বিপ্লব কুমার বলেন, ‘আমি ফ্রেশসহ অন্য কোম্পানিরও সয়াবিন তেল বিক্রি করি। চাহিদা বেশি। কিন্তু আগের মতো তেল পাওয়া যায় না। এ জন্য খুচরা বিক্রেতাদের চাহিদামতো তেল দিতে পারছি না।’
এ ব্যাপারে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও টিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা হায়দার সম্প্রতি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি থেকে তেল সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। আমরা শর্ত দিয়ে ভোক্তাদের কাছে কোনো তেল বিক্রি করি না। স্বাভাবিক নিয়মেই ব্যবসা করা হচ্ছে।’
সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে
মাঘ মাসের শেষে সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে বলে জানান সবজি বিক্রেতারা। তারা বলেন, বেগুনের কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, শিম ২০ থেকে ৫০, কাঁচা মরিচ ৮০ থেকে ১০০, টমেটো ৩০ থেকে ৬০, পেঁপে ৪০, শসা ও গাজর ৪০ থেকে ৫০, ফুলকপির পিস ২০ থেকে ৩০, বাঁধাকপি ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি, লাউয়ের পিস ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতকাল বিভিন্ন বাজারে আলু ২০ টাকা কেজি, পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫০, দেশি আদা ১২০ থেকে ১৬০, আমদানি করা আদা ২২০, দেশি রসুন ১৬০, আমদানি করা আদা ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে আগের মতোই চড়া দামে চাল বিক্রি হয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা বলেন, বর্তমানে মিনিকেটের কেজি ৭২-৮৫ টাকা, আটাশ চাল ৬২-৬৫ টাকা ও মোটা চাল ৫৪-৫৬ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। মুদি দোকানিরা বলেন, রমজান ঘনিয়ে এলেও বাড়েনি ছোলা ও চিনির দাম। ছোলার দাম কমে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা কেজি, মসুর ডাল ১১০ থেকে ১৩৫, মুগ ডাল ১৮০, চিনি ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাড়তি দামে মুরগি বিক্রি
মাংস বিক্রেতারা জানান, আগের মতোই বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে মুরগি। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩২০ থেকে ৩৩০ এবং দেশি মুরগি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গরুর মাংসও আগের মতো ৭০০-৭৫০ টাকা ও খাসির মাংস ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ডিমও গত সপ্তাহের মতো ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা ডজন বিক্রি করতে দেখা গেছে।